Header Ads

আরও দু'দফা ভোট বাকি, অথচ পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়



হাতের কাছে খড়কুটো যা পাওয়া যায় তাকেই নির্বাচনী প্রচার মঞ্চে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাটা নতুন কিছু নয়। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অস্ত্র লাগাতার ব্যবহারের ফলে ভোঁতা হয়ে যাওয়ার পর এখন প্রধান অস্ত্র হিসেবে শেষের তিন দফার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে করোনা উঠে এসেছে বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচার মঞ্চে। এই করোনা পরিস্থিতিকে তৃণমূল নেত্রী সরাসরি বলছেন--'মোদী মেড ডিজাস্টার'! আরও বলছেন 'দিল্লীর দুই গুণ্ডা বাংলায় করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছে' ! বাংলায় করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা বহিরাগতদের জন্যেই বেড়ে গিয়েছে। আরও অনেক অভিযোগে সোচ্চার হচ্ছেন তিনি। করোনা সংক্রমণ যদি 'মোদী মেড ডিজাস্টার' হয় তাহলে দিল্লী-মহারাষ্ট্র-উত্তরপ্রদেশ-গুজরাটের ভয়াবহ সংক্রমণও 'মোদী মেড ডিজাস্টার'। এই রাজ্যগুলিতে নির্বাচন হচ্ছে না--কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যু'র (বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাটে) ভয়াবহতার ছবিটা ঐ সব রাজ্যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সে যাইহোক না কেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন একটি সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা--যাকে উপেক্ষা করা যায় না। নির্বাচনের দিনক্ষণ স্থির হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন শুরু হয়ে গেলে মাঝপথে নির্বাচন বাতিল করা নির্ঘন্ট পরিবর্তন করতে গেলে প্রচুর জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবু পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন তা করতে পারেন কিনা সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু মতামত প্রকাশের অধিকার আমার আছে বলে আমি মনে করছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি--নির্ঘন্ট পরিবর্তন করে নির্বাচনপর্ব কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা গেলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে হয়তো ভালই হতো।

কিন্তু মূল প্রশ্ন সেটা নয়--আসল প্রশ্ন হল--করোনা আবহে নির্বাচনের দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতা-নেত্রীরা জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন কি? মোদী-অমিত-মমতা-সূর্য্যকান্ত-অধীর--এঁরা সবাই তো মানুষ--এবং এঁরা সকলেই তো হাজার হাজার মানুষের সম্মিলনেই বড় বড় রোড-শো পদযাত্রা জনসভা করেছেন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক মনুষ্যগণ জনসভায় মানুষের সামনেই তো বড় বড় ভাষণ দিয়েছেন মাস্ক ব্যবহার না করেই--মঞ্চে প্রয়োজনীয় দূরত্ববিধি না মেনেই ! জনসভায় উপস্থিত মানুষদের কি একবারও বলেছেন--মাস্ক না পরে সভায় আসা যাবে না, দূরত্ব বিধি মেনেই সভায় থাকতে হবে ! না, কেউ বলেন নি। আর বলবেনই বা কেন--মঞ্চের মানুষগুলো মানুষ--আর যারা হাজারে হাজারে সভা উপচে মঞ্চমানুষের ভাষণ শুনতে আসছে তারা মানুষ নয়? তাদের বিবেক বোধ বিবেচনা কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছুই নেই? তাদের আত্মনিরাপত্তাবোধ মঞ্চ থেকে না জাগালে জাগবে না? যদি না জাগে তাহলে যা হওয়ার তাই তো হচ্ছে ! রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা কপ্টার-বিমান-রোডশো-জনসভার জন্য খরচ করছেন--তার একটা ছোট অংশ সাধারণ মানুষদের জন্যে মাস্ক-স্যানিটাইজারের জন্যে কি খরচ করা যেত না? রাজ্যের ক্লাব-পুজো কমিটিগুলোকে হাজার কোটি টাকা খয়রাতি দেওয়া যায়--কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম খরচে গোটা কয়েক অক্সিজেন কারখানা তৈরি করা যেত না? রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে আরও খানিকটা ভদ্রস্থ সমৃদ্ধ করা যেত না? যে কোনো ইস্যুতে কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তোলার নির্লজ্জ অভ্যাস থেকে এ রাজ্য কবে মুক্ত হতে পারবে তা ঈশ্বরই জানেন। কেন্দ্র মানে শুধু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নয়--সকলের প্রতি সম দায়িত্ব পালনের একটি রাষ্ট্রীয় ধাঁচা--দাবি নালিশ ক্ষোভ জানানো যেতেই পারে--কিন্তু 'এলামেলো করে দে মা--লুটেপুটে খাই'-এর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে রাজ্যকে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন সাবলম্বী একটি রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার দায়-ও তো থাকতে হবে--সেটা কি আদৌ আছে? থাকলে তো একটা পরিচ্ছন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও তার প্রায়েগিক কিছু ফল লক্ষ্য করা যেত--যাচ্ছে কি? এরকম প্রশ্ন অনেক রয়েছে সামনে। করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কারণেই। হাজারে হাজারে মানুষ রোডশোগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে--পদযাত্রায় জনসভায় সামিল হয়েছে। চোখের পলকে হাজারে হাজারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে--যতটা পড়েছে এবং পড়ছে তার সঠিক হিসেব আমরা কেউ কল্পনা করতে পারছি না--কেন পারছি না সেটাও কারুর অজানা নয়। তবু মানুষ কেন স্বেচ্ছায় আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে কে জানে !
যাইহোক, এবারে একটু নির্বাচনের কথায় আসা যাক্ ! আমার ফলাফল সংক্রান্ত পূর্বাভাস নিয়ে অনেকেই নানা রকম প্রশ্ন করছেন--কেউ বলছেন আমি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। আমার 'গড়' বা 'দুর্গ' তত্ত্বটি নাকি ঠিক বিজ্ঞান ভিত্তিক নয়। এরকম আরও নানান বিচিত্র মতামত পাচ্ছি আমি। যারা এসব মন্তব্য করছেন তাঁরা ২০১১ থেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন সংক্রান্ত বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাস দেখেন নি বা পড়েন নি। পড়লে অবশ্যই এসব মন্তব্য করতেন না। আমি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই তথাকথিত 'গড়' বা 'দুর্গ' বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা করে চলেছি। ২০১১'র পর থেকে ২০১৯-এর মধ্যে যতগুলি নির্বাচন-উপনির্বাচন (পুর-পঞ্চায়েত সহ) হয়েছে সেই সব নির্বাচনের ফলাফল আমি খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছি--হাজার হাজার বুথে ক্ষমতাসীন দল যেখানে ১০০০-এর মধ্যে ৮০০-৯০০ ভোট পেয়েছে সেখানে বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম প্রার্থীদের ঝুলিতে পড়েছে ০ থেকে ২৫-৩০-এর মধ্যে। এই ছবি বাম-আমলেও অসংখ্য বুথে বুথে দেখা গেছে। এগুলো স্বাভাবিক ভোট নয়--বুথওয়ারি ৬০-৭০% ছাপ্পা ভোট--যেখানে প্রকৃত ভোটারদের কোনো ভূমিকা ছিল না। ফলে একের পর এক কেন্দ্র ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের 'গড়' বা 'দুর্গ' হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। এই 'মিথ' কিন্তু প্রবল ধাক্কা খেল গত লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপি'র তুলনায় তৃণমূলের ম্যানপাওয়ার অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও ভোট মেশিনারি থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার বুথে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় বহু বুথে এজেন্ট বসাতে না পারলেও--মানপাওয়ার বা ভোট মেশিনারি না থাকা সত্ত্বেও বিজেপি একেবারে ১৮-টি আসন ছিনিয়ে নিল তৃণমূলের একচেটিয়া দখল থেকে। এরকমই কিছু হতে চলেছে বলে আমার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল। আমি ফলাফল প্রকাশের পর বুথওয়ারি বিশ্লেষণের মাধ্যমে খুব স্পষ্টভাবেই রীতিমতো বদলে যাওয়া ভোটচিত্রটা দেখতে পেয়েছিলাম। এবারের বিধানসভা নির্বাচনেও খুব বেশি হলেও ৪-৫% বুথে কমবেশি ছাপ্পা ভোট দিতে পারলেও বাকি বুথগুলোতে কমবেশি ৮০-৯০% মানুষ ভোট দিতে পারছে যাদের একটা বড় অংশই গত দশ বছরে বুথমুখো হতে পারে নি। এবারে তারা সেটা পারছে বলেই চতুর্দিকে এত অশান্তি। গোলাগুলি বোমাবাজি হানাহানি খুনজখম ! ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে মারাত্মক একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। বহু 'গড়' বা 'দুর্গাধিপতি' স্পষ্টতই অনুমান করতে পারছেন আসলে কী হতে চলেছে। আজকের ভোটে বহু রথী-মহারথী ও তারকার শারীরিক ভাষা থেকেই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না--তাদের উদ্বেগের গভীরতাটা ঠিক কত ! আবার অন্যদিকে অর্জুন সিং শুভ্রাংশু রায় মুকুল রায়দের শারীরিক ভাষার মধ্যেও যে পজিটিভ ইম্প্যাক্ট প্রতিফলিত হচ্ছিল তা থেকেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না তারা কতটা ভারমুক্ত হয়ে উঠেছেন ! এবারের নির্বাচনের চরিত্রটাই একেবারেই অন্যরকম। আমার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ যে অবাস্তব অন্ধ ভাবাবেগ তাড়িত নয় সে সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই। তাই আজও আমার বলতে দ্বিধা নেই--আমি যা বলেছি তা খুব ভুল কিছু বলিনি !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.