আপনার ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষার অসাধারণ লড়াইটাও কেউ ভুলবে না সৌমিত্রবাবু !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
দিনটাও আপনি বেছে নিলেন মহা ব্যস্ততার। প্রায় প্রতিটি থানা থেকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে কালীপুজোর চরম ব্যস্ততা ! তাই দীর্ঘ ৪০ দিনের লড়াইয়ের সঙ্গে আরও এক-দেড় দিন তো আপনাকে নিথর নিঃস্পন্দ অপেক্ষার কাল কাটাতেই হবে ! মহাতারকার মহাপ্রস্থানের আয়োজন তো দায়সারাভাবে হতে পারে না--আপনি তো শুধুমাত্র একটা এলেবেলে নাম নন--বাঙালির গভীর আবেগ, সুতরাং অপেক্ষা একটু তো করতেই হবে !
সে যাইহোক, তীব্র মন খারাপের আবহেই তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম একটি মূল্যবান পত্রিকা। যার টাইটেল পেজের মাঝখানে ‘প্রীতি ও শুভেচ্ছা সহ’ লিখে চমৎকারই শুধু নয়--ঈর্ষণীয় হস্তাক্ষরে নিজের নামটি বাংলায় এঁকে দিয়েছিলেন তিনি কোন এক সন্ধ্যায় বসন্ত কেবিনে তাঁর নিজস্ব আড্ডার মধ্যে ব্যস্ত থাকার মাঝখানেই। বসন্ত কেবিনে তাঁর সঙ্গে আরও একজনকে দেখা যেত--ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও অনেকেরই প্রিয় আড্ডার জায়গা ছিল বসন্ত কেবিন। এখনও তার অস্তিত্ব আছে কিনা আমি জানি না। কলেজে পড়ার সময়ে আমি মাঝে মাঝেই সেই সময়টাতেই বসন্ত কেবিনে ঢুকতাম যে সময়টাতে সাধারণতঃ তিনি আসতেন। অনেক কাল আগেকার কথা হলেও বেশ কিছু স্মৃতি এখনও অমলিন থেকে গেছে।
না, তাঁর সঙ্গে আমার কোনো হৃদ্যতা তৈরি হয় নি--তেমন কোনো সুযোগও ছিল না তাঁর দিক থেকে তো বটেই--আমার দিক থেকেও। আমার ‘সাহিত্য ভগীরথ’ পত্রিকার জন্যে একবার সাহস করে একটা লেখা চেয়েছিলাম--উত্তরে তাঁর প্রবল ব্যস্ততার কথা উল্লেখ করে তাঁর অক্ষমতা জানাতে ভোলেন নি--সঙ্গে চার লাইনের একটি ছোট্ট কণিকা-কবিতা ছিল--যা ছাপার জন্যে ছিল না--তাই ছাপা হয় নি। কয়েকদিন ধরে পত্রিকাটি’র সঙ্গে ঐ চিঠিটাও খুঁজে পেতে চাইছিলাম। পেলাম না--এরকম আরও অনেক মূল্যবান স্মুতি আমার কেড়ে নিয়েছে ২০১৭ সালের আকস্মিক বন্যা !
যে মূল্যবান পত্রিকাটি খুঁজে পেতে চাইছিলাম তার নাম ‘এক্ষণ’। তিনিই তাঁর মূল সম্পাদক ছিলেন-সঙ্গে ছিলেন নির্মাল্য আচার্য্য (যতদূর মনে পড়ছে)। অসাধারণ সংখ্যা ছিল সেটি। কারণ, ঐ সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য দিনলিপি ! তাঁর নিজেরও একটি দুর্দান্ত পূর্ণাঙ্গ নাটক ছাপা হয়েছিল ঐ সংখ্যায়--যতদূর মনে হচ্ছে নাটকটির নাম ছিল ‘রাজকুমার’ (ভুল হলে যাঁর জানা আছে শুধরে দিলে বাধিত হব)--এই নাটকটি মঞ্চস্থও হয়েছিল তাঁরই নির্দেশনায় এবং বলাই বাহুল্য--প্রধান চরিত্রেও ছিলেন তিনি। দাপটের সঙ্গে নিজের নির্দেশনায় বেশ কিছু ব্যতিক্রমী নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে তিনি অভিনয় করে প্রমাণ রেখেছিলেন তাঁর ইন্টেলেকচুয়াল ভাবনা সংমিশ্রিত অভিনয় দক্ষতার। সামনে থেকে তাঁর অভিনীত নাটক আমি দেখেছিলাম।
একজন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তী, পাশাপাশি বাচিক শিল্পি হিসেবেও তাঁর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। একই সঙ্গে তিনি কবি এবং অনুবাদকও। তিনি বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মোট ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় অভিনয় করেছেন।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমহার্স্ট স্ট্রীট সিটি কলেজে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়েরর পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাডা তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে তাঁর--অপুর সংসার, দেবী, ক্ষুধিত পাষাণ, স্বরলিপি, মণিহার, একই অঙ্গে এত রূপ,অয়নান্ত, অতল জলের আহ্বান, আগুন, বেনারসী, কাঁচ কাটা হীরে, মহাশ্বেতা, পরিশোধ, বাঘিনী, অপরিচিত, পরিণীতা, চেনা অচেনা, অরণ্যের দিনরাত্রি, পদ্মগোলাপ, প্রথম কদমফুল, মাল্যদান, বসন্ত বিলাপ, যদি জানতেম, অভিযান, ঝিন্দের বন্দী, প্রস্তর সাক্ষর, অজানা শপথ, অশনি সংকেত, চারুলতা, সমাপ্তি, গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা, কোণি, শ্যাম সাহেব, অমরগীতি, খেলার পুতুল, একটি জীবন, গুগাবাবা, হীরক রাজার দেশে, ফেলুদা সমগ্র, সংসার সীমান্তে, গড় নসিমপুর, জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার, তিনভুবনের পারে সহ আরও অনেক সফল ছবি--যার মধ্যে সুচিত্রার সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ও ‘দত্তা’ ছবি দুটির কথা তো ভোলাই যাবে না।
তাঁর অসাধরণ কণ্ঠস্বর আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল এক সময়ে। তাঁর কণ্ঠে শোনা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ আমাকে আজও আবেগতাড়িত করে। আমিও একসময়ে অমিতের নাটকীয় সংলাপ ও কাব্যাংশে কণ্ঠ দিয়েছি--না, তাঁর ধারেকাছেও যেতে পেরেছি বলে দাবি করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে এটুকু স্বীকার করতেই পারি--তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন--কচ ও দেবযানী, কর্ণ-কুন্তী সংবাদ, দেবতার গ্রাস, সাধারণ মেয়ে, ক্যামেলিয়া, শেষের কবিতা সহ বেশ কিছু কবিতা ও কাব্যনাটকে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য। এখনও মাঝে মাঝে সেইসব দিনগুলোতে ফিরে যাই--এবং তখনই মনে পড়ে সহজে ভুলতে না পারা এই বহু প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটিকে !
তিনি ২০০৪ সালে পদ্ম ভূষণ, ২০১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ছাড়াও ২০১৭ সালে ফ্রান্সের লিজিওন অফ অনার এবং Commandeur de l' Ordre des Arts et des Lettres এবং ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন (২০১৩ সালে অবশ্য এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন) !
বামমতাদর্শে বিশ্বাসী তিনি আজীবন অনড় থাকার পাশাপাশি বামপ্রভাবিত সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবেই শেষ দিন পর্যন্ত অনমনীয় ছিলেন। নিজের নীতিগত ও সিদ্ধান্তগত অবস্থানের সঙ্গে তিনি কোনো কিছুর বিনিময়েই সমঝোতা করেন নি। নীতিগত ও আদর্শগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা ছিল না এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি পাওয়া যাবে না।
মহনায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর তুলনামূলক আলোচনায় সরগরম থাকতো মহিলামহল থেকে চায়ের দোকান পর্যন্ত প্রায় সর্বত্রই। আমি কলেজ জীবন থেকেই তাঁর পক্ষ নিয়ে গলা ফাটিয়ে এসেছি। আজও ঋত্বিক ঘটক যদি সত্যজিৎ রায়ের মতো অনুকূল বাতাবরণ পেতেন তাহলে ঋত্বিক ঘটকই প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে এক নম্বরে নিজের নাম খোদাই করে যেতে পারতেন বলে বিশ্বাস করি--তেমনই রূপ-স্টাইল এবং স্মার্টনেসে উত্তমকুমার কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ইন্টেলেকচুয়াল অভিনয় প্রতিভার প্রদর্শনে তিনি যে অনেকটাই এগিয়ে আছেন--এটা প্রমাণ করার চেষ্টাটা আমার মধ্যে আজও রয়ে গেছে !
তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর সাহিত্য-মনস্কতা, বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়, পরিচালন ক্ষমতা নিয়ে ভাবনাচিন্তার পর আর বিশেষ কোনো অবকাশ থাকতো না যার মধ্যে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে মাথা ঘামানো যেত। আদ্যপান্ত এক উজ্জ্বল বাঙালি আইকন হিসেবে বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে তিনি দীর্ঘকাল ধরে যে আলো ছড়িয়ে গেলেন তা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে চির অমলিন থেকে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
অত্যন্ত ভগ্ন চিত্তে আপনাকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সৌমিত্রবাবু ! আজ থেকে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন সেটা যেন আপনার চিরকাঙ্খিত জগতই হয় এবং সেখানে যেন আপনার জন্যে মহার্ঘ্য আসন পাতা থাকে !
কোন মন্তব্য নেই