অসমীয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার স্বার্থে ১৯৭৮সালে বহিরাগত বিতরণের বীজ বপন করা হয়
চিত্ত পাল
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অসমের মোট জনসংখ্যার পঁচিশ শতাংশ অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ রাখতেই ১৯৭৮ সালে বহিরাগত বিতাড়নের বীজ সুপরিকল্পিত ভাবে অঙ্কুরিত করা হয়েছিলো। সে বছর অসম বিধান সভায় ৩৮ জন মুসলিম বিধায়ক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলো।তার মধ্যে আর সি পি আই-র সামসূল হুদা, সি পি আই-র গিয়াস উদ্দিন, সি পি আই এমের একজন সহ জনতা দলের প্রার্থি হয়ে গোলাম ওসমানিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতে নব গঠিত জনতা সরকারের মুখ্যমন্ত্ৰী গোলাপ বরবরা মন্ত্রী সভার বহু জাতীয়তাবাদী নেতার চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে উঠেছিলো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে মঙ্গলদৈ লোকসভা কেন্দ্রে উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার অজুহাতে জনতা পার্টির প্রার্থিত্ব পেয়ে হীরালাল পাটোয়ারি বলে বসলেন যে মঙ্গলদৈ সংসদীয় এলেকায় এক লক্ষ বিদেশির নাম ভোটার তালিকায় রয়েছে। এ কথা সর্বজন বিদিত।
ওদিকে, আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলস্বরূপে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল দুভাগে বিভক্ত হয়েছিলো। ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি কংগ্রেস ও ইন্দিরা কংগ্রেস। রেড্ডি কংগ্রেসে ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শরৎ সিংহ, কংগ্রেস দলের সর্বভারতীয় সভাপতি প্রয়াত দেবকান্ত বরুয়া, প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত ইদ্রিস আলী, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় প্রমুখেরা। বিপরীতে, ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত আনোয়ারা তাইমূর, তিলক গগৈ ও বিষ্ণু প্রসাদ প্রমুখেরা। সে বছর অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও অসমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। অন্ধ্রপ্রদেশে চেন্নাই রেড্ডি নেতৃত্বে ইন্দিরা কংগ্রেস সরকার গঠনের পাশাপাশি কর্ণাটকেও দেবরাজ উষের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়েছিলো। যদিও অসমে প্রয়াত গোলাপ বরবরা-র নেতৃত্বে জনতা দলের সরকার গঠন হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনে সংখ্যালঘু বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রার্থি হিসেবে আট জন মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও তাঁরা জনতা সরকারের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছিলো।
জানা মতে, আনোয়ারা তাইমূর ও তিলক গগৈর মধ্যে অত্যন্ত সু-সম্পর্ক ছিলো। তাঁরা দুজনে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অসমের কংগ্রেসের রাজনীতির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পাশাপাশি পরবর্তী কংগ্রেস সরকার গঠনের জন্য দাবার চাল দিতে শুরু করেছিলেন। প্রয়াত দেবকান্ত বরুয়া কে রাজনৈতিক ভাবে নিঃশেষ করতে বিষ্ণু প্রসাদ কে লুফে নিয়েছিলেন আনোয়ারা তাইমূর ।
কেন্দ্রে তখন প্রয়াত মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য গোলাপ বরবরা ও দুলাল বরুয়া দুজনেই আগে একসঙ্গে স্যোশালিষ্ট পার্টি করতেন। তাঁরা দুজনে মোরারজী দেশাইয়ের তম দেশাইয়ের তমমইনূল সাথে দেখা করে অসমে মুসলিম জন বিষ্ফোরণের কথা বুঝিয়ে বলেন। মোরারজী দেশাইয়ের ইঙ্গিতেই তদানীন্তন চীফ ইলেকশান কমিশনার এস এল শাকদের মিডিয়া-তে বলেন যে অসমের ভোটার তালিকায় ত্রিশ লক্ষ বিদেশির নাম সন্নিবিষ্ট হয়েছে। সারা অসম ছাত্র সংস্থা বিদেশি বহিষ্করণের দাবি তে আন্দোলন করেছিলো। যদিও পূর্বাঞ্চল লোক পরিষদের নিবারণ বরা এই বিদেশি বিতাড়নের ইস্যু টিকে অসমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন অসমে মাত্র দুটো সংবাদ পত্র ছিলো। অথচ নিবারণ বরা ধারাবাহিক ভাবে সংবাদ পরিবেশন করে অসমিয়া মানুষের মনে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সত্যিই অসমে ত্রিশ লক্ষ বিদেশি আছে?
ওদিকে, হীরালাল পাটোয়ারি মঙ্গলদৈ লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হওয়া সত্বেও চীফ ইলেকশান কমিশনার শাকদের তাঁর জয় খারিজ করে দেন। সে বছর সারা অসম ছাত্র সংস্থার সভাপতি ছিলেন অমিত বরগোঁহাই। বিশিষ্ট লেখক প্রয়াত হোমেন বরগোঁহাইয়ের ভাই। সাধারন সম্পাদক ছিলেন ধরণীধর বরা। সে বছর প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ছিলেন আসু নগাঁও জেলার সভাপতি। শোনা মতে, হীরালাল পাটোয়ারি ও দুলাল বরুয়া সহ গোলাপ বরবরা হচ্ছে বিদেশি বিতাড়নের মাষ্টার মাইণ্ড।
বলাবাহুল্য, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ১৯৭৯ সালে যোরহাট শহরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে আসু-র সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি ভৃগু কুমার ফুকন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আসু-র প্রথম কার্যবাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো নগাঁও শহরে। সে বছর-ই ১২ আগষ্ট নগাঁও কলেজের ১৫ নম্বর কক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বলে জানা গেছে। আসু-র প্রথম কার্যবাহী সভায় ১৯৫৫ সালের পর অসমে আসা মূলতঃ অনা-অসমিয়া বহিরাগত দের বহিষ্কার করার দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। তখন মুসলিমের ওপর অমানবীয় নির্যাতন শুরু হওয়ার পর আনোয়ারা তাইমূর ও তিলক গগৈ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলার পর ইন্দিরা গান্ধী আইনী পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেন। অ্যাডভোকেট আব্দুল মুহিব মজুমদার গুয়াহাটি হাইকোর্টে আইনী লড়াই করে প্রায় ৪৮ হাজার মুসলিমের নাগরিকত্ব রক্ষা করেছিলেন। উত্থাপিত অভিযোগ মতে, আর এস এস কে সমর্থন করা নগাঁওয়ের দুজন হিন্দী ভাষী ব্যবসায়ী আসু-র আন্দোলনের পেছনে অর্থ সাহায্য করতে লাগলেন। পরবর্তী কালে আসু-র পেছনে যদথাকা আর এস এসের অলিখিত নির্দেশে অসমের একাংশ হিন্দীভাষী ব্যাবসায়িরা বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনে অর্থ সাহায্য করেছেন বলে জানা গেছে। অবশ্য এ কথা ২০১৫ সালে কলকাতায অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রকারান্তরে মোহন ভাগবত বলেছেন বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৮০ সাল থেকেই বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের পরিবর্তে বাংলাদেশি বহিষ্কার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিলো। যার ফলস্বরূপে, ১৯৮৩ সালে নেলী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
এছাড়া, ১৯৮০ সালে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী পুনর্বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অসমে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেন। যদিও তার আগে তিনি মণিপুর গিয়ে আক্রান্ত হন। রাজনৈতিক দলের উস্কানি তে স্থানীয় মানুষেরা তাঁকে ঢিল ছুঁড়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিলো। এ সংক্রান্ত একটি মামলাও হয়েছিলো মণিপুর সেসন কোর্টে। আনোয়ারা তাইমূর তখন মেধাবী অ্যাডভোকেট আব্দুল মুহিব মজুমদার কে নিয়ে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছিলেন। প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল মুহিব মজুমদার তখন ইন্দিরা গান্ধীর এই মামলার ওকালতি করে জয়ী হন।
প্রয়াত আব্দুল মুহিব মজুমদার ১৯৭৮ সালে মুসলিম লীগের রাজ্য সভাপতি হন। প্রকৃতার্থে মুহিব মজুমদার-ই অসমে মুসলিম লীগের সংগঠন শক্তিশালী করেছেন। সে বছর হাইলাকান্দি বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র তিনশো ভোটে পরাজিত হন। প্রয়াত মইনূল হক চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বনিবনা ছিলো না। অবশ্য জানা মতে, রাষ্ট্রপতি শাসন কায়েম করার পর মুহিব মজুমদার কে অসমের অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আইনমন্ত্রী হন। তিনিই আইএমডিটি আইনের ড্রাফট করেছিলেন।
অসম আজ নিঃসন্দেহে ভারতের অঙ্গরাজ্য। অসম কে পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে না দিয়ে অসম কে রক্ষা করেছিলেন মুহিব মজুমদারের বাবা আব্দুল মতলিব মজুমদার। তিনি ১৯৩৮ সাল থেকে হাইলাকান্দির বিধায়ক ছিলেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অসমের মন্ত্রী ছিলেন। রেফারেণ্ডামের সময় আব্দুল মতলিব মজুমদারের একটি ভোটে অসম পাকিস্থানে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পরিবর্তে ভারতে থেকে গেছে বলে জানা গেছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর দিয়ে বয়ে চলা স্রোতে ভেসে আজ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের বাংলাদেশি আখ্যায়িত করেছে শাসক বিজেপি দল।
অসমের বিধানসভা কেন্দ্রের সীমা নির্দ্ধারণ ( Del imitation) সম্পর্কীয় মামলা সুপ্রীম কোর্টের খণ্ড বিচারপীঠে পরবর্তী শুনানির দিন আগামি ১০ অক্টোবর। আগামি ৩১ অক্টোবর সোমবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA ) সম্পর্কীয় মামলার শুনানী অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি আগামি ১লা নভেম্বর নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষের তারিখ (Sec. 3 and 6 (A) সম্পর্কীয় মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে সুপ্রীমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে। হিন্দু মুসলিম মিলে বাঙালিরা এক মঞ্চে এসে আইনী লড়াই করা টা সময়ের আহ্বান।








কোন মন্তব্য নেই