এই মহাদেশের মানুষ,একই চেহারা,চাল চলনকিন্তু এত বিভাজন কেন ?এত হিংসা কেন প্রশ্ন তসলিমা নাসরিনের
তসলিমা নাসরিন ❤️ লিখেছেন উপমহাদেশের কোনও অঞ্চলেই হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান দেখতে আলাদা নয়। সবাই একই রকম দেখতে। পূর্বনারীপুরুষ এক হলে এ-ই হয়। চেহারায় কোনও ফারাক থাকে না। অঞ্চল ভিত্তিক পার্থক্য থাকে বৈকি, কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের কারণে কোনও পার্থক্য থাকে না বললেই চলে। বাঙালি হিন্দু মুসলমান দেখতে যেমন এক, মালায়ালি বা তামিল হিন্দু মুসলমান দেখতেও এক। মধ্য প্রদেশের ভানোয়ারলাল জৈন আর মোহাম্মদ জামিলও দেখতে এক। সে কারণেই মধ্যপ্রদেশের দিনেশ কুশওয়াহা নামের এক লোক ভানোয়ারলালকে মোহাম্মদ ভেবে নির্যাতন করেছে, নির্যাতন করতে করতে তাকে মেরেই ফেলেছে। দিনেশ কুশওয়াহারের যে প্রচন্ড ঘৃণা মুসলমানদের ওপর, সেই ঘৃণা আমি আরও অনেক হিন্দুর মধ্যে দেখেছি। বহুকাল আমি ভারতবর্ষে আসছি, বাস করছি, একসময়ে নির্ভয়ে ধর্মের এবং কুসংস্কারের সমালোচনা করেছি। কিন্তু কোনওদিন এত তটস্থ হয়ে থাকিনি। আজকাল হিন্দুদের কিছু কুসংস্কার, যেসব কুসংস্কার অধিকাংশ হিন্দুই মানে না– সেসব নিয়েও কিছু বলার আগে দু’বার ভাবতে হয়। লক্ষ্য করেছি কিছু হিন্দু অবিকল মুসলমান মৌলবাদির মতো অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। অথচ হিন্দুদের চিরকালই ধর্ম সম্পর্কে উদারই ভেবে এসেছি। যে কেউ যে কোনও ভগবানকে পুজো করতে পারে, না করলেও ক্ষতি নেই, এমনই যখন সমাজ, সেই সমাজে মৌলবাদী তো জন্ম নেওয়ার কথা নয়। যখন গরুর মাংস খায় বলে মুসলমান যুবকদের পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরে ফেলে হিন্দু মৌলবাদিরা, তখন ভয় হয়, আমিও তো গরুর মাংস খাই, ভারতে না খেলেও ভারতের বাইরে তো হরদমই খাই। তাহলে কি ওরা আমার গা থেকেও কোনওদিন গরুর মাংস খাওয়ার গন্ধ পাবে, এবং আমাকেও একদিন পিটিয়ে মেরে ফেলবে?
জ্ঞানব্যাপী মসজিদের ওযুখানায় শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া গেছে, সুতরাং এটি আগে মন্দির ছিল, মন্দির ভেঙ্গে জ্ঞানব্যাপী মসজিদ করেছেন সম্রাট ঔরঙ্গজেব — এই তথ্য কিছুদিন আগে সামনে এসেছে। অবশ্য এ নিয়ে মতান্তর আছে। কেউ বলছেন, ওটি শিবলিঙ্গ ছিল না, ওটি ছিল ফোয়ারা। কিন্তু কী করে প্রমাণ হবে ওটি কী ছিল? সুপ্রীম কোর্টের ওপর সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব পড়েছে। একদিক থেকে ভালো, কোনও গোষ্ঠীর ওপর দায়িত্বটি পড়েনি। সুপ্রীম কোর্ট যে কোনও গোষ্ঠী বা সংগঠনের চেয়ে, এমনকী সরকারের চেয়েও, দেখা গেছে, বেশি নিরপেক্ষ। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙেছিলেন ঔরঙ্গজেব, এ কথা অনেকেই জানে। তিনি যদি হিন্দু বিদ্বেষের কারণে ওটি ভেঙে থাকেন, তাহলে, কেউ কেউ প্রশ্ন করছে, অন্য মন্দিরে দান কেন করতেন তিনি? ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকি লিখেছেন, ঔরঙ্গজেব শুধু মন্দির ধ্বংস করেননি, কিছু মন্দিরে দানও করেছেন। ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রদীপ কেশারবানি লিখেছেন, ঔরঙ্গজেব সোমেশ্বর মহাদেব মন্দির, উজ্জয়নের মহাকালেশ্বর মন্দির , চিত্রকূটের বালাজি মন্দির, গৌহাটির উমানন্দ মন্দির, এমনকী দক্ষিণ ভারতেরও কিছু মন্দিরে দান করেছেন। দান যাঁরা করেন, তাঁরা ভাঙেন কেন? ভাঙার পেছনে ইতিহাসবিদরা বলেন মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। কেউ কেউ ভেঙেছেন লুটপাটের উদ্দেশে। কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হর্ষ তো বৌদ্ধ মন্দির এমনকী হিন্দু মন্দিরও ধ্বংস করেছেন। মুসলমান মাত্রই মন্দির ধ্বংস করেছেন, হিন্দু মাত্রই মন্দির রক্ষা করেছেন, তা সব সময় ঠিক নয়।
যা বলছিলাম, উপমহাদেশের হিন্দু মুসলমান দেখতে একই রকম। তাই বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরি যখন প্রকাশ করেন তিনি হিন্দু, তাঁরই কিছু মুসলমান ভক্ত তখন বিস্মিত হয়, বিমর্ষ হয়। চঞ্চল চৌধুরিকে তখন আর অভিনেতা হিসেবে নয়, হিন্দু হিসেবে, বিধর্মী হিসেবে দেখতে শুরু করে। ভালোবাসার বদলে অসন্তোষ আর অবজ্ঞা ছিটকে বেরোয়। হিন্দুর প্রতি মুসলমানের ঘৃণা, এবং মুসলমানের প্রতি হিন্দুর ঘৃণা এত চরমে উঠেছে যে আমার বড় আশঙ্কা হয়। এই ঘৃণার শেষ কবে, জানতে ইচ্ছে করে। হিন্দুদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, কুতুব মিনারের তলায় মন্দির আছে, তাজমহলের তলায় মন্দির আছে, সেগুলোও তাদের ফেরত চাই। কেউ আবার এও বলছে সব মসজিদকেই মন্দির করে ফেলা হবে, এবং সব মুসলমানকেই ভারত থেকে তাড়ানো হবে। ওদিকে পাকিস্তানে তো হিন্দু মেয়েদের অনেককেই তুলে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছে মুসলমান লোকেরা। বাংলাদেশ থেকে অনেক হিন্দুই মুসলমানের ভয়ে দেশ ত্যাগ করছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় ভারতের মুসলমানরা হয়তো দেশভাগের সময় ভুলই করেছিল পাকিস্তানে চলে না গিয়ে। তাদের বংশধরদের এখন রাস্তাঘাটে জয় শ্রী রাম বলে নির্যাতন থেকে বাঁচতে হয়, গরুর মাংস কখনও খায় না বলে ঘোষণা দিয়ে পার পেতে হয়, হিন্দু মেয়েকে বা ছেলেকে ভালোবাসলেও বিয়ে করা থেকে বিরত থাকতে হয় কারণ বিয়ে করলে লাভ জিহাদের অপরাধে হয়তো খুন হতে হবে। ওদিকে বাংলাদেশ থেকেও হয়তো সব হিন্দুরই ভারতে চলে আসা উচিত ছিল সাতচল্লিশেই। সেই তো আসতে হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে। জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে কজন হিন্দু বাংলাদেশে বাস করতে পারছে! লক্ষ করেছি আমার কিছু বাংলাদেশি হিন্দু বন্ধু তাদের পুত্র কন্যার নামে কোনও পদবী যোগ করেনি। পদবীবিহীন বাংলা নাম হিন্দু আর মুসলমানকে আলাদা করতে পারে না। নিরাপত্তার জন্য যদি পদবী ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হয় তাদের, নিশ্চয় অনুমান করতে পারি কী ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তারা।
এই উপমহাদেশ ভাগ হলো হিন্দু মুসলমানে হিংসে দ্বেষ ঘৃণা বন্ধ হওয়ার জন্য। বন্ধ তো হয়নি, বরং দিনে দিনে তা বেড়েছে। মৌলবাদ যত বাড়ে, ঘৃণা তত বাড়ে। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায় সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর কোনও না কোনওভাবে নির্যাতন চালিয়েই যাচ্ছে। তবে সম্প্রদায়ের সকলে নির্যাতন চালায় না। সব সম্প্রদায়েই আছেন উদার, নীতিবান, দাঙ্গাবিরোধী, ঘৃণাবিরোধী, অসাম্প্রদায়িক মানবিক মানুষ। এঁরা আছেন বলেই এখনও আশা জাগে। এখনও ভরসা পাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যখন সংখ্যালঘু হিন্দুর নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় নামে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু যখন সংখ্যালঘু মুসলমানের পক্ষে স্লোগান দেয়, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না। যে মানুষ নিজের ধর্মগোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে অন্য ধর্মগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে, তারা নমস্য নয়। নমস্য তাঁরাই, যাঁরা নিঃস্বার্থ।
মন্দির মসজিদ কি সত্যিই এই একবিংশ শতাব্দিতে খুব প্রয়োজন? বুদ্ধিমান মানুষেরা কাল্পনিক ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার ঘরবাড়িকে অর্থাৎ প্রার্থনালয়কে জাদুঘর বানায়, আর গড়ে তোলে বিজ্ঞান আকাডেমি, ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়াম, আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, আধুনিক হাসপাতাল, গড়ে তোলে সবার জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্য প্রকল্প, দরিদ্র আর ধনীর ব্যবধান কমিয়ে ফেলার প্রকল্প। ধর্ম আর কুসংস্কার নিয়ে পড়ে থাকলে সমাজকে সভ্য করা যায় না; নারীর সমানাধিকার, মানবিকার, বাক স্বাধীনতা সব মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।
সেদিন জ্ঞানব্যাপী মসজিদ নিয়ে কিছু মন্তব্য করার জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রতনলালকে গ্রেফতার করা হলো। তিনি যা লিখেছিলেন সামাজিক মাধ্যমে, তা নাকি হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। অধ্যাপক রতনলাল জামিন পেয়েছেন। পাকিস্তান আর বাংলাদেশেও মুসলমান মৌলবাদিরা তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে এই অভিযোগ করে ধর্মান্ধতাবিরোধী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ে। দেশছাড়া করে ছাড়ে। গোটা উপমহাদেশেই যে বাকস্বাধীনতাবিরোধী পুরোনো ব্রিটিশ আইনটি আজও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে , সেটির অবলুপ্তি দরকার। এবং নতুন করে জারি হওয়া আরও কতক বাকস্বাধীনতাবিরোধী ডিজিটাল আইনেরও অবলুপ্তি দরকার।
বাক স্বাধীনতা গণমাধ্যমে কতটুকু আছে, তা ফ্রান্সের বিখ্যাত সংগঠন রিপোর্টার্স সান ফ্রন্টিয়ার্স জরিপ করে যা ফল বের করেছে, তা আমাদের মাথা নত করে দেয় লজ্জায়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা প্রেস ফ্রিডম ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের মতো এত বড় গণতন্ত্রের স্কোর ১৫০। গতবছর ছিল ১৪২, এ বছর আরও নিচে নেমেছে। বাংলাদেশের অবস্থান এ বছর ১৬২। দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি আছে পাকিস্তানে (১৫৭), এমনকী, আফগানিস্তানেও (১৫৬)। উপমহাদেশে বাক স্বাধীনতার হাল নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। যে যত বড় গলায় বলুক না কেন, তার দেশ গণতন্ত্রে টইটম্বুর, বাকস্বাধীনতায় টোকা পর্যন্ত পড়ে না, জরিপে কিন্তু সত্যটা বেশরমের মতো বেরিয়ে আসে।
সবচেয়ে বেশি বাক স্বাধীনতা বরাবরের মতোই সভ্য দেশগুলোয়, নরওয়ে ১, ডেনমার্ক ২ সুইডেন ৩, এস্টোনিয়া ৪, ফিনল্যাণ্ড ৫। উত্তর ইউরোপের দেশগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে গণতন্ত্রে, মানবাধিকারে, বাক স্বাধীনতায়। বাক স্বাধীনতা থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে। গণতন্ত্র থাকলে মানবাধিকার থাকে, মানবাধিকার থাকলে বাক স্বাধীনতা থাকে। এসব একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র যেহেতু নড়বড়ে, মানবাধিকার নড়বড়ে, বাকস্বাধীনতা নড়বড়ে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও নড়বড়ে। সে কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জরিপে বাংলাদেশের স্থান এত নিচে, এত পিছে। সভ্য দেশের কাতারে বাংলাদেশ আদৌ কোনওদিন উঠতে পারবে কিনা জানিনা। একটি স্বাধীন সভ্য দেশ পাওয়ার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছিলাম একাত্তরে। তারপর দেশটি কেবল পরাধীনতার দিকেই দৌড়োচ্ছে। পরাধীনতার আমিই তো এক উদাহরণ। আমার গণতান্ত্রিক অধিকার, আমার বাক স্বাধীনতা সব কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। আজ আঠাশ বছর পার হলো, আমার অধিকার আজও লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এই দেশের প্রেস ফ্রিডম আফগানিস্তানের মতো একটি অগণতান্ত্রিক তালিবান-শাসিত দেশের প্রেস ফ্রিডমের চেয়েও নিচে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কোন মন্তব্য নেই