পদ্মা নদীর মাঝি র জল যন্ত্রনা অবসাদ মৃত্যু
পড়তেন প্রেসিডেন্সি কলেজে | অঙ্ক অনার্স | কিন্তু কলেজে পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয় বাম রাজনীতিতে | সঙ্গে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। পরপর দুবার ফেল করলেন কলেজে | খবর গেল দাদার কাছে | ভাইয়ের রাজনীতি করার খবরে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলেন দাদা | চিঠিতে লিখলেন, ‘‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে, ফেল কেন করেছ, তার কৈফিয়ত দাও।’’ দাদাকে তিনি লিখলেন, গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। দাদা লিখলেন, ‘‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ উত্তরে তিনি দাদাকে লিখলেন, ‘‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’’
তখন চোদ্দ কী পনেরো বছর বয়স হবে, হঠাৎই বাড়ি থেকে নিখোঁজ। কয়েক দিন পেরিয়ে গেল ছেলের খবর নেই। বাড়ির সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। মা কেঁদেকেটে অস্থির।
অনেক খোঁজের পর মানিককে পাওয়া গেল, টাঙ্গাইলের নদীর ধারে যে নৌকোগুলো নোঙ্গর করা রয়েছে, তাদের মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে। দুই বেলা তাদের সঙ্গে গল্প,গান খাওয়াদাওয়া করে দিব্যি রয়েছে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বাড়ি ফেরানো হল। সেদিন কেই বা জানত মাঝির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে ছেলেটির এই আত্মীয়তাই একদিন জন্ম দেবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নামের এক উপন্যাস!
আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন দারিদ্রতার সঙ্গে | প্রায়ই বলতেন ‘'দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে।’' আক্রান্ত হয়েছেন মৃগীরোগে | শরীর বলহীন,তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে চলছে নিজের রোগের সঙ্গে, চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই।
এই রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই শুরু করলেন অপরিমিত মদ্যপান।
এর মধ্যেই চিকিৎসক বিধান রায়ের পরামর্শে বিয়ে করেছেন, ছেলে–মেয়ে হয়েছে। বাবাকে নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে।
বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর স্ট্রিটে ঠাসাঠাসি করে কোনওমতে থাকা।
তাতেই চলে একের পর এক যুগান্তকারী রচনা। তাতেও সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে চাকরি নিলেন। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে চাকরিতে ইস্তফা।দারিদ্র যে কী ভয়ংকর তা জানা যায় মানিকের ডায়েরি থেকে- স্ত্রী ডলি অর্থাৎ কমলা এক মৃত সন্তানপ্রসব করার পর মানিক ডায়েরিতে লেখেন, ‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’
দারিদ্র ঠিক কোন পর্যায়ে এলে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে আসে!
৩০ নভেম্বর, জ্ঞান হারালেন। ২ ডিসেম্বর নীলরতন হাসপাতালে পৌঁছল তাঁর সংজ্ঞাহীন শরীর। অচৈতন্য শরীরের ডান হাতটা বারবার শূন্যে উঠে যাচ্ছিল। চেষ্টা করছিল লেখার। মানিকের চেতনা কি তখনো মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিল লেখার? না লিখলে যে বাঁচা যাবে না, এই কথা তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানে! মাত্র একদিনের অপেক্ষা।
৩ ডিসেম্বর, মানিককে মুক্তি দিল জীবন। চিরতরে।
৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে ৪০ টি উপন্যাস এবং ৩০০ টি ছোট গল্প | দাদাকে দেওয়া কথা মিলে গিয়েছিল । তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক |
তিনি মানিক বন্দোপাধ্যায় | ৪৮ বছর জীবনসীমায় রেখে গিয়েছেন যুগযুগান্ত অমরত্বের রসদ।
প্রয়াণদিবসে বিনম্র প্রণাম ।
© অহর্নিশ
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা(দিবারাত্রির মানিক - বিনোদ ঘোষাল )
==========
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ নামটাই যথেষ্ট ৷ এরপর আর কোনকিছু না লিখলেও চলে ৷
জননী ৷ দিবারত্রির কাব্য ৷ পদ্মানদীর মাঝি ৷ পুতুলনাচের ইতিকথা ৷ চতুষ্কোন ৷ বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক উপন্যাসগুলি দু'মলাটের মধ্যে ৷ ভাবা যায় ! তার উপর পাতা, প্রিন্টিং, বাঁধাই, প্রচ্ছদ কভার এককথায় ফাটাফাটি ৷
পাঁচটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাজন লিংক : https://amzn.to/45u5vNw (সৌজন্য। সুজন মজুমদার )
কোন মন্তব্য নেই