Header Ads

ভারতে বাঙালিদের মধ্যে নজরুল-জয়ন্তী

প্রশান্ত চক্রবর্তী

কটন বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াহাটি


আজকের দিনে ভারতে বাঙালিদের মধ্যে নজরুল-জয়ন্তী করে কারা? একসময় করত মার্কসবাদীরা। রবীন্দ্রনাথের সাথে সুকান্ত আর নজরুলকে এক সুতোয় গেঁথে "রসুন"-জয়ন্তী করত ওরা। এটা শুরু হয়েছিল~ মুজফফর আহমেদ নজরুলকে হাইজ্যাক করার সময় থেকে। নজরুলকে ওরা পার্টি-কেডার করার মতলবেই ছিল। কিন্তু নজরুল চিরদিন বনের পাখি। আগাপাশতলা রোমান্টিক কিসিমের মানুষ। তাঁকে খাঁচাবন্দী করা বা নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালাই করে বের করা অসম্ভব ছিল। এখন এরা নিজেরাই অস্তিত্বহীন, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি, তাই নজরুল-জয়ন্তী এদের খপ্পর থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছে। 

     ভারতের বাঙালিভুবনে আজকের দিনে কাজী নজরুলকে স্মরণ করে মূলত হিন্দু বাঙালি। ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। তিনি কালী-রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে প্রচুর হিন্দু ধর্মীয় গান লিখেছিলেন বলে নয়। বাঙালি হিন্দু ভুলেই যায়~নজরুল ধর্মীয় পরিচয়ে ইসলামি ঘরানার ছিলেন। বাঙালি হিন্দু কাজি নজরুলকে আসলে অবগাহন করে তাঁর অনন্য সব গান ও কবিতার জন্য। বাঙালি বলে। এই ক্ষেত্রে মোক্ষম কথা বলে গেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর। তিনি লিখেছেন~

      "শ্যামাসঙ্গীত তিনি রচনা করেছিলেন সত্য কিন্তু সে কারণে তাঁকে কালীভক্ত হিন্দু সাধক মনে করার কোনো কারণ থাকেনি এবং হিন্দুরা কোনোদিন নজরুল চরিত্রের সে-ব্যাখ্যাও দিতে চেষ্টা করেননি।"

    ("ধর্ম রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা", 'নজরুল ইসলাম অহিফেন', পৃ. ৭৩)।

    বদরুদ্দীন উল্টোদিকে বলেছেন~বাঙালি সংস্কৃতির(পড়ুন হিন্দু) সাথে যুক্ত থাকার ফলে, নজরুল কর্মজীবনে মুসলমান সমাজে তেমনভাবে ঠাঁই পাননি। মুসলিম সমাজের শরিয়তি কট্টরপন্থীরা নজরুলকে কাফেরদের সাথে ওঠাবসা আর মূর্তিপূজার সংস্কৃতি গানেকবিতায় দেদার চর্চা করায় সুনজরে দেখেনি সমকালে। বদরুদ্দীন লিখছেন~

    "বরং বিপুল অধিকাংশ স্বধর্মীদের দ্বারা তিনি বারবার ধিকৃতই হয়েছিলেন তাঁর স্বাদেশিকতা, প্রগতিশীলতা এবং 'হিন্দুপ্রীতি'-র জন্য।"(পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ ৭৩)। 

     নজরুল জন্মসূত্রে মুসলমান ঘরে বেড়ে উঠলেও মননের দিক থেকে ছিলেন পুরো বাঙালি। জন্মের শেকড়কেও তিনি উপেক্ষা করেননি। অজস্র ইসলামি সাহিত্য তার নজির। কিন্তু পাশাপাশি হিন্দু বা বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতিই তাঁর জীবনের মূল অভিকেন্দ্র ছিল। পারিবারিক পরিবেশ, কর্মজীবনের পরিবেশও এতে সাহায্য করেছে। 

     সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন~সেই সময় নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়াতে ইসলামি ভাষা সংস্কৃতি ততটা গেড়ে বসেনি, যতটা পূর্ববঙ্গে ছিল। স্কুলেও তিনি আরবি-ফার্সি কতটা পেয়েছেন, সে নিয়েও সংশয়। আর এরপর তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান। এবং ওই সময়ই তিনি ইসলামি রসের দুনিয়ায় প্রবেশ করেন~মূলত ইরানের সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। আলীসাহেব বলেছেন~ইরান ও ভারত আসলে একই আর্য সভ্যতার দুই শাখা। সংস্কৃতিগত মিলও প্রচুর। জোর করে ওখানে আরবি চাপিয়ে দেওয়ায় সাহিত্যে যে বিদ্রোহ দেখা দেয়~সেটাই ফিরদৌসি থেকে ওমর খৈয়াম~অজস্র কবির মধ্যে উদভাসিত হয়। আর ইরান কট্টর ইসলামি ছিল না~ছিল ভক্তিমার্গের। পরে যা সুফি ঘরানা নামে সর্বত্র ছড়িয়েছে। নজরুলের গানে কবিতায় ভাবনায় ইরানি ধারার স্রোতই সমধিক। 

    কাজেই নজরুলের 'হিন্দু-ঘেঁষা' মানসপটটির সন্ধান এভাবেই পাওয়া যায়। অনেকেই ভুলে যান~নজরুলের অন্যতম পেশাই ছিল সংগীত। অথচ শরিয়তে সংগীত বা বিনোদন নাকি নিষিদ্ধ। নজরুল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন ছাত্রজীবন থেকেই। শিয়ারশোল রাজ হাই স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল নজরুলের প্রথম সংগীতশিক্ষক। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় জনৈক খান সাহেবের কাছে তালিম নেন। এরপর ঠুংরির রাজা ওস্তাদ জমিরুদ্দিন, গজলের বিখ্যাত শিল্পী উস্তাদ মাস্তান গামা, মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত উস্তাদ মঞ্জু সাহেব, কাদের বক্স, তানসেন ঘরানার উস্তাদ দবির খাঁ, আসফাক হোসেন, উস্তাদ বাদল খাঁ~এরকম সমকালীন বহু বিখ্যাত সংগীতশিল্পীর কাছে তালিম নিয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া~মুস্তাক হুসেন খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, বসির খাঁ, এনায়েত খাঁ, আগ্রার মুস্তারি বাই, মজিদ খাঁ, কেরামত খাঁ...এবং বাইজি ঘরানার হীরা বাই, সুন্দরী বাই প্রমুখ শিল্পীর কাছে নানাসময়ে সংগীতসাধনা করেছেন। ভাবা যায়!!! কে বলে শরিয়তে সংগীত নিষিদ্ধ! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারাটি তো রক্ষা করে গেছেন ইসলামি গুণিজনেরাই।

   নজরুলের নেশাই পরে পেশা হলো। বহু গান পেশাগতভাবে লেখা। এমনকি স্টুডিওতে বসেই। ব্রিটিশ আমলে নিষিদ্ধ মন্মথ রায়ের 'কারাগার'-নাটকের জন্য বহুশ্রুত "তিমির বিদারী অলখ বিহারী কৃষ্ণমুরারী আগত ওই" লিখলেন। ইসলামে মূর্তিসংস্কৃতি নিষিদ্ধ। অথচ নজরুল একের পর এক অমর শ্যামাসংগীত লিখে গেছেন, সমানতালে রাধাকৃষ্ণের গান। যাঁদের নিয়ে লেখা~তাঁরা তো মূর্তি আকারেই বাঙালি সংস্কৃতিতে রয়েছেন। এর কারণ~নজরুল ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বা রিচুয়ালসকে সংস্কৃতি বলেই গণ্য করতেন। অনেকেই জানেন, নজরুলের বাড়ির ভেতরেই ঠাকুরঘর ছিল। সেখানে পুজোআর্চা করতেন তাঁর শাশুড়ি গিরিবালা দেবী। এবং কবি নিজে বাড়িতে ধুতি পরতেন দুভাজ করে। এই তথ্য পাওয়া যায়~নজরুলের পালিতা কন্যা শান্তিলতার লেখায়। ১৯৪২-এ কবি অসুস্থ হন। তাঁকে নিয়ে বায়ু পরিবর্তনে নিয়ে যাওয়া হয় মধুপুরের বাহান্ন বিঘার শ্রীগৌরাঙ্গ ধামে। সেখান থেকে ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে যে চিঠি তিনি লিখেছিলেন~সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা শেষ নেই। আর নজরুলের ওই অসুস্থতার দিনে তাঁর চিকিৎসা ও ভাতার জন্য নিজেই উদ্যোগী হয়েছিলেন উদারচিত্ত শ্যামাপ্রসাদ। বাংলাদেশের "প্রথম আলো" পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেই কথা স্মরণ করা হয়েছে~

    "১৯৪৩ সালে কবির চিকিৎসা ও পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য বাংলার সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে সভাপতি এবং সজনীকান্ত রায়কে সম্পাদক করে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। তবে এ কমিটির নাম নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কেউ একে বলেছেন নজরুল এইড ফান্ড’ (সুফী জুলফিকার হায়দার), কেউবা সেন্ট্রাল নজরুল এইড ফান্ড’ (আনন্দবাজার) আবার দু-একজন বলেছেন নজরুল সাহায্য কমিটি’ (মুজাফ্‌ফর আহমদ)। মুজাফ্ফর আহমদের সূত্রে জানা যায়, এই কমিটি বিভিন্ন সূত্র থেকে তহবিল সংগ্রহ করে এবং প্রতি মাসে কবির পরিবারকে ১৫০ রুপি ভাতা দেওয়া শুরু করে। অবশ্য সুফী জুলফিকার হায়দার বলেছেন, মাসিক ভাতা ছিল ২০০ রুপি।"

    ড. শ্যামাপ্রসাদের প্রতি নজরুলের যে কী অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল এবং শ্যামাপ্রসাদও যে নজরুলকে কতটা ভালোবাসতেন~সেটা নজরুলের ওই চিঠিতেই আছে। নজরুল সব শেষে লিখেছেন~

    "আপনার মহত্ত্ব, আপনার আমার উপর ভালবাসা...আমার অণুপরমাণুতে অন্তরে বাইরে মিশে রইল। আমার আনন্দিত প্রণাম~পদ্ম শ্রীচরণে গ্রহণ করুন।"(১৭-৭-৪২)।

    "পদ্ম-শ্রীচরণ"!! বাঁচোয়া, আজকের দিনে হলে নিন্দুকেরা বলত~শেষে নজরুলও নাগপুর আর পদ্মপার্টিতে যোগ দিলেন!!

•••

   গতকাল থেকেই সারা গুয়াহাটিতে নজরুল জয়ন্তী পালিত হচ্ছে। নাচেগানে কবিতায় সোশ্যাল মিডিয়া ভরা। আজ দিনভর চলবে। এবং এর ১০০ শতাংশ হিন্দু বাঙালিরা করছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে দিন, বরাকের বাঙালি মুসলিম মহল্লায় কি নজরুল জয়ন্তী হচ্ছে?! কোনো মাদ্রাসায় কি আগে কোনো দিন নজরুলকে স্মরণ করা হতো!! এখন হয়? আমার জানা নেই।

•••

   মনস্বী অন্নদাশংকর রায় একটি ছড়াতে লিখেছিলেন~

"ভুল হয়ে গেছে বিলকুল

আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে

ভাগ হয়নি কো নজরুল।"

অন্নদাশংকর, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, এদেশে নজরুলও ভাগ হয়ে গেছেন।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.