বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

খুব সহজেই বলে দেওয়া যেতে পারতো--তৃণমূল কংগ্রেস জিতলে নিশ্চিতভাবেই মমতা মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা বলা যাচ্ছে না। কারণ, নন্দীগ্রামে যদি মমতা না জিততে পারেন এবং দলও যদি না প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন পায় তাহলে তো কিছুই বলার থাকবে না। কিন্তু যদি এমনটা হয় যে, তিনি জিতলেন না কিন্তু দল জিতে গেল--সেক্ষেত্রে ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগে তিনি কি মুখ্যমন্ত্রী হবেন--নাকি অন্য কাউকে অভিষিক্ত করবেন? সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তিনি বিধানসভায় শুভেন্দু-মুকুলদের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে দিল্লির সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নতুন ভূমিকায় উঠে আসার কথাই ভাববেন। আবার তিনি জিতে গেলেন কিন্তু দল হেরে গেল সেক্ষেত্রেও তিনি বিধানসভায় তাঁরই দলত্যাগী নেতাদের নিয়ন্ত্রিত বিধানসভায় নিছকই বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে নিজেকে আটকে রাখবেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এদিকে ২০০'র কম আসন পেলে তাঁর সরকারের স্থায়ীত্ব নিয়ে তাঁর নিজেরই সংশয়ের কথা তিনি বার বার বলছেন। অনেক 'গদ্দার' দল ছেড়ে চলে গেছে--বাকি গদ্দারদের মধ্যেও অনেকে বিক্রি হয়ে যেতে পারে বলে তিনি প্রকাশ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ! কাজেই তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে ২-রা মে'র আগে নিশ্চিত করে কিছু বলার নেই এই ব্যাপারে।
সংযুক্ত মোর্চা ক্ষমতায় আসছে--এমনটা অতিবড় আশাবাদীও ভাবছেন বলে মনে হয় না। তবে দু'চারজন মন্ত্রী হলেও হতে পারেন যদি ফলাফল ত্রিশঙ্কু হয় এবং তৃণমূলকে সরকার গঠনে সমর্থনের সুযোগ আসে। জোট সরকারের শরিক হিসেবে কয়েকজনকে মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার কথা সংযুক্ত মোর্চা ভাবতে পারে। যদিও এ ভাবনাও আমার হিসেবে আকাশ-কুসুম ভাবনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন বাকি থাকছে বিজেপি। এ রাজ্যে বিজেপি একক শক্তিতেই লড়ছে--এনডিএ'র অস্তিত্ব এ রাজ্যে নেই। সুতরাং ক্ষমতায় এলে তাদের দলের নির্বাচিত বিধায়কদের মধ্যে থেকে্ই একজনকে নির্বাচিত করতে হবে। প্রসঙ্গতঃ এখন আমি যা বলতে চলেছি তার উৎস বা সূত্র সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। এ ব্যাপারে কেউ কোনোরকম প্রমাণ বা লিঙ্ক চাইলে আমি দিতে পারবো না।
ক্ষমতায় এলে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের জন্যে খুব বেশি সময় নেবে না। মোটামুটি বিষয়টি ঠিক করেই রাখা হয়েছে। যতদূর মনে পড়ছে বিজেপি সুষমা স্বরাজ এবং উমা ভারতীকে ছাড়া আর কাউকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করে নি। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে কোনো মহিলাকে এই পদে ভাবা হচ্ছে না। লকেট চট্টোপাধ্যায় জিতলে মন্ত্রী হবেন সন্দেহ নেই। আরও উল্লেখযোগ্য যে দু'চারজন নেত্রী বিজেপিতে রয়েছেন তাঁরাও কেউ মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন না। সর্বভারতীয় দল হিসেবে বিজেপি বা কংগ্রেস বিশেষ কাউকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তুলে ধরে না। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে কাউকে ঘোষণা না করলেও বহু ক্ষেত্রেই বুঝতে অসুবিধে হয় না কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিন্তু বিজেপি'র ক্ষেত্রে অত সহজে বোঝা যায় না। ত্রিপুরার বিপ্লব দেব, উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ কিংবা উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী--সবই চমৎকৃত সিদ্ধান্ত হিসেবে উঠে এসেছে। এ রাজ্যেও তেমনই চমকপ্রদ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হতেই পারে।
মুখ্যমন্ত্রীর তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন রাজ্যসভার সদ্য প্রাক্তন সাংসদ উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর প্রতিনিধি স্বপন দাশগুপ্ত। যদি তিনি তারকেশ্বর থেকে জিতে আসতে পারেন তাহলে তিনিই মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শুভেন্দু এবং মুকুল রায়কে ভাবা হতে পারে। একাধিক উপমুখ্যমন্ত্রীর চল বিজেপিতে রয়েছে। কিন্তু যদি স্বপনবাবু জিততে না পারেন তাহলেই গোল বাধবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাউকে বেছে নেওয়ার প্রশ্নে। এরকম পরিস্থিতিতে সঙ্ঘলবি চাইবে দিলীপ ঘোষকে। কিন্তু যদি মমতাকে হারিয়ে শুভেন্দু জিতে আসেন তখন শুভেন্দুকে নাকচ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে বিজেপি'র পক্ষে। ১৫১ থেকে ১৬০ আসন নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কের সমর্থন থাকবে শুভেন্দু'র দিকেই। মুকুলের দাবিও নাকচ করা খুব সহজ হবে না। সে কথা ভেবেই তারকেশ্বর কেন্দ্র থেকে স্বপনবাবুকে জিতিয়ে আনার প্রশ্নে যা কিছু করণীয় বিজেপি করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রোড-শো জনসভার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে বিরাট জনসভার আয়োজন--কোথাও এতটুকু ফাঁক রাখা হচ্ছে না। কেউ কেউ মিঠুন চক্রবর্তীকেও মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে ভাবছেন বটে--তবে সেটা হতে পারে যদি তৃতীয় নিরপেক্ষ হিসেবে তাঁকে ভাবা হয়। হলেও তা খুব সহজে হবে বলে মনে হয় না। বেশ কয়েকজন এমপিকে বিজেপি এবারে বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী করেছে--যার মধ্যে দু'তিনজন জিতে যাবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে কয়েকটি লোকসভা আসন শূন্য হলে তারই একটিতে মিঠুনকে জিতিয়ে লোকসভায় পাঠানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। শুধু মিঠুন নন--লোকসভার উপনির্বাচনে টিকিট পেতে পারেন সায়ন্তন বসুও।
এখন স্বপন দাশগুপ্তের জয়-পরাজয়ের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বিজেপিকে। তবু মমতাকে হারিয়ে যদি শুভেন্দু জিতে আসেন তাহলে তাঁকে খারিজ করা কিন্তু মোটেও সহজ হবে না। এ ব্যাপারে বিজেপি যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তাহলে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও শেষপর্যন্ত তা ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। সুতরাং নির্দিষ্ট একটা ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি ছক একটা তৈরি করেই রাখা হয়েছে। ভাবনার সঙ্গে যদি তা না মেলে তাহলে তো সমস্যার মধ্যে বিজেপিকে পড়তেই হবে !!
কোন মন্তব্য নেই