Header Ads

ড্যাডাং মহারাজ ছিলেন কান্দি শহরের অবতার রুপি উলঙ্গ শিশু

  শ্রীধর ব্যানার্জী :কান্দি :মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি শহর বা তার আশেপাশের গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ দোকান এবং অনেক বাড়ির ঠাকুর ঘরে একজন অদ্ভুৎ দর্শন মানুষ পরম শ্রদ্ধার সাথে পূজিত হন। যার পরনে শুধুমাত্র একটি সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। স্থানীয় লোকেরা তাকে ড্যাডাং বাবা বা ড্যাডাং মহারাজ নামেই চেনেন। অনেকে আবার উনাকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবেও পূজো করেন। কান্দী পৌরসভার ছাতিনা কান্দীর কানাময়ূরাক্ষীর তীরে ড্যাডাং মহারাজের সমাধি ও মন্দির রয়েছে।

আজ থেকে প্রায় আটত্রিশ বছর বা তার কিছু বছর আগে কান্দি শহরে ইনি আপন মনে ঘুরে বেড়াতেন, দোকানে দোকানে খাবার চেয়ে খেতেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর ব্যবসায়ীরা লক্ষ্য করলেন যার দোকানে ড্যাডাং বাবা খাবার গ্রহন করেছেন তার দোকানে বিক্রি কয়েক গুন বেড়ে গেছে। তারপর থেকে সবাই তাঁর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতেন ও বহু সাধ্যসাধনা করতেন। কিন্তু ড্যাডাং বাবা শুধুমাত্র একটি বা দুটি দোকান থেকেই খাবার নিতেন। কেউ কোনো ভালো জামাকাপড় পড়িয়ে দিলেও গায়ে রাখতেন না। সঙ্গে সঙ্গে না হলেও কিছুদূর যাবার পরই স্যান্ডো গেঞ্জীটা ছাড়া সবকিছুই শরীর থেকে খুলে ফেলে দিতেন। এতে উনিও লজ্জা পেতেন না বা আমরাও ( সাধারন জনগণ) লজ্জা পেতাম না।
আসলে উনি হাবা গোবা বা বলা ভালো মুক ও বধির ছিলেন। লোকে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো এবং মাঝেমধ্যে দাঁত বের করে হাসতো। হাতে একটা কাঁসর বাজানোর মতো লাঠি থাকতো‌। মনে মনে খুব আনন্দ পেলে ঐ লাঠি টা দিয়ে নিজের পেট বাজাতো। পথে-ঘাটে, বা রাস্তার ধারে কোনো বাড়ির বারান্দায় রাত কাটাতো।

রিক্সাওয়ালারা শুধুমাত্র তাকে একবার রিকশায় চড়ানোর জন্য হাপিত্যেস করতেন।কারন ড্যাডাং বাবাএকবার চড়লে তাদের আয়ের পরিমান কয়েকগুন বেড়ে যেত।এছাড়াও অনেক মানুষ তার হাতের স্পর্শ পেলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন। আমরা যখন ছোটো ছিলাম, খেলাচ্ছলে নিজেদের পিঠ বাড়িয়ে দিতাম ওঁর হাতের মার বা স্পর্শ খাবার জন্য। পরীক্ষা দিতে যাবার দিন চারিদিকে চোখ মেলে থাকতাম যদি একবার তাঁর দেখা মেলে আর তাতেই কিস্তীমাত হয়ে যেতো। যেদিন ওঁর দেখা পেতাম যেকোনো ভাবেই হোক পরীক্ষা ভালো হয়ে যেতো। এহেন ড্যাডাং বাবার গল্প সুদূর জলপাইগুড়ি পর্য্যন্ত যে বিস্তৃত ছিল তা আমার জানা ছিল না। কারন ১৯৯০ সালে আমি যেদিন ময়নাগুড়ি বি ডি ও অফিসে প্রথম সরকারী কাজে যোগদান করতে যায়, বি ডি ও সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হওয়া মাত্র উনি যখন জানলেন আমার আসল বাড়ি কান্দি, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন- সঞ্জয়, তোমাদের ড্যাডাং বাবা কেমন আছে? অবাক হয়ে প্রত্যুত্তরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম-আপনি চিনলেন কেমন করে? উনি তখন বলেছিলেন – আমার বাড়ি বালুরঘাট হলেও,বাবা ব্যাঙ্কে চাকরী করার সুবাদে একবার কান্দিতে পোস্টিং পেয়েছিলেন। বাবা-মা বিশ্রাম তলার কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন। আমি তো নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তাম, ছুটির সময় তোমাদের কান্দিতে মা-বাবার কাছে চলে আসতাম। তাই তখনই দেখেছি।

বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ওঁর সম্বন্ধে তেমন কিছু না জানলেও কান্দি শহরের পুরনো লোকজন প্রায় প্রত্যেকেই ড্যাডাং বাবার বিষয়ে অবগত। তারা তাঁকে অবতার জ্ঞানে পরম শ্রদ্ধার সাথে পূজো করেন। বাংলা ১৩৮৯ সালের কার্তিক মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ঊনত্রিশে কার্তিক’১৩৮৯ বা ১৬ ই নভেম্বর’১৯৮২ সালের মঙ্গলবার উনি সজ্ঞানে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে সাধনাচিত ধামে গমন‌ করেন। তাই অগ্রহায়ন মাসের প্রথম দিকে ড্যাডাং বাবার মন্দিরে বিশাল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় ও মেলা বসে। কান্দি শহরের ও পাশ্ববর্তী অনেক গ্রাম থেকে আগত মানুষের ঢল নামে এই সময়। কান্দি শহরের অন্যান্য মেলা ( হোমের মেলা, চড়কের মেলা, রাসের মেলা ) গুলোর মতো এটাও একটা বিখ্যাত মেলায় পরিণত হয়েছে। আর এই মেলায় উদ্দীপনা অবশ্যই মনে রাখার মতো।

মা, বাবা, দাদু, দিদিমা উনারা ওঁর জন্ম সাল সম্বন্ধে কিছু বলতে না পারলেও আমার গৃহ শিক্ষক মাননীয় স্বর্গীয় দুর্গাদাস নাথ মহাশয়ের কাছে থেকে শোনা কান্দি থানার মাধুনিয়া গ্রামের ওলাপাড়ায় জন্ম। জাতিতে হিন্দু। ওদের পরিবারের পেশা ছিল সূত্রধরের। আসল নাম সুবল দাস। আমাদের চুনুরী পাড়া বর্তমানে জেলরোডে আমাদের বাড়ির সামনের বাড়ির এক কাকা মাননীয় বীরেশ্বর সরকার মহাশয়, যাঁর বর্তমান বয়স আশি ছুঁইছুঁই তিনি জানালেন ১৯৬০ সালে কান্দি ছায়াপথ সিনেমা হলের পাশে যে রঞ্জন স্টুডিও ছিল তার পাশে অবস্থিত প্রখ্যাত মিষ্টি ব্যবসায়ী গয়ানাথ মন্ডল মহাশয় যখন উনার বয়স ছিল ষাট বছর তখন তিনি নাকি বলেছিলেন ড্যাডাং এর বয়সের কোনো গাছ পালা নেই। উনাদের জন্ম থেকেই ড্যাডাং বাবাকে এমনই দেখে আসছেন। বীরেশ্বর কাকা আরও জানালেন ১৯৬২ সালে উনি যখন সবে বি এ পাশ করেছেন তখন হঠাৎ ই রাস্তায় ড্যাডাং বাবার সাথে দেখা। আর ড্যাডাং বাবা উনাকে পিঠে জোরে একটা থাপ্পর মারলেন। তাতেই নাকি কিস্তিমাত হয়ে গিয়েছিল। থাপ্পর খাবার একমাসের মধ্যে বীরেশ্বর কাকা নাকী হাই স্কুলের মাস্টারির চাকরী পেয়ে গিয়েছিলেন। পুরনো দিনের মানুষের কাছ থেকে শুনলে এ রকম অনেক গল্পই বোধ হয় জানা যাবে।

এহেন মানবরূপী অবতার ড্যডাং বাবার কোনো তথ্যই গুগল ড্রাইভে আপলোড হয়নি। তাই ওখান থেকেও ওঁর জন্ম সাল সমন্ধে কোনো তথ্যই পেলাম না।

                          শ্রীধর ব্যানার্জীর কলমে
           মুর্শিদাবাদের কান্দির আশ্চর্য ড্যাডাং বাবা  ।পুনঃপ্রচার:প্রণয় সেন

                             
                                                                                                              গুয়াহাটি  থেকে  সংযোজন :  কান্দি বাসস্ট্যান্ডে পাখ মারার ডোবে    অবতাররূপী  উলঙ্গ  শিশুর এক প্রতিমূর্তি  স্থাপন করা হয়েছে।  ঐস্থানে প্রতিবছর মেলা বসে।  কান্দির   নিস্তরঙ্গ সামাজিক জীবনে ঢেউ তোলার   মধুর স্মৃতি হয়ে আজও  মানুষ মনে রাখে।  বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে  যাকে  বোঝান যাবে না। ( ছবি  পাঠিয়েছেন বিহারের জামালপুর থেকে বিশ্বরূপ সেন )

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.