Header Ads

নজরে নন্দীগ্রাম, রাত পোহালেই ভোট !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

নন্দীগ্রামে প্রচারের শেষদিনে বিজেপি’র সেকেণ্ড-ইন-কম্যাণ্ড অমিত শাহ বিপুল জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে নিশ্চিত জয়ের দাবি করে গেছেন। অন্যদিকে নন্দীগ্রামে মিঠুনের বডিল্যাঙ্গুয়েজে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ পালনের দায়বদ্ধতার অদ্ভূত নীরব উপস্থিতি আমাকে অবাক করে নি। সত্যি বলতে কি, নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর প্রচারে যোগী-মিঠুনের বিশেষ কোনো প্রয়োজনও ছিল না। তার চেয়ে অনেক ভাল হত যদি শেষমুহূর্তে দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, রাজীব ব্যানার্জ্জী, স্বপন দাশগুপ্ত, সব্যসাচী দত্তদের নিয়ে একটা তুমুল রোড-শো’র পর একটা জনসভায় শিশির অধিকারীকে শুভেন্দু হাজির করতে পারতেন। মিঠুন-যোগীর ইম্প্যাক্টের চেয়ে এঁদের ইম্প্যাক্ট অনেক বেশি হতো। যাইহোক, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আজকের সারাদিন এবং রাতটা নির্বিঘ্নে কেটে গেলে মঙ্গল !

গত রবিবার থেকে তৃণমূল নেত্রী শুভেন্দুকে কতটা এগিয়ে দিয়েছেন সেটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাবে ২-রা মে। ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোর নাকি রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করে বলেই দিয়েছেন--স্বয়ং দলনেত্রী যেভাবে ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’ তৈরি করে চলেছেন তাতে দলের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, তাঁর আর কিছু করার নেই ! প্রশান্ত কিশোরের এই প্রতিক্রিয়ার সত্যি-মিথ্যে আমার জানা নেই। মিডিয়াতে এমন খবর আমি দেখেছি এবং প্রশান্ত কিশোরের এই প্রতিক্রিয়ায় আমি বিন্দুমাত্র আশ্চর্য্য হই নি। এটাই হওয়ার কথা ছিল। আমার লেখা যারা নিয়মিত পড়েন তাদের মনে পড়বে--প্রশান্ত কিশোর সম্পর্কে আমি একেবারে প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম--তৃণমূলের ভাল করার চেয়ে খারাপই করবেন তিনি। না, তাঁর পেশাগত অবস্থান থেকে তিনি তা স্বেচ্ছায় করবেন--আমার বক্তব্য তা ছিল না। কি কি করা উচিত ছিল বা তিনি করতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে আমি বহুবার বিশ্লেষণ করেছি। আমি বার বার বলে এসেছি প্রশান্ত কিশোর তাঁর কর্পোরেট মেধায় বাংলার রাজনৈতিক সংষ্কৃতির সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না এমন সব পদক্ষেপ নিয়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামোটাই নড়বড়ে করে তুলছেন--যা একসময়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। হুবহু সেটাই হয়েছে। দলের ব্যাপক ভাঙন বড় বড় বোলচাল দিয়ে যে ঠেকানো যায় না এবং তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়াকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ফল ভাল হয় না--সেটা শেষপর্যন্ত প্রশান্ত কিশোরকে হাড়ে হাড়ে টের পেতে হল। তিনি তাঁর টিমে স্থানীয় নেতাদের অনুমোদন সাপেক্ষে যেসব ছেলে-পিলেদের নিয়োগ করে সমীক্ষার কাজে নামিয়ে ছিলেন, তাদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। ফলে তিনি শুধু একেরপর এক ভুল ভুয়ো এবং ফেক রিপোর্টের পাহাড় ঘেঁটে দলের সাফল্যের জাদুকাঠি তুলে আনার চেষ্টা করছিলেন অনেকটা সেই ক্ষ্যাপার পরশ পাথর খোঁজার মতো ! এইসব নিম্ন মেধার ফালতু রিপোর্টের ওপর এবং ‘বস’-এর নির্দেশের ওপর নির্ভর করে যা করেছেন তাতে দলের খাঁজে খাঁজে ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছিল--সেটা যখন তিনি টের পেলেন তখন তার মারাত্মক ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’ থেকে দলকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না। দলের ভবিষ্যৎ যখন তাঁর কাছে স্পষ্ট হল তখন বড় বড় বোলচালের মাধ্যমে দলনেত্রীর তৈরি করা ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’কে তুলে ধরে নিজের অপাদার্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করা ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো ‘অপশন’ খোলা নেই। এখন দেখা যেতে পারে দলনেত্রীর যেসব নেগেটিভ ইম্প্যাক্টের কথা প্রশান্ত কিশোর বলতে চেয়েছেন সেগুলো ঠিক কি বা কেমনতর !
গত দু’দিন ধরে আমার পোস্টে তথাকথিত শিক্ষিত এবং স্বঘোষিত দু’একজন আঁতেল আমাকে বিজেপি’র দালাল বলে স্পষ্টতঃই চিহ্নিত করেছেন। তাদের শিক্ষাদীক্ষা রুচি মেধা প্রবৃত্তি নিয়ে আমি কোনো বিতর্কে না গিয়ে তাদের বন্ধুতালিকা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। ২-রা মে’র পর তাদের কলম ও বদনের চেহারা আমি তো বটেই আমার বন্ধুতালিকায় যাঁরা আছেন সবাই দেখবেন।
নন্দীগ্রামে পায়ে চোট নিয়ে মমতা একেক দিন একেক রকমের কথা বলতে বলতে প্রচারের শেষমুহূর্তে তিনি দাবি করলেন ঐ চোট শুভেন্দুই বহিরাগতদের দিয়ে করিয়েছেন। এই অভিযোগকে তিনি শক্তিশেল মনে করলেও নন্দীগ্রামের মানুষ তা কতটা মনে করবেন সেটা তিনি এক সেকেণ্ডও ভাবার প্রয়োজন মনে করেন নি। প্রশান্ত কিশোর নিশ্চয়ই এই দাবির ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’ নিয়ে শঙ্কিত বোধ করে থাকবেন।
মমতা অবশ্যই নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের একজন প্রার্থী--কিন্তু তারও আগে এবং ওপরে তিনি এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। দেশের নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও কেন্দ্রীয়বাহিনী সম্পর্কে তাঁর ধারণা এবং মতামতের একটা বিশেষ তাৎপর্য থাকে। সেটা তিনি জানেন না এটা হতেই পারে না। তবু অন্যান্য রাজ্যের অ-বিজেপি দল এবং তাদের নেতাদের কথা বাদ দিয়েই বলা যায় এ রাজ্যের বিজেপি-বিরোধী একটিও দল বা তাদের নেতা-নেত্রীরা যে সব অভিযোগ তুলতে পারেন না (সেরকম মেধা তাদের নেই) এবং গুছিয়ে ভাবতেও পারেন না--মমতা কিন্তু অক্লেশে সেইসব মারাত্মক অভিযোগে সোচ্চার হতে পারেন। কি কি সেই অভিযোগ--দেখা যেতে পারে।
তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, নন্দীগ্রামের সমস্ত কমিউনিটি হল, হোটেল-রিসর্ট ছাড়াও বিজেপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে গাদা গাদা বহিরাগত এনে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রচুর উত্তরপ্রদেশের ‘পুলিশ’ও রয়েছে যাদের কেন্দ্রীয় বাহিনীর পোশাক পরিয়ে ভোট লুণ্ঠনের কাজে নামানো হবে ! তিনি আরও দাবি করছেন, উত্তরপ্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী হোটেলে বসে গোছা গোছা টাকা বিলি করছেন। বাহিনীর গাড়িতে টাকা আনা হচ্ছে। অমিত শাহ’র কনভয়েও টাকা আসছে--বহিরাগতরা ঢুকছে ! তিনি মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন--গণণা কেন্দ্রে যদি কেন্দ্রীয়বাহিনী বা পুলিশের লোকজন বিড়ি-বিড়িয়ানি ভাগাভাগি করে খাওয়ার কথা বলে তাহলে ভুলেও তা খাবেন না--ওরা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আগে থেকেই বিজেপিকে ভোট দেওয়া মেশিন বদলে দিতে পারে ! ঘটনাক্রমে নন্দীগ্রামে এক বিজেপি কর্মীর স্ত্রীকে ধর্ষণ করে হাত-পা বেঁধে খালের জলে ফেলে খুন করার একটা খবর সামনে উঠে আসে। মমতা মঞ্চে অভিযোগ করলেন--ওরা নিজেদের মেয়েকে খুন করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারে--আপনারা কিন্তু সাবধান থাকবেন ! তিনি জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন--আপনারা কি কিছু টাকার বিনিময়ে আপনার মেয়েকে বিক্রি করে দিতে পারবেন? আপনাদের ভোট বিক্রি করে দিতে পারবেন? এ ধরণের অসংখ্য মন্তব্যের পাশাপাশি তিনি তীব্র ক্রোধ এবং উত্তেজনার বশে যে ভাষা এবং ভঙ্গি নিজের প্রচার মঞ্চে অক্লান্তভাবে ব্যবহার করে চলেছেন তাতে অসংখ্য মানুষ শিহরিত হচ্ছেন। নির্বাক হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। প্রশান্ত কিশোরও কি ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হতে হতেই মমতার তৈরি করে চলা ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’ নিয়ে ভয়ঙ্করভাবেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন?
১৪-ই মার্চ নন্দীগ্রাম গণহত্যা সম্পর্কে নতুন নতুন পিলে চমকানো তত্ত্ব হাজির করার আগে তিনি তাঁরই লেখা ‘নন্দী মা’ গ্রন্থটির কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি নিলেন কি করে? ১৪-মার্চের ঠিক আগের দিন ১৩-মার্চ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যকে লেখা শুভেন্দু অধিকারীর চিঠির কথাও কি তিনি জানতেন না? ধরে নেওয়া যাক নন্দীগ্রাম কাণ্ডের নেপথ্যের অনেক ঘটনাই তিনি ঠিকঠাক জানতেন না (কিন্তু তিনি দাবি করে এসেছেন এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নিজে)--তবু তিনি ‘নন্দী মা’ গ্রন্থটি লিখলেন কেন এবং এই গ্রন্থটি নন্দিনী সেনগুপ্ত ইংরেজিতে অনুবাদ করে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দেওয়ার ফলে তাঁর বক্তব্য ইতিহাসে ঢুকে পড়ার পরেও মিথ্যে প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠলেন কেন--সেটা তিনি নিজে ভেবে দেখার মতো মানসিক স্থিরতায় না থাকলেও সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে পিকে-ও যে মারাত্মকভাবেই প্রমাদ গুণতে পারেন এটা তো অস্বীকারের কেনো জায়গাই এখন আর নেই। তাই শুধুমাত্র পিকে নন--তৃণমূলেরই বহু রথীমহারথীরাও এখন প্রমাদ গুণছেন তাঁর নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে অকারণ খোঁচাখুচির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে। আগামী সাত দফার নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য বলেই সকলে মনে করছেন।
কী এমন মহা সর্বনাশ হয়ে যেত যদি নন্দীগ্রাম থেকে জিতে শুভেন্দু বিরোধী আসনে গিয়ে বসতেন? শুভেন্দু’র রাজনৈতিক ভবিষ্যত গর্তে পুঁতে দেওয়াটা খুব জরুরি ছিল বলে অন্ধ স্তাবক ছাড়া আর কেউ-ই কিন্তু মনে করছে না। তিনি তাঁর আকস্মিক পায়ের চোটকে সিম্প্যাথি ওয়েভে পরিণত করতে পারতেন--অনায়াস সেন্টিমেন্টাল সুযোগ তাঁর ছিল--কিন্তু তিনি সেটাকেই রাজনীতিকরণ করে সত্যি সত্যি একটা ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’ তৈরি করে ফেললেন শুধুমাত্র নন্দীগ্রামেই নয়--গোটা রাজ্যেই। রবি, সোম ও মঙ্গল--এই তিনটি দিন তিনি নন্দীগ্রামে বসে বসেই শুভেন্দুর কতটা ক্ষতি করলেন কিংবা কতটা সুবিধেজনক জায়গায় পৌঁছে দিলেন তা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা বোঝা হয়তো যাবে কালকের ভোটদানের গতিপ্রকৃতি দেখে। তিনি যেসব চাঞ্চল্যকর অভিযোগ একটার পর একটা সোচ্চারে প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন সেগুলোই যদি তথ্য-প্রমাণ সহ নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাতেন এবং সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরতেন তাহলে একটা ইতিবাচক বাতাবরণ তৈরি হলেও হতে পারতো। যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করলেন না--শুধু আমার কাছে খবর আছে বলে বলে নিছকই কিছু ‘নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট’ তৈরি করলেন--যার মাত্রা দেখে শুধু পিকে-ই নন--রাজ্যের বহু মানুষই শিহরিত হচ্ছেন !
রাত পোহালেই রাজ্যরাজনীতির ইতিহাসে ঢুকে পড়তে চলা নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে। আজ সারাদিন এবং সারারাত নির্বিঘ্নে কাটে কিনা সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন রাজ্যের মানুষ। বাড়তি সতর্কতা নিয়েছেন নির্বাচন কমিশনও। বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রশাসনকেও কড়া অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায়--ভোট পর্ব শান্তিতেই সম্পন্ন হবে।
ইতিমধ্যেই সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী মিনাক্ষী মুখার্জ্জীর ওপর হামলা চালিয়ে মিনাক্ষী যে বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ (সংখ্যালঘু ভোটে ফাটল ধরার আশঙ্কায়)--এটা সামনে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবিকই তিনি অনেকটাই দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছেন এই নির্বাচনে--অপ্রাসঙ্গিক থেকে রীতিমতো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। এবারের নির্বাচনে এটাই তাঁদের বড় প্রাপ্তি ভবিষ্যতের জন্যে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.