Header Ads

নন্দীগ্রামে শেষ হাসি কে হাসবেন জানা যাবে ২-রা মে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

টানটান উত্তেজনা তীব্র নাটকীয় আবহের মধ্যেই শেষ হল নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক নির্বাচন। রাজ্যবিধানসভার একটি কেন্দ্রকে ঐতিহাসিক মাত্রা দিয়েছেন রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তাঁর নিজের কেন্দ্র ভবানীপুর ছেড়ে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ায় নন্দীগ্রাম রাজ্যরাজনীতির নির্বাচনী ইতিহাসে একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। আকস্মিকভাবেই তীব্র আবেগের তাড়নায় মমতা শুভেন্দুকে ‘বোল্ড আউট’ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। শুভেন্দু দল ছাড়ার পর তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই দাবি করেছিলেন এইসব মীরজাফর বেইমানরা দল ছেড়ে চলে যাওয়ায় দলের মঙ্গলই হয়েছে। প্রকাশ্যে শুভেন্দু বা অন্যান্য যারা দল ছেড়েছেন তাদের পাত্তা না দিলেও শুভেন্দুর বিরুদ্ধে কলকাতা থেকে নিজে প্রার্থী হতে চেয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন শুভেন্দু তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতোই নেতা। ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে তাঁকে হারিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন শুভেন্দু। কুণাল ঘোষ মদন মিত্র কল্যাণ ব্যনার্জ্জী সৌগত রায়দের মতো নেতারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন শুভেন্দুকে। মহামাত্য ঘোষমশায় তো বলেই দিয়েছিলেন--নন্দীগ্রামে লড়াইটা হবে মমতার সঙ্গে মিনাক্ষীর এবং মমতা মিনাক্ষীকে এক লক্ষ ভোটের ব্যবধানে হারাবেন--তেমনটা হলে শুভেন্দুর তো পিকচারেই থাকার কথা নয়। ঘোষমিত্রবাঁড়ুজ্জেরায়বাবুদের পক্ষে ধারণা করাই সম্ভব ছিল না--শুভেন্দু কী ভাবে ভোট করাতে পারেন এবং জিততে পারেন--প্রতিপক্ষ যিনিই হোন না কেন ! মমতা’র ধারণা ছিল শুভেন্দু’র সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পর্কে--তাই অন্য কারুর ওপর ভরসা না করে তিনি নিজেই মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন। তবে মহামাত্য ঘোষমশাই কিন্তু ঠিকই বলেছেন--লড়াইটা শেষপর্যন্ত মমতার সঙ্গে মিনাক্ষীর মধ্যেই থেকে গেল--দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকার লড়াই !

মমতার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বলেছিলাম--তিনি জীবনের চরমতম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আমি জানি না--মমতার এই সিদ্ধান্তে পিকে’র সমর্থন ছিল কিনা--থাকলে বলতেই হবে পিকেকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মর্যাদা যারা দিয়েছেন তারা নিজেরাও রাজনীতির ‘র’ বোঝেন না। মমতার এই অপ্রত্যাশিত চমক সৃষ্টির রাজনৈতিক পদক্ষেপে পিকের অনুমোদন বা সম্মতি থাকার কথা নয়। আগেও বলেছিলাম--এখনও বলছি, এই কেন্দ্রে শুভেন্দুর পরাজয়ের কোনো সঙ্কেত বা বার্তা আমার কাছে ছিল না। শুভেন্দু নন্দীগ্রামের প্রতিটি পরিবার এবং তাদের সদস্যদের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি রাজনীতি করে এসেছেন--দল ছাড়ার মাস ছয়েক আগে থেকে প্রচুর অরাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে মানুষের মতামত নিয়েছেন--তাঁর দিকে সমর্থনের নিশ্চিত সংখ্যা নিয়ে নিয়মিত অঙ্ক কষে গেছেন। এই অঙ্কের ওপর নির্ভর করেই তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তৃণমূল প্রার্থীকে ৫০ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন। আজকের ভোটপর্ব দেখে আমার মনে হচ্ছে এই ব্যবধান আরও খানিকটা বাড়তে পারে মিনাক্ষীর সৌজন্যে। বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটিয়ে মমতা যেদিন ১৪ মার্চ নন্দীগ্রাম কাণ্ড নিয়ে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের করে ফেললেন সেদিনই মিনাক্ষীর প্রায় ফাঁকা অক্সিজেন সিলিণ্ডারে আচমকাই অনেকটাই অক্সিজেন ঢুকে গেল--সেটা বোঝা গেল তাঁর ওপর তৃণমূল ছোঁড়াদের চড়াও হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। এরই ফাঁকে আব্বাস সিদ্দিকীও নন্দীগ্রামে ভাষণ দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে খানিকটা হলেও চিড় ধরিয়ে দিয়ে গেছেন। ফলে মিনাক্ষীর ভোট যতটা বেড়েছে ততটাই কমেছে তৃণমূলের--স্পষ্ট বোঝা যাবে (বুথ ধরে ধরে হিসেব করলেই) ২-রা মে।
শুধুমাত্র শেখ সুফিয়ানের লম্বাচওড়া বচন ও নাচানাচিতে যে চিড়ে ভিজছে না এটা নেত্রী বুঝতে পারছিলেন না বলে যাদের মনে হয়েছে আমি তাদের দলে নেই। গত রবি থেকে মঙ্গল--এই তিন দিন নন্দীগ্রামে মমতার প্রচার কর্মসূচীর মধ্যে সেই দিগি¦জয়ের জোশ আমি অন্ততঃ দেখি নি। কোথাও কোনোরকম পজিটিভিটি তো ছিলই না--বরং একের পর এক মারাত্মক রকমের মন্তব্য ভীষণভাবে নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট তৈরি করে গেছে। ফলে নেত্রীর ভাষণের ভাষা ও ভঙ্গিতে সংলগ্নতার অভাব ভীষণভাবে প্রকট হচ্ছিল। তাঁর অস্থিরতা, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এবং লাগাতার ইভিএম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য মানুষ গিলছে কিনা তা তিনি ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেন নি। অনেক আগে থেকেই আমি বলে আসছিলাম--তাঁর বহিরাগত তত্ত্ব তাঁকে ডোবাবে--শেষপর্যন্ত কিন্তু সেটাই সত্যি হতে চলেছে।
গভীর রাত পর্যন্ত তিনি জাগেন বলে সকালে তাঁর ঘুম ভাঙে দেরিতে। আজও তেমনটাই ঘটেছিল। ঘুম থেকে উঠেই তিনি টিভির পর্দায় চোখ রেখে দেখেছেন--সকাল থেকেই নিজের ভোটটা দিয়ে শুভেন্দু ৩৫৫-টি বুথ চষে বেড়াচ্ছেন। বিশেষ বিশেষ দু’একটি এলাকায় শুভেন্দুবিরোধী আওয়াজ (জয়বাংলা, মীরজাফর) উঠলেও সিংহভাগ বুথের ছবিই যে দলের পক্ষে সুবিধেজনক ছিল না তাও বুঝতে অসুবিধে হয় নি। সাধারণতঃ ভোট দিতে যাওয়া ছাড়া তিনি বুথে বুথে ঘোরেন নি আগে। আজও হয়তো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর দেরি হচ্ছিল। তাই শেষপর্যন্ত তিনি যখন বেরুলেন ঘড়ির কাঁটা তখন একটা’র ঘরে। তিনি বেরুলেন এবং যে বুথে তিনি প্রথম পা দিলেন সেখানে গিয়ে তিনি বললেন--৮০% ছাপ্পা ভোট হয়ে গেছে ! তবু তিনি সেখানে দু’ঘন্টার বেশি সময় বসে থাকলেন। দু’ঘন্টা ঐ একটি বুথে বসে না থেকে তিনি যদি আরও দশ-পনেরটি বুথ ছুঁয়ে যেতেন তাহলে তিনি যা পেতে চলেছেন তার চেয়ে আরও খানিকটা বেশি ভোট পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না--হয়তো বুঝতে পারছিলেন বেলা বয়ে গেছে, আর কোনো লাভ হবে না। তিনি যখন একটি বুথে দু’ঘন্টার বেশি সময় বসে থাকলেন--সেই দু’ঘন্টা কিন্তু গাছতলায় বসে কাটালেন না শুভেন্দু--ভোটে জেতার জন্যে যা করার দরকার তিনি তাই করলেন। ভোটটা যাতে ঠিকমতো হয় তিনি তার চেষ্টা করে গেলেন অক্লান্তভাবে সারাদিন ধরে। তিনি জানতেন, ভোট যদি সুষ্ঠুভাবে চলে তাহলে তিনি জিতবেন। সঠিক সাংগঠনিক ভাবনা চিন্তার এই মৌলিক পার্থক্যই কিন্তু শুভেন্দুকে অনেকটাই এগিয়ে রাখলো আজ। ইতিউতি কিছু অসহায় করুণ আর্তনাদ করে ফিরলেন মমতার চীফ ইলেকশন এজেন্ট শেখ সুফিয়ান। তার শারীরিক ভাষাই সাক্ষ্য দিচ্ছিল--কি হতে চলেছে নন্দীগ্রামে।
মমতা সত্যি সত্যি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আমার কাছে যতদূর খবর--পিকে এমনটা চান নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে--তিনি মমতাকে দলের মধ্যেই খুব প্রাসঙ্গিক রাখতেই নানান স্টান্টবাজি করে আসছেন। মমতাকে দলের ভেতরেই দুর্বল করে দেওয়ার একটা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বলে আমার বরাবর মনে হয়েছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা যে এতটাই ভরাডুবির কারণ হবে--পিকে সেটা কল্পনাও করতে পারেন নি। এখন যত দোষ মমতার ঘাড়ে চাপিয়ে তিনি অতি দ্রুত রাজ্য ছেড়ে পালাবেন বলেই আমার ধারণা।
শেষ দু-তিন দফা ভোটের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সুযোগ এখনও রয়েছে। আমার মনে হয়--বীরভূমে দু’একটি নিশ্চিত সেফ সীট রয়েছে যার একটিতে (মুরারই) তাঁর অবশ্যই দাঁড়ানো উচিত। নন্দীগ্রামে হেরে গেলে তাঁর স্বপ্নের দলটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। এখনও তাঁকে রাজনীতিতে থাকতে হবে। তাঁর বিকল্প এখনও তাঁর দলে কেউ হয়ে উঠতে পারেন নি।
আজ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত আমাদের সামনে উঠে এসেছে। তৃণমূলনেত্রী বলেছেন--তিনি নন্দীগ্রাম নিয়ে চিন্তিত নন--কারণ, তিনি ৯০% ভোট পেয়ে জিতবেন--তিনি গণতন্ত্রের জন্যে চিন্তিত ! যদিও তাঁর এই চিন্তা যদি ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকট হতো তাহলে হয়তো তাঁকে আজ এই দিন দেখতে হতো না। আজ তিনি ‘পদ্মপাল’কেও ফোন করেছেন এমন একটা অবস্থান থেকে যা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু তিনি কথা বলেছেন রাজ্যপালের সঙ্গেও। মন্দের এইরকম দু’একটি ভাল মুহূর্তও আজকের নির্বাচনে উঠে এসেছে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.