কলকাতার ক্ৰীড়া সাংবাদিকতার ধ্রুবতারা
- রত্নজ্যোতি দত্ত -
জীবনে যার সাথে সরাসরি সংযোগ নেই তার সাথে অজান্তেই সংযোগ। এমন আত্মিক সম্পর্ক সচরাচর হয় না।কিন্তু আমরা যাদের কাজকে জানি তাদের সাথে নিজের অজান্তে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কলকাতার খ্যাতনামা সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য্যের সাথে আমার এমনই এক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। গৌতমদা যখন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে ভারতীয় ক্রিকেট কভার করতেন, সে কৈশোর কালে তাঁর প্রতিবেদনগুলো খুব মনোযোগ সহকারে পড়তাম। তাঁর কিছু খেলার প্রতিবেদনের কথা এখনও মনে দাগ কেটে আছে।
গৌতম ভট্টাচার্য্যের সাথে নেওয়া এক ইন্টারভিউ নিচে দেওয়া হল পাঠকদের জন্যে।
প্রশ্ন - আপনার সব থেকে প্রিয় ক্রিকেটার কে এবং কেন?
উত্তর - আমার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হলেন - ইমরান খান। অসম্ভব সব স্বপ্নকে সামনে রাখা। সে সব স্বপ্নের মশালগুলো জ্বালিয়ে রাখা এবং সেই মশালগুলোকে ধাওয়া করে এমন সব কাজকর্ম করা, যা ক্রিকেটের বল আর ব্যাটের জগতের সম্পূর্ণ বাইরে। ইমরান খান দুটো হাসপাতাল তৈরি করেছেন, দুটো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছেন। আমি তাঁর রাজনীতিতে কৃতিত্ব বা সাফল্য বাদই দিলাম, রাজনীতির ব্যাপারটা ধরছিনা। কিন্তু, একজন ক্রিকেটারে্র পক্ষে দুটো ক্যান্সার হাসপাতাল, দুটো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা, আর একই জন্মে বিশ্বকাপ জেতা, ভারতে এসে ভারতকে হারানো, ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে সিরিজ ড্র করা, ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে হারানো। এসব বাস্তবে প্রদর্শন করা সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। উপমহাদেশের যত পেস বোলার আছেন, তার মধ্যে তাঁর গড় সবচাইতে ভালো। পাকিস্তানের মতো জায়গায় ক্রিকেট খেলে, উপমহাদেশে বল করে এরকম এভারেজ, ব্যাট-বল দু'টোতেই এভাবে প্রদর্শন সত্যিই দূর্দান্ত। আর কোনও এরকম নজিরই নেই।আমার মূল্যায়ন এতোগুলো শর্তের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রশ্ন - প্রিয় এই ক্রিকেটারের কোন মানসিকতা বা কোন উপাদান আপনার জীবনকে প্রভাবিত করেছে?
উত্তর - ইমরান খানের মতো কোন অনুপ্রেরণামূলক বা ও ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র, ক্রিকেটে কোনও দিন এসেছে বলে আমার মনে হয় না। যিনি জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচে এতো খারাপ বল করেছিলেন যে সবাই বলেছিল উড়ে এসে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যিই, উড়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই জায়গা থেকে - ১৯৭১-এর সেই অপমান, অসম্মান থেকে এরকম একটা মঞ্চে উত্তরণ। সত্যিই, অভাবনীয়। একটা মানুষ নিজের মধ্যে নিজেকে ভাঙতে, গড়তে, গড়তে নিজের মধ্যেই একটা বড় মাল্টিস্টোরি গড়ে তোলার কাহিনী। আর, তা দেখাটা আমার কাছে দারুন এক ফ্যাসিনেটিং অভিজ্ঞতা বলে বরাবর মনে হয়েছে।
প্রশ্ন - ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যেসব ক্রীড়াবিদদের সাথে আপনার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের থেকে জীবনে কি পেয়েছেন যদি বলেন?
উত্তর - অবশ্যই। মোট ছজনের সাথে আমার খুব ভালো পরিচয় বা যোগাযোগ হয়েছে। এরা হলেন - (১) ইমরান খান; (২) শচীন তেন্ডুলকার; (৩) সুনীল গাভাস্কার; (৪) সৌরভ গাঙ্গুলী; (৫) রাহুল দ্রাবিড়; (৬) গ্রেগ চ্যাপল্।
উত্তর - এই বইটা ভারতীয় ক্রিকেটের একটা অদ্ভুত রূপকথা। কিন্তু যেকোন রূপকথার মধ্যেও কিছু বাস্তব জীবন থাকে। আমরা যে রামায়ণ, মহাভারত পড়ি বা দেখি - সেগুলো আমাদের ঐতিহাসিক দুটো মহাকাব্য যা আমাদের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে শ্রদ্ধার। সেখানেও অনেক কূটনীতি, লড়াই, সংঘর্ষ, ঈর্ষা, কুটিলতা, উত্থান-পতন সবকিছুই রয়েছে। তার মধ্যেই বীরের উত্থান হয়। তো, ‘৭১-এ যে জয়টা এসেছিল, সেটাও কিন্তু সেইরকম ভাবে নানান সংঘর্ষ, ঘাত, প্রতিঘাত, ঈর্ষা, লড়াই, প্রতিবাদের গল্প এবং তারই মধ্যে ছিল অভ্যুত্থান, তারই মধ্যে ছিল স্বপ্ন দেখা। বইটা সেরূপভাবে কিন্তু ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম', এর গল্প ঠিক নয়। এতে যা যা ঘটনা সেই সময়ে ঘটেছিল, যেমন বিতর্কিত ক্যাপ্টেন বাছাই থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়ে একটা 'ডকু-ফীচার' এর মতো বইটি লেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে, কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় এই বই-ভিত্তিক একটি তথ্যচিত্রের পরিচালনা করছেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাঠকদের কাছে আমার বক্তব্য হল আপনারা অনেক উপাদান পাবেন বইটিতে যেখান থেকে অনেক উঠতি খেলোয়াড় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার রসদ পাবে। সুনীল গাভাস্কারের মতো নাম-না-জানা এক মধ্যবিত্ত ব্যক্তি লড়াই করে ১৯৭১-এর সিরিজে একজন তারকা যদি হয়ে উঠতে পারেন, তবে উদীয়মান খেলোয়াড়রাও অনুপ্রাণিত হবেন এ জেনে যে তাদের জন্য সুযোগের দ্বার কখনো না কখনো খুলবেই। এই বইটি থেকে প্রেরণার আশা করা যেতেই পারে।
প্রশ্ন - ক্রিকেট মনস্তত্ত্বের কোন বিষয়টি ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সহায়ক হবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর - খুব ভালো প্রশ্ন। আমার মনে হয়, নিজেকে পজিটিভ রাখা আর নিজেকে বলা যে খারাপ সময় যেমন তাড়াতাড়ি কেটে যায়, তেমনি ভালো সময়ও তাড়াতাড়ি কেটে যায়। কোনটাই জীবনে চিরস্থায়ী নয়। ভালো ও খারাপ সময়ে নিজেকে নির্বিকার রাখতে হয়।কারণ, এগুলো সুখ-দুঃখের মতো, ক্রমাগতই ওঠাপড়া। এ চলতেই থাকে। সেইজন্য, এই যে, চারপাশে একটা নৈরাশ্যতা, সেটাতে ডুবে না গিয়ে স্মার্টলি আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করা এবং একই সঙ্গে মনোবল রাখা যে এটা শেষ হবে।
এখন প্রশ্ন হল, এই সময়ের সদ্ব্যবহার আপনি কিভাবে করবেন। দুটো রাস্তা আছে। এক, এই সময়টাতে আমি কি শুধুই হা হুতাশ করে কাটাবো? না, এই সময়টাতে আমি আমার যা যা কাজ করার আছে, তা গুছিয়ে নেবো? দুই, যখন সামনে জিনিসটা আসবে তা কীভাবে উপভোগ করবো?
আমার মনে হয় আমরা কে কিভাবে এই সময়টাকে ঠিক দেখছি তার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। অনেকের বাড়িতে একটা চেয়ার হয়তো লাগছে না, সেই চেয়ারটাকে নিয়ে এখন কী করবো ভেবে কেউ হা হুতাশ করছেন, আবার কেউ হয়তো ভেঙে যাওয়া চেয়ারটার পাল্লা কেটে নিয়ে একটা ফার্নিচার বানিয়ে নিচ্ছেন। ভাবলেন, এটা হল না কিন্তু এ হল।
সুতরাং, আমরা সময়টাকে কীভাবে দেখবো সেটার ওপরেই সব নির্ভর করছে সব কিছু। যারা বুদ্ধিমান, মানসিকভাবে প্রখর, পজিটিভ, অনলস, তারা কিন্তু সবাই যেমন আত্মরক্ষার কথা ভাবেন, তেমনি তারা ভীষণ ধৈর্য্যশীল। আমি বেশ কিছু কিংবদন্তি খেলোয়ারদের কথা জানি, যাদে্র সঙ্গে পাঁচ মাস থেকে দেখা হচ্ছেনা, যারা বাড়ি থেকে বেরুচ্ছেন না। তারা কিন্তু ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সাহসী মানুষ। অথচ, দেখা করছেন না। কারণ, তারা নিপুণভাবে আত্মরক্ষা করছেন, এই সময়ে নিজেদের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন। পুরোনো কাজগুলোর মূল্যায়ন করছেন, আবার নতুন সব কাজ তৈরি করছেন, আর ভাবছেন কীভাবে নতুন কাজগুলো করা যায়। নতুন কাজের একটা এক্সেল শিট বানিয়ে নিচ্ছেন। কাজেই, আমার বক্তব্য হচ্ছে, ঠিক এরা যা করছেন, আমাদের সবার তা করা উচিত।
প্রশ্ন- আপনার টেনিস রিপোর্টিংয়ের গ্ৰ্যাণ্ডস্ল্যাম আজ অবধি হয়নি। ফ্রেঞ্চ ওপেনটা আপনার কভার করা হয়নি। সে নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কি?
উত্তর - ফ্রেঞ্চ ওপেনটা এখনও হয়নি, উইম্বলডন ওপেন হয়েছে, অষ্ট্রেলিয়া ওপেন হয়েছে, ইউএস ওপেন হয়েছে।আসলে, ফ্রেঞ্চ ওপেনটা মানে এই লম্বা-লম্বা র্যালি, টানা ছয় ঘন্টা ধরে খেলাটা আমাকে সেভাবে আকর্ষণ করেনি। মানে যে অর্থে ইউএস ওপেন আকর্ষণ করেছে। উইম্বলডন তো জন্ম থেকেই আকর্ষণ করেছে। ইউএস ওপেনের মধ্যে অদ্ভুত মার্কিন একটা ব্যাপার আছে। ইউএস ওপেনটা উইম্বলডন থেকে এতো আলাদা যে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন - ক্রিকেট ও রড লেভারের দেশ- তা নিয়ে একটা আকর্ষণ তো ছিলই। ফ্রেঞ্চ ওপেন নিয়ে, সত্যি বলতে কি, সে অর্থে আলাদা করে কোন মাদকতা অনুভব করিনি। কিন্তু নিশ্চয়ই ফ্রেঞ্চ ওপেনটা আমার মনে হয় আমার বাকি সাংবাদিক জীবনের যেটুকু সময় পরে আছে, তাতে ফ্রেঞ্চ ওপেনটা কভার করে নেওয়া উচিত। অনেক ধন্যবাদ আমাকে মনে করানোর জন্য।
প্রশ্ন - আপনি এখন অবধি কটি বিশ্বকাপ কভার করেছেন?
উত্তর - সব মিলিয়ে ১৬টি।তারমধ্যে ৫ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ৯টি ওয়ান ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ এবং দুটি ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ।
প্রশ্ন- আপনার মতে একজন সফল ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার মূল মন্ত্র কি?
দাদা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, সময় দেওয়ার জন্য।
[সৌঃ নয়া ঠাহর পুজো সংখ্যা ২০২০]
কোন মন্তব্য নেই