আজ হেমন্তের দ্বিতীয় দিন--হেমন্ত আসিছে আজ প্রকৃতিজুড়ে !!
মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির জমতে শুরু করেছে
ঘাসের ডগায়,
ধানের
শীষের প’রে। আদিগন্ত মাঠ জুড়ে এখন ধানের
প্রাচুর্য। হলুদে-সবুজে একাকার অপরূপ প্রকৃতি। চারদিকে ধূসর আবহ ঘিরে রাখছে। শেষ
বিকালে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে শিশিরের শব্দের মতো নামছে সন্ধ্যা। ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর / হলুদ
গাঁদা চিঠি লেখে / কোন পাথারের ওপার থেকে / আনল ডেকে হেমন্তকে...আজ সেই পয়লা
কার্তিক। আবহমান বাংলায় ষড় ঋতুর পরিক্রমায় দুয়ারে তার পদধ্বনি !
শরৎকালের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত।
নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত
হচ্ছে শীতের আমেজ। গ্রামীণ জনপদে এখন হালকা শীতের আমেজ। আকাশ থেকে খণ্ড খণ্ড মেঘ
সরে গিয়ে উদোম হয়েছে বিশাল নীল আকাশ।
কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায়— ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-/ হিমের ঘন
ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে
মাখা।/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার
দানে...।
গত শনিবার আশ্বিনের শেষ সূর্যটার সঙ্গে সঙ্গে
নগরের তপ্ত শ্বাসও অস্ত যাওয়ার কথা, কিন্তু জলবায়ুর যে নিত্য বদল, তাতে এ গরম আরো কিছু দিন থাকবে
মনে হচ্ছে। অগ্রহায়ণে ধান কাটার সাথে সাথে জেঁকে বসতে শুরু করবে শীত।
হেমন্তকে স্পষ্ট করে চেনা যায় ভোরের শিশিরে।
খুব ভোরে একটি শীতল বাতাসে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু অপার্থিব
দৃশ্যমালা রচনা করে। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়-- ‘লিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে
আমি / নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/ শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে-ধীরে খ’সে;/ নিমের শাখার থেকে একাকীতম এক পাখি নামি / উড়ে
গেলো কুয়াশায়,--কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...।’
হেমন্ত জীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য সময় হয়ে
ওঠে। বর্ষার পরে এই সময়ে বৃক্ষ রাজি থাকে সবুজে ভরা। ভরা থাকে খাল-বিল নদী-নালা।
বিল জুড়ে সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের সমারোহ। এই হেমন্তের দুটি রূপ প্রতিভাত হয়।
প্রথম মাসটির এক রূপ। পরেরটির অন্য। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল
হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল
ফুরিয়ে যেত এ সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা
হতো ‘মরা কার্তিক’। কবি গুরুর কবিতায়ও আভাস পাওয়া
যায় মন্দ্রাক্রান্ত কার্তিকের। কবিগুরু লিখেছেন--‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/ কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’
অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। নবান্নের এই মাস
সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের।
হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে
ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকোতে ব্যস্ত। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। দিনে
দিনে বদলাচ্ছে সেই হিসাব-নিকাশ। এখন আগের সে অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে
মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও কিছুটা হলেও
বেড়েছে । পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা
ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। অগ্রহায়ণ পুরোটাজুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব।
বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে ততই
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত
কমবে তত শীত বাড়তে থাকবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এখন প্রকৃতি যেন আর
নিয়ম মানছে না। কেমন খামখেয়ালী হয়ে উঠেছে ! এবারে তো ভারতের ওপর দিয়ে বেশ বড় মাপের
শৈত্যপ্রবাহ মানুষকে একেবারে জমিয়ে দেওয়ার উপক্রম করবে বলে আশঙ্কা করছেন
আবহাওয়াবিদরা !!
কোন মন্তব্য নেই