সাড়ে তিনশো বছরের রূপোলি সোনালি স্মৃতি ও উজ্জ্বল জীবন গাঁথা
অমল গুপ্ত
পশ্চিমবঙ্গের কান্দি মহকুমার অর্ন্তগত আন্দুলিয়া গ্রাম, কান্দি শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামের তিনশো বছরের উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে একটি বৃহৎ তেঁতুল গাছ। আন্দুলিয়া গ্রামের গ্রাম্য দেবতা। গরিব হিন্দু-মুসলিম মানুষরা গাছটিকে ঘিরে পুজোপাঠ, প্রার্থনা করেন। আল্লা, ঈশ্বর ভেবে শ্রদ্ধা করেন। চোখের অসুখ, চিকেন পক্স নিরাময়ে তেঁতুল গাছের মাটি প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে বলে মানুষের বিশ্বাস। তেঁতুলের স্বাদ মিষ্টি। কেউ জানে না বয়স কত; এই গ্রামের ডজন দু'য়েক পানা পুকুর, কয়েকশো তাল গাছ আর শান্ত নীরবতার ছায়া ঘন ছোট্ট গ্রামে প্রায় ৬০০ ঘরের অভাব অনটন দারিদ্রতা; তার মাঝে এক বিদেশী আর্কিটেক্টের নির্মিত পাশাপাশি দুটি প্রাসাদ; আজও কোনও মতে সোনালি অতীত বুকে নিয়ে বেঁচে আছে। বয়স কবেই তিনশো বছর পার হয়ে গেছে।
কংগ্রেস গেল, বামপন্থী গেল, তৃণমূল কংগ্রেস এসেছে, হিজলের বুকে আন্দুলিয়া গ্রাম যেখানে দাঁড়িয়েছিল, আজও সেখানে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে উদাসী ক্লান্ত দুপুরে নীরবতা; ঘুঘুর মন খারাপ করা ডাক শুনে বাঁশের ঝাড়ে, পানা পুকুরে ডাহুকের এক পা, এক পা করে এগিয়ে যেতে দেখে শিবনাথ, কৃষ্ণ নাথ, হরি নাথ ও লক্ষ্মী রানিরা বড় হয়েছেন একদিন। আজ সারা দেশে শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। কলকাতা,মুম্বাই,বহরমপুর,পাটনা,দিল্লি, জয়পুর,বিকানির, যোধপুর, নাগপুর, বিহার প্রভৃতি রাজ্যে উজ্জ্বল পদ চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। গঙ্গা গোবিন্দ গুপ্তের পুত্র রামযাদব গুপ্ত ১৮৪০ সাল থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন একজন দক্ষ কবিরাজ হিসাবে। কান্দির গৌকর্ন পাতাণ্ড গ্রাম থেকে আন্দুলিয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেছিলেন। কান্দি জেমো রাজবাড়ির রাজারা কবিরাজ হিসাবে রামযাদব গুপ্তকে গ্রামে বসিয়ে জমিদার উপাধি দিয়েছিলেন। কবিরাজ গুপ্ত মানুষের নাড়ি টিপে রোগী ক'দিন বাঁচবেন, পরমায়ু বলে দিতে পারতেন। মৃত্যুর দৌর গোড়া থেকে ফিরিয়ে আনতে মোকরধজ দিতেন। রাম যাদব বিয়ে করেছিলেন বীরভূম জেলার সিলগান চাঁদপাড়া গ্রামে। তার তিন পুত্র শিবনাথ, কৃষ্ণনাথ, হরিনাথ ও এক কন্যা লক্ষ্মী রানী। ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষা দিয়েছিলেন। বড় পুত্র শিবনাথ গুপ্ত ১৮৮৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাশ করেন। শিবনাথ গুপ্তের বিয়ে হয়েছিল কান্দি ভরতপুরের টিয়া বদ্যিপুরের কৃষ্ণাকামিনীর সঙ্গে। দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী এই কান্দির বাসিন্দা ছিলেন। শিবনাথ গুপ্ত রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর সঙ্গে একসঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রথম ব্যাচে বি এ পাশ করেছিলেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি এ পাশ করার পর আইন কলেজে ভর্তি হন। কান্দি গৌকর্ন প্রাসন্নময়ী হাইস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। গরুর গাড়িতে চেপে, নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে একটি বন্দুক নিয়ে আন্দুলিয়া থেকে গৌকর্ন জঙ্গলের পথে যেতেন। সে এক ইতিহাস! পরে তিনি উত্তর বিহারের আরা জেলা অ্যাকাডেমিতে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। তাঁর অসুস্থতার সময় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী আন্দুলিয়া গামে গিয়ে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন।
বাংলা ভাগের সময় হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন দূর করার জন্য সদ্ভাব সম্প্রীতি রক্ষা করার তাগিদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ও অন্য আরও কয়েকজন একটি প্রচার পত্র বিলি করে সবাইকে হাতে হলুদ রঙের সুতো বেঁধে ভাতৃত্ববোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ডাক দিয়েছিলেন, সেই শুরু রক্ষা বন্ধন পর্ব। বিজ্ঞান মনস্ক উজ্জ্বল এই ব্যক্তির সঙ্গে আন্দুলিয়ার কবিরাজ বংশের এক সুসম্পর্ক বজায় ছিল চিরকাল। রাম যাদব গুপ্ত তার দ্বিতীয় পুত্র হরিনাথকে বিদ্যালয় পর্ব শেষে বেনারস পাঠিয়েছিলেন। সেখানে টোলে সংস্কৃত ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পরে দেশের একজন বিখ্যাত কবিরাজ হয়েছিলেন। বেলে নদী, কুয়ানদী, দ্বারকা নদী তিনটি নদী হিজল চৌরিগাছা আন্দুলিয়া অঞ্চলে প্রতিবছর বন্যা, গ্রামের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে কবিরাজ বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। কবিরাজ বাড়ির অধিকাংশ কান্দি, বহরমপুর, কলকাতা প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে কর্মজীবন, শিক্ষা জীবন খুঁজে নিয়েছিলেন। শিবনাথ গুপ্তের পুত্র রমানাথ কান্দিতে চলে আসেন। কবিরাজ বংশের এক বিরাট মাটির বাড়ি ছিল। কান্দি জেলখানার সামনে, সেখানে মেয়ে ঊষা, মঞ্জু, আরুনী, দীপক, মলয়, অমল, অশোক, অরূপ, রূপা, কাবেরী সে এক বিরাট পরিবার! পত্নী কল্যাণী, বিহারের পূর্ণিয়ার কিষণগঞ্জের খ্যাতনামা কবিরাজ কালিপদ সেনের কন্যা ছিলেন কল্যাণী সেন। কবিরাজ কালিপদ সেন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পূর্ণিয়া জেলাতে চিকিৎসা করতে বেরোতেন। কল্যাণীর প্রচণ্ড বই পড়ার নেশা ছিল। বিদ্যুৎ ছিল না। মাটির বাড়ি খড়ের ছাদ। দোতলা বাড়ি লণ্ঠনের মিটমিটে আলোতে কল্যাণী অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়তেন। কল্যাণী গুপ্ত মুখে মুখে ছড়া বলতে পারতেন। বিয়ে পার্বণে পাড়া-পড়শীর বিয়েতে ছড়া লিখে দিতেন। সেলাইয়ের কাজে পটু ছিলেন। হাতে সেলাই করে বিবেকানন্দ ফুটিয়ে তুলে মুর্শিদাবাদ জেলাতে সম্মান কুড়িয়ে এনেছিলেন। কলকাতা থেকে দেশ পত্রিকা কল্যাণী গুপ্তের নামে পাৰ্সেল আসতো। তা পড়ার জন্য ভাই বোনদের মধ্যে কারাকারি পরে যেত। কবিরাজ বাড়ির কন্যা আরুনী সেন এক সময় এশিয়ার মধ্যে বড় বিহার জামালপুরের রেলওয়ে কারখানার প্রথম মহিলা সুপার হিসাবে কাজ করতেন। তিনি জামালপুরের রামপুর কলোনির ৩১৯/এ.বি. কোয়াৰ্টারে সারা জীবন কাটান। তার পিছনের ৩১৭/সি.ডি. কোয়াটারে থাকতেন। জামালপুর রেলওয়ে কারখানার একাউনটেন্ট প্রভাত রঞ্জন সরকার। তিনিই আনন্দমূর্তিজি, আজ সারা বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। আরুনী সেনর সঙ্গে প্রভাত রঞ্জন সরকারের সুসম্পর্ক ছিল। রমানাথ গুপ্ত কোনো দিন পায়ে জুতো, চটি পড়েননি। সময় সুযোগ পেলে ডায়েরি লিখতেন। ১৯৬৬ সালের দুর্গাপুজোর আগে সন্ধ্যা নাগাদ ডায়েরিতে প্রথম লাইন লিখেছিলেন, পঞ্চমীতে বাবুল আসবে লাইনটি লিখতে গিয়ে তার হার্ট অ্যটাক হয়। হাতে কলমটি ধরা ছিল, দীপক কান্দি কলেজের লাইব্রেরিয়ান হিসাবে চাকরির প্রথম মাসের বেতন তাঁর বাবার হাতে তুলে দিতে গিয়ে দেখেন তার বাবা বিদায় নিয়েছেন। দারিদ্র্যের সংসার; দীপক গুপ্ত বেতন না পেলে কি হত? রমানাথ গুপ্ত খালি পায়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে ৬ ফুট উচ্চতা; সুন্দর কবিতা লিখতেন; ছবি আঁকতেন; প্রথম দিকে চাকরি বাকরি নেই। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে দর্শন অনার্স নিয়ে পাশ করে বসেছিলেন। কবিরাজি নিয়ে লেখাপড়া, গবেষণা করতেন। কান্দিরাজ হাইস্কুলে চাকরির এক সুযোগ এলো। তবে শর্ত দেওয়া হল, এক ইউরোপিয়ান গ্রুপ কান্দিতে আসবে, তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে কান্দি পুরসভার হ্যালিফক্সের প্রেক্ষাগৃহে। রমানাথ গুপ্তকে ইংরাজিতে ভাষণ দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতে হবে। চাকরি প্রার্থী রমানাথ গুপ্ত হল ভর্তি গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সামনে ইংরেজিতে প্রায় এক ঘন্টা ভাষণ দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে মাত্র ২৫ টাকার বেতনের চাকরি দেন। ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে চাকরি দেওয়া হলেও তিনি ইংরাজি ও সংস্কৃত পড়াতেন। রমানাথ গুপ্তের নেশা ভাঙ কিছুই ছিল না, শুধু লটারির টিকিট কেনার নেশা ছিল। ওড়িশার বরবটি রাফেল, লন্ডনের ডার্বি লটারির টিকিট কিনতেন বলে তাঁর প্রিয় ছাত্র অরবিন্দ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন। রমানাথ গুপ্ত বড্ড ফুল ভালবাসতেন; মাটির বাড়ির সামনে ত্রিভুজ আকৃতির একটি বাঁশের বেড়া দিয়ে গোলাপ, সূর্যমুখী, নানা মরশুমি ফুল রোপণ করতেন। সঙ্গে ভেষজ গুণসম্পন্ন থানকুনি, কালমেঘ, আদা, তুলসী, প্রভৃতি গাছও লাগাতেন। বাগানে রং বেরঙের ফুল ফুটলে রমানাথ গুপ্তের আনন্দ, উৎফুল্লতা, সবার নজর কারতো। সবার নজর এড়িয়ে তিনি মারণ রোগ ক্যান্সার নিয়ে নীরবে সাধনা করে গেছেন। নিকট পরিজন সন্তোষ দাস গুপ্তের মা সুষমা দাস গুপ্তের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। বাঁচার আশা প্রায় শেষ। রমানাথ গুপ্ত প্রতিদিন ভোরে হাতে একটি গাছের মূলের অংশ শিলনোড়াতে বেঁটে কাগজে মুড়ে নিয়ে যেত বিশ্বাস পাড়ায়। প্রায় তিন কিলোমিটার খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে ক্যান্সার রোগীর আক্রান্তের গলায় নিজে হাতে প্রলেপ দিয়ে আসতেন।
পরে জানা গিয়েছিল, শ্বেত করবি গাছের মূল বেঁটে রোগীর গলায় প্রলেপ দেওয়া হত। রোগীও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। রমানাথ গুপ্ত তাঁর গবেষণার বিষয়টি জার্মান ও আমেরিকাতে পাঠিয়েছিলেন। ছাত্র অরবিন্দ জানান, বিদেশে পাঠানো চিঠিগুলি তিনিই রেজিস্ট্রি করে পাঠাতেন। তিনি আমেরিকাতে পাঠানোর কথা জানান। রমানাথ গুপ্তের মাটির বাড়িতে মাটির মেঝেতে তাল পাতার চাটাইয়ে বসে কয়েক মাস পড়াশুনা করেন প্রভাস কুমার গুপ্ত। কান্দি রাজ কলেজের ১৯৫৯ সালের প্রথম বি এ পাশ ছাত্র জেমো এন এন হাই স্কুলের প্রিন্সিপাল। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোনালি দিনের স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছেন। তাঁর বেশ কয়েকটি বই আছে। তাঁর 'A retrospect' নামের ইংরাজি গ্রন্থে ভাইপো প্রভাস কুমার গুপ্ত রমানাথ গুপ্ত সম্পর্কে লিখেছেন, ... Shibnath babus second son was Ramanath Gupta, (1906 to 1966), was on unassuming scholar. A tall, bespectacled, fair complexioned gentleman, with thik hair, to Ramanath Gupta was every inch a gentleman. ক্যান্সার গবেষণা সম্পর্কে লিখেছেন, he was keenly interested in kabiraji treatment, after working for years together he is said to have discovered an antidote to cancer and took up the matter with the health ministry of the govt of india but as he expired within a year, the fate of the correspondent could not be known প্রভাস কুমার গুপ্তের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রমানাথ গুপ্ত খুব ভালো ছবি আঁকতেন। ইংরাজি ভাষাতে কবিতা লিখতেন তার 'গ্রো মোর ফুড' নামে এক কবিতা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রশংসা করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম আন্দুলিয়ার উর্ব্বর মাটিতে প্রফুল্ল কুমার গুপ্তের মতো বিপ্লবীর জন্ম হয়েছে। বিজয় গুপ্ত ও ব্যোমকেশ গুপ্তের মতো আইনজীবীর জন্ম হয়েছে। এই কবিরাজ বংশে কানাই পদ কবিরাজ, মধুসূদন সেন গুপ্তের মত বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছিল। বিজন কুমার গুপ্ত, সুনীল কুমার গুপ্তের মত আর্দশ শিক্ষক মুর্শিদাবাদ জেলাতে নেই। কিন্তু আন্দুলিয়া কি পেলো? রাস্তা ঘাট নেই; পরিকাঠামো নেই; প্রতিবছর নিয়ম করে বন্যা হয়; কয়েকশো তালগাছ, পানা পুকুর, বাঁশ বাগানের সবুজ স্নিগ্ধ ছায়া আর কবিরাজ বংশের সোনালি রূপালি স্মৃতি চারণ, সঙ্গে অবশ্যই গ্রাম দেবতা শীতলা তলার বুড়ো তেঁতুল গাছটি আজও আন্দুলিয়া গ্রামের সুখ-দুঃখের স্মৃতি বুকে নিয়ে একমাত্র সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সৌঃ নয়া ঠাহর পুজো সংখ্যা ২০২০
কোন মন্তব্য নেই