Header Ads

একজন অসাধারণ মানুষের অসাধারণ কাহিনী



১৯৬১ সাল। ইয়োরোপ। স্কটল্যান্ডের এডিনবরা। একটা নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নিলো একটি শিশু। বাবা-মা নাম রাখলেন- স্কট নিসন। আটপৌরে একটা পরিবার, খাওয়াদাওয়া আর বেঁচে থাকাতেই সীমাবদ্ধ। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই জীবনে কোনো। নিসন বড়ো হতে থাকে। মেধাবী নয় ছেলেটা। এমন কোনো গুণও নেই। আর দশটা দরিদ্র শিশুর মতোই সম্ভাবনাহীন একটা জীবনের সূচনা।

নিসনের বয়স যখন পাঁচ বছর, বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ছাড়বেন, ভাগ্যান্বেষণে। তাঁরা পাড়ি জমালেন পৃথিবীর উল্টোপিঠ অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে, সপরিবারে।

অস্ট্রেলিয়ায় স্থির হলেন নিসনরা। স্থানীয় একটি স্কুলে ক্লিনারের চাকরি পেলেন মা, বাবা জোটালেন প্রতিরক্ষা বিভাগে। নিসনকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো স্কুলে।

দীর্ঘ ১২ বছর স্কুলে পড়াশোনা করেও নিসনের একটি সনদ যোগাড় করা সম্ভব হলো না, এতোটাই মেধাহীন ছিলো ছেলেটার একাডেমিক ক্যারিয়ার। ১৭ বছর বয়সে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হলো তাকে। ড্রপ আউট। বহু বছর পরে নিসনের স্মৃতিচারণ- "ফালতু একটা ছাত্র ছিলাম আমি। কিছুতেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারতাম না। আমি নিশ্চিত, আজকের এই একবিংশ শতকে হলে আমি নির্ঘাত ড্রাগ এডিক্ট হয়ে যেতাম, নষ্ট হয়ে যেতাম। অনিয়ন্ত্রিত অস্থিরতায় ভুগতাম আমি, এবং ইচ্ছে করতো পালাই, ঘুরে বেড়াই, জগত দেখি। সৌভাগ্যবশত, আমার এ-ব্যাধির কোনো ওষুধ ছিলো না ওসময়, এবং আমি ড্রপ আউট হয়ে গেলাম।"

একাডেমিক সার্টিফিকেট না-থাকায় কোথাও চাকরি পেলো না ছেলেটা। সে এক দুর্বিষহ বেকার জীবন! শেষমেশ অস্ট্রেলিয়ার 'ক্রনিক্যালি আন-এমপ্লয়েড' ক্যাটাগরির বেকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে হলো তাকে। এদিকসেদিক ছোটাছুটি, একটা কাজ, একটা কিছু উপার্জনের পথ, জীবিকা। ছোটখাটো, খণ্ডকালীন, যা পাচ্ছিলো, করছিলো। এভাবেই একদিন সরকারি একটি প্রোগ্রামের দেখা পেলো যুবক নিসন। প্রোগ্রামটি ছিলো এলাকায়-এলাকায় গিয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র প্রদর্শন। কাজটায় ঢুকে গেলো সে, প্রজেক্টর-কর্মী হিসেবে। শুরু হলো তার প্রথম স্থায়ী চাকরি। দায়িত্ব- রাতে প্রজেক্টর নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছুটে চলচ্চিত্র দেখানো, আর দিনের বেলায় অফিস ও মার্কেটিং সহকারীর দায়িত্ব পালন। দিন যায়, বছর ফুরায়। ধীরেধীরে, ফিল্ম প্রমোটার হলো যুবক, তারপর ফিল্ম বায়ার। অবশেষে, একদিন 'টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স, অস্ট্রেলিয়া'র ডিস্ট্রিবিউশন শাখার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে চেয়ারে বসলেন এক লোক, স্কট নিসন। সেটা ১৯৮৬ সাল।

কেটে গেলো সাতটি বছর। ১৯৯৩ সালে, তাঁর পেশা তাঁকে নিয়ে গেলো সুদূর মার্কিনমুল্লুকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস। ওখানে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান 'টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স ইন্টারন্যাশনাল'-এর মূল কার্যালয়ে মার্কেটিং একজিকিউটিভ হিসেবে আরম্ভ করলেন কাজ। এবং, ঠিক ২০০০ সালে এসে, স্কট নিসন হয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট। যে প্রযোজনা সংস্থা থেকে একে-একে মুক্তি দিলেন 'ব্রেভহার্ট', 'টাইটানিক', 'এক্স ম্যান', 'আইস এইজ', 'স্টার ওয়ার্স' সহ জগত দুমড়ে দেওয়া চলচ্চিত্রগুলো!

২০০৩ সালে সফল মানুষটিকে অকল্পনীয় অংকের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি দিয়ে নিয়ে গেলো প্রযোজনা সংস্থা 'সনি পিকচার্জ'।

এ-ই কি রূপকথা? দারিদ্র‍্যের তলানি থেকে স্বীয় ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ মেধার জোরে আর্থিক সচ্ছলতার শিখরে উঠে যেতে পারার সাফল্যই কি জীবন? না, আমি এই রূপকথা শোনাতে লিখছি না এই কাহিনী। আমি আপনাদের নিয়ে যাবো সম্পূর্ণ অভাবিত একটি প্রকোষ্ঠে! যেখানে পৌঁছে, নিসন বলেছিলেন- "এইতো জীবন।" আসুন, মানবেতিহাসের সফলতম মানুষদের অন্যতম স্কট নিসনের রূপকথার সত্যরূপ দেখে আসি।

২০০৩ সাল। এশিয়ার দরিদ্র দেশ কম্বোডিয়ার রাজধানী নম ফেন। প্রায় নব্বই বছর বয়সী এক কম্বোডিয়ান বৃদ্ধা বিখ্যাত হলিউড-প্রযোজক স্কট নিসনের হাত ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সনিতে নতুন চাকরিতে ঢোকার কয়েক মাস পরে, সোয়া এক মাসের ব্যক্তিগত অবকাশ যাপনকালীন এশিয়া সফর করছেন ঋষি দালাই লামা'র ভক্ত নিসন। কম্বোডিয়ার রাজধানীতে নেমেই তাঁর হঠাৎ ইচ্ছে হলো প্রথমেই এদেশের দরিদ্রতম এলাকাটি দেখবেন তিনি। কেনো হলো, আজও জানেন না নিসন! পথের পাশের বৃদ্ধাটিকে জানালেন তিনি ইচ্ছেটির কথা, দোভাষীর মারফতে। এবং তাঁরা এগুতে আরম্ভ করলেন। খানিক পরে একটি ময়লার বিশাল ভাগাড়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা, পেছনে স্কট নিসন। স্টিয়ুং মিনশে, নম ফেনের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা। প্রায় ১৮ একর এলাকা জুড়ে ময়লার ভাগাড়, লোহা-টিনের স্ক্র‍্যাপের ভাগাড়! আর, সেখানে ময়লা ঘাঁটছে, কীসব বের করে আনছে, দলেদলে অর্ধ-উলঙ্গ, উলঙ্গ, নারী-শিশু! কম্বোডিয়ার মারাত্মক উচ্চতাপমাত্রার সাথে ভাগাড়-পচার মিথেন গ্যাস যুক্ত হয়ে স্তুপটিকে আক্ষরিক অর্থেই নরকে পরিণত করেছে! দাউদাউ লেলিহান উনুন যেনো! নিসেনের ভাষায়- "ওই তাপমাত্রা, আমি বোঝাতে পারবো না আপনাদের কাউকে!" দৃশ্যটি তাঁকে এমনই ধাক্কা দিয়েছিলো, যে, আবচেতনেই ছুটে যান তিনি, বিহ্বল! দেখেন, সামনেই, তিনটি শিশু নুয়ে আছে ময়লার উপরে। খাওয়ার জন্য কিছু খুঁজছে তারা, খাচ্ছেও কীসব, কুড়িয়ে! বিত্তশালী স্কট তাকিয়ে আছেন; তিনটি শিশুই নুয়ে আছে মাথার ভারে, কঙ্কালসার, যেন তিনটি জ্যান্ত লাশ! জীবনের প্রারম্ভেই দারিদ্র্য চেনা, যৌবনে বেকারত্বের বেদনা বোঝা, তৎকালীন সময়ের অন্যতম বিশ্ব-ধনী নিসন, নিজের অজান্তেই হাত রাখলেন শিশু তিনটির দেহে, একে-একে! তিনজনেরই ছোট্ট দেহ তিনটি, পুড়ে যাচ্ছে তীব্র জ্বরে! বৃদ্ধা জানালেন- "টাইফয়েড।" ওসময়েই, সেলফোনটি বেজে উঠলো নিসনের। রিসিভ করলেন। ফোনের ও-প্রান্তে, তখনকার একজন প্রখ্যাত অভিনেতা, যিনি রেগে আছেন তাঁর জন্য পাঠানো প্রাইভেট জেট বিমানটিতে পর্যাপ্ত বিলাসী সুযোগসুবিধা না-থাকায়। "আমি এইসব অনুপযুক্ত বাহনের মানুষ নই"- অভিনেতার অভিযোগ।

"ওই মুহূর্তেই, আমি উপলব্ধি করলাম, সনি পিকচার্স-এর প্রেসিডেন্টশিপ পদ থেকে পদত্যাগ করার সময় হয়ে গেছে আমার। এ-জীবন আমার জন্য নয়, আমি তো এসব অচিন মানুষের জন্য জন্মিনি! আমি জন্মেছি আমার মতোই মানুষদের জন্য, নিঃস্ব মানুষদের জন্য। বিত্ত ছাড়া, আমি তো নিঃস্বই!" এক নিমিষেই স্কট নিসন ছেড়ে দিলেন তাঁর মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেতনের হলিউডি চাকরি। বেচে দিলেন পোরশে, ইয়ট, বাড়ি। এসবের জন্য সময় লাগলো কয়েক মাস। অবশেষে, ২০০৪ সালে, নিসন চলে এলেন কম্বোডিয়ায়, একেবারে।

নম ফেনের নতুন বাড়িতে বসে, স্কাইপিতে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের জানিয়ে দিলেন তিনি- "আমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার গত এক বছরের দোদুল্যমানতা থেকে মুক্তি মিললো অবশেষে। আমি কম্বোডিয়ায় স্থির হচ্ছি। জীবনের সমস্ত গারবেজ আমি বেচে দিলাম।" অত:পর, স্কট নিসন, আরম্ভ করলেন তাঁর রূপকথার যাত্রা।

নম ফেন-এর ময়লার ভাগাড় থেকে ভাগাড়ে ছুটলেন তিনি, হতদরিদ্র মানুষদের বিবাহোৎসব, সৎকারকর্ম, ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যাওয়া আরম্ভ করলেন, উদ্দেশ্য- ওখানকার পরিবেশ বোঝা, দুঃখ অনুধাবন করা। আর, খুঁজে-খুঁজে নিয়ে আসতে লাগলেন ওসব হতদরিদ্র পরিবারের, আশপাশের, পরিত্যক্ত শিশুদের। পরিবারের দারিদ্র‍্যের কারণে পরিত্যক্ত, স্বামী দ্বারা বিতাড়িত হয়ে বা বৈধব্যের কারণে অন্য স্বামী গ্রহণ করায় নতুন পরিবারে ঠাঁই না-হওয়ায় পরিত্যক্ত, দলেদলে শিশু। অনাহারী, মুমূর্ষু, পথশিশু। হায়! ২০০৪ সালে, এভাবেই, ৪৫টি শিশুকে নিয়ে, আরম্ভ করলেন তিনি একটি অলাভজনক সহায়তা প্রতিষ্ঠান, আজকের বিশ্বখ্যাত 'ক্যাম্বোডিয়ান চিল্ড্রেন ফান্ড'। যে ফান্ড এখন হাজারে-হাজারে শিশুকে শিক্ষা, আহার, স্বাস্থ্য, পরিধেয় যোগান দিয়ে চলেছে। জীবনে উপার্জিত শেষ কপর্দকটিও ঢেলে দিলেন তিনি পৃথিবীর মানুষের চোখের আড়ালে ধুঁকেধুঁকে মরতে থাকা সম্পূর্ণ অনাত্মীয় শিশুগুলোর জীবন-রক্ষায়।

কম্বোডিয়া জুড়ে আজ স্কট নিসনের 'ক্যাম্বোডিয়ান চিল্ড্রেন ফান্ড'-এর পরিচালিত দুই শতাধিক ইন্টারকানেক্টেড প্রজেক্ট রয়েছে। যেগুলোর কাজ হচ্ছে- শিশুস্বাস্থ্যসেবা প্রদান, শিশুপালন কার্যক্রম, শিশুশিক্ষা প্রদান, শিশুর পরিবারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সেবা প্রদান। প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক খরচায় ৩ হাজার করে শিশুকে সহায়তা প্রদান করে তাঁর ফাণ্ড। তাঁর সহায়তাপ্রাপ্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন হাই স্কুল থেকে গ্রাজুয়েট করে বর্তমানে কলেজে পড়ছে; বহু শিশু উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন উচ্চপদে চাকরি, ব্যবসা, সামাজিক কার্যক্রম, ইত্যাদিতে জড়িত আছে।

ইয়োরোপের দরিদ্র একটি পরিবারে জন্মেছিলেন স্কট নিসন। ঝাড়ুদারের পুত্র। পরিশ্রম ও লক্ষ্যভেদী জেদের জোরে হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সফল ও ধনী ব্যক্তিতে। বয়স ও ক্ষমতা ও বিত্তের সেরা সময়ে এসে, পশুর জীবন যাপন করা কয়েকটি শিশু দেখে ফেলেছিলেন তিনি; তাঁর মনে হয়েছিলো- জীবন কী? কেনো এই গোল গ্রহটির এক পিঠে বিলাসের উচ্ছিষ্ট, অপর পিঠে তিলেতিলে মরতে থাকা কঙ্কালসার শিশু? সমস্ত অর্জন বিকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি এই শিশুদেরকে দু'বেলা একমুঠো খাওয়ানোর, বিদ্যায় মানুষ করে তোলার, বুকফাঁড়া ইচ্ছেয়। এদের দিকে তাকিয়ে সংসারই করা হলো না মানুষটার। এবং, এভাবেই, অবশেষে তিনি পুনরায় হয়ে গেলেন কপর্দকহীন মানুষ; বিত্তহীন সেই শিশু। বিত্তহীন? বিত্ত কাকে বলে? দরিদ্র নম ফেনের রাস্তায়-রাস্তায় একটি শাদা মানুষকে হাঁটতে দেখবেন আপনি আজও। যে-মানুষটি একদিন তিনটি শিশুর বেরিয়ে আসা পাঁজর দেখে ডুকরে উঠেছিলেন। কী খোঁজেন তিনি? তিনি জীবনের অর্থ খোঁজেন।

রূপকথা কখনো-কখনো, মানুষের সুন্দরতম কল্পনার চেয়েও অপরূপ!

শেষ করি মানবোত্তম স্কট নিসনের ভাষায়- 

"জীবনে এমন একটি মুহূর্ত আসবে, আপনার ভেতরের কেউ আপনাকে রক্তাক্ত করতে থাকবে নিরন্তর, মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়ার তাগিদে। ওই মুহূর্তটিতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে- আপনি কোন্ পথে যাবেন।

এক পর্যায়ে আপনি এতো উপার্জন করতে আরম্ভ করলেন যা কখনো ভাবতেই পারেননি যে সম্ভব হবে। আপনি এমনভাবে জীবন যাপন করতে লাগলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছে যা শুধুই কল্পনা। আমি যতো কিনতে আরম্ভ করলাম, গাড়ি থেকে বাড়ি, জমি থেকে ইয়ট, ততোই আমি উপলব্ধি করছিলাম- এসব তো একধরণের মিথ্যেই! আমি আমার মৃত্যুশয্যায় এই অনুভূতি নিয়ে শুতে চাই না, যে, আমার জীবনটা কাটিয়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে, আমার সমাজে, আমার একটি সফল ক্যারিয়ার ছিলো, আমি ধনী ছিলাম, অথচ, আমার চারপাশের মানুষেরা খেতে পায়নি দু'বেলা, বেঁচে ছিলো 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.