Header Ads

মনীষা বাল্মিকী, শিবানী নমঃশূদ্র ও অন্যান্য

দেবাশিস ভট্টাচার্য 


হাথরাসের ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড নিয়ে গোটা দেশজুড়ে জোরালো প্রতিবাদ এবং নিন্দা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের এই শিহরণ জাগানো ঘটনার পর নারী নির্যাতনের বিষয়টি আবার চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদ, সভা, বিতর্ক, মিছিল হচ্ছে যাতে দোষীদের চরম সাজা হয় এবং এরকম ঘটনা যেন আর না হয়। কি কারণে এইসব অপরাধ হয় এবং এর থেকে নিস্কৃতির রাস্তা কি এনিয়ে পত্র-পত্রিকা এবং সোসিয়াল মিডিয়ায় আলোচনা, বিতর্ক এখন তুঙ্গে। কিন্তু আমাদের আশেপাশে, নিজের জেলায় এবং রাজ্যে কি এরকম ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে না? এইসব খবর আমরা কতটা রাখি অথবা মিডিয়ায় এইধরনের ঘটনার খবর কতটা ছাপানো হয় বা দেখানো হয়? ২০১৭ সনের এন সি আর বি প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষে সবচাইতে বেশি ধর্ষণ এবং একই সাথে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে আসামে, উত্তর প্রদেশে নয়। সংখ্যার হিসেবে সব রাজ্যগুলোর মধ্যে আসামেই সর্বাধিক ৬৬ টি ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। দেশে এই প্রথম স্থান প্রাপ্তি নিশ্চয়ই আসামের জন্য গৌরবজনক খবর নয়। এরপরেই আছে মধ্যপ্রদেশ (৪৬), উত্তর প্রদেশ (৪১) এবং হরিয়ানা (২৬)। অথচ পার্শ্ববর্তী রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ, নাগালেন্ড, মনিপুর, ত্রিপুরায় এইধরনের কোনো ঘটনা নেই এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাকিসব রাজ্য মিলিয়ে মোট পাঁচটি এইধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা উত্তরপূর্বের মধ্যমনি আসামের তুলনায় অতি নগণ্য। একইভাবে সিকিম, জম্মু কাশ্মীরে এরকম একটাও ঘটনা নেই। 

আবার এইধরনের ঘটনা নিয়ে ভারতবর্ষের জেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যান দেখলে আরও আশ্চর্যান্বিত হতে হয়। করিমগঞ্জের শিবানী নমঃশূদ্র হত্যাকান্ড সাম্প্রতিক উদাহরণ। দেশের প্রথম দশটি কুখ্যাত জেলার মধ্যে ছয়টি জেলাই আসামে। ২০১৭ সনে শিবসাগর জেলাতেই আসামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫ টি একক বা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে যা দেশের জেলাগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর পরেই আছে কাছাড় (১২), হোজাই (৯), নলবাড়ি (৮), কামরূপ (৭) এবং কোকড়াঝার (৬); ভারতবর্ষের জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী  যথাক্রমে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, নবম এবং দশম। কেরালায় মাত্র একটি ঘটনা এবং পশ্চিমবঙ্গের গোটা রাজ্যে এইধরনের ঘটনার সংখ্যা (৬) কাছাড় জেলার অর্ধেক। তাৎপর্যপূর্ণভাবে  কাছাড় জেলার প্রসঙ্গে মহিলা নির্যাতন সংক্রান্ত আরেকটি পরিসংখ্যান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটা হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের যৌনকার্যে নিয়োজিত করা (Procuration of minor girls under Section 366A of IPC)। ভারতবর্ষে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিরুদ্ধে এইধরনের অপরাধ সবচাইতে বেশি সংগঠিত হয় আসামের কাছাড় জেলায়। ২০১৭ সনে ৩২২ টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কাছাড়ে। রাজ্যগুলোর মধ্যে এই ধরনের অপরাধ  আসামেই সর্বাধিক (১১২০)। একই সময়কালে ভারতবর্ষে সর্বমোট ৩০৫০ টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।   

প্রশ্ন হলো ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্য, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী সব রাজ্যের তুলনায় আসামে  ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড কেন এতো বেশি সংগঠিত হয়? স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আসামের পার্শ্ববর্তী প্রায় সব রাজ্যেই মহিলা নির্যাতন সংক্রান্ত মামলায় চার্জশিট রেট্ আসামের তুলনায় অনেক বেশি, যেমন মিজোরামে ৯৭ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ৯৫.১ শতাংশ, ত্রিপুরায় ৮৫.৪ শতাংশ ইত্যাদি। আসামের ক্ষেত্রে মাত্র ৫৭.২ শতাংশ। তবে শুধুমাত্র ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা নিয়ে আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই। তথাপি একটা ইঙ্গিত নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। আদালতের ভূমিকাও অত্যন্তঃ নিরাশাজনক। নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলায় কনভিকশন রেট্ মাত্র ৪.৪ শতাংশ। তবে লক্ষ্য করা যায় যে পীড়িত মহিলা অথবা কিশোরী বা শিশু সমাজের মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হলে প্রশাসন সাধারনত খুবই শক্ত ভূমিকা পালন করেন। তৃষা অপহরণ ঘটনা উদাহরণ। তাই সমাজের উচুতলায় এইধরনের ঘটনা তুলনায় অনেক কম। আক্রান্তরা বেশীরভাগই দলিত,প্রান্তিক শ্রেনীর। এটা হলো সমস্যার শ্রেণী চরিত্র। সুতরাং শ্রেনী নির্বিশেষে এইসমস্ত মামলায় আদালত এবং পুলিশ প্রশাসন যদি সক্রিয় এবং দক্ষ ভূমিকা পালন না করে তাহলে এই ধরনের ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না। 

প্রশাসন এবং আদালতের ভূমিকা ছাড়াও সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণ এবং হত্যা সংক্রান্ত মামলায় গোটা ভারতবর্ষে উচ্চস্থান (!) দখলকারী শিবসাগর এবং কাছাড় জেলায় যে প্রতিমাসে গড়ে একটি করে ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড হয়ে যাচ্ছে, কাছাড়ে গড়ে প্রতিদিন একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে অসৎকাজে নিয়োজিত হচ্ছে সেসব নিয়ে প্রতিবাদ, সভা, বিতর্ক, মিছিল ইত্যাদি হয় কি? হাথরাসের মতো প্রতিক্রিয়া দিয়ে মিডিয়া উত্তাল হয় কি? যদি না হয় তবে তার  কারণ কি হতে পারে? শুধুই কি প্রশাসনের দুর্বলতা অথবা নির্লিপ্ততা? জনসাধারণও কি একইভাবে নির্লিপ্ত বা উদাসিন নয়? কারণ কোনো প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে প্রশাসন অথবা বিচার ব্যাবস্থা এইভাবে চাপহীন নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। তাই এইধরনের ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের সাথে মিডিয়া এবং মানুষের প্রতিক্রিয়া-হীনতার কারণ অনুসন্ধানও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। প্রয়োজন এক গভীর আত্মবিশ্লেষণ। আর তা না হলে এইধরনের নারী নির্যাতনের বিষয়টি রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে নেহাত এক "গরিবী হঠাও" জাতীয় সুবিধাবাদী হাতিয়ার হয়েই থাকবে, এর বেশি কিছু নয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.