Header Ads

লামডিং শহর পত্তনের কথক ; দুর্গা মোহন পাল

আশিষ কুমার দে



গত ২১ আগস্ট রাত ১২টা ৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চলে গেলেন দুর্গা মোহন পাল,পাল বাবু নামেই পরিচিত বয়স হয়েছিলো ৮৭ বছর । ওনাকে স্মরন করতে গিয়ে এত কথা মনে পরে গেলো যে তা গুছিয়ে লেখার  ক্ষমতা আমার নেই ।  
এক অফিসে কাজ করার ফলে ওনার সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ দিনের, বয়েসের ব্যবধানে প্রথমদিকে অন্তরঙ্গতা না থাকলেও ধীরে-ধীরে ঘনিষ্টতা বাড়ে, উনি ৩১ অক্টোবর ১৯৯১ সালে চাকুরি থেকে  অবসর নেন। উনি Mechanical department এ কেরানি হিসাবে  জয়েন করেন ১৯৫৭ সালের ৩১শে আগস্ট  পরে Personnel department তৈরি হলে চলে আসেন।   
দুর্গা বাবুর ছিল প্রখর স্মৃতি শক্তি ; ২০০৭ সালে  National Science Children’s Science Congress অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমরা ছিলাম আয়োজক, আমাকে লামডিং শহর সম্পর্কে স্মরনিকায় লিখতে বলা হয়, আমি যে দুই প্রাচীন ব্যক্তির শরণাপন্ন হয়েছিলাম তাঁরা হলেন স্বঃ অমৃত লাল লোধ ও স্বঃ দুর্গা মোহন পাল  আমার কাছে সম্বল ছিল রেলওয়ের কিছু পুরান রেকর্ড ও একটি ১৯৪৪ সালের নক্সার প্রতিলিপি । দুর্গা বাবু লামডিং রেল শহরের পত্তন, বিন্যাস, মাইগ্রেশন ও একে ঘিরে বসতি স্থাপনের(বস্তী) ঘটনাক্রম অনর্গল বোলতে পারতেন ।  তার দেওয়া তথ্য সকলের সাথে ভাগ না করলে চিরঋণী হয়ে থাকব। 
 লামডিং ভৌগলিক রুপে মিকির পাহাড়ের একটি অংশ বিশেষ এবং একটি Plateau (মাল্ভুমি) এর চারপাশে  সংরক্ষিত বনাঞ্চল, আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের এই অঞ্চলে প্রবেশের আগে এটি একটি দুর্গম এলাকা ছিল। এখানে মূলত বাস করতেন কারবি, ডিমাসা, কাছাড়ি ও নাগা উপজাতিরা, ১৮৯০ সালের প্রথমদিকে ABR ( Assam Bengal Railway) Company, জরিপ করে লামডিং কে কুমিল্লা-বদরপুর- লামডিং ও গৌহাটি এর সাথে জঙ্কশন হিসাবে নির্ধারিত করেন। এ অবধি বরাক উপত্যকায় ট্রেন যোগাযোগ ছিল মহিষাদল হয়ে বদরপুর পর্যন্ত । পরবর্তী লক্ষ্য উত্তর কাছাড় পাহাড়ের বুক চিরে হাফলং হয়ে লামডিং, এই দুর্গম পথে লাইন পাততে সময় লাগে প্রায় দশ বছর, সাহায্য নেওয়া হয়েছিল সুদূর আফগান থেকে নিয়ে আসা শ্রমিক্‌ উট, ও হাতির। ১৯০৩ সালে এই সংযোগ স্থাপন হয়েছিল, এর মধ্যে ১৯০০ সালে গৌহাটি – লামডিং মিটার গেজ লাইন পাতা শেষ ।    
১৮৯৮ সালে কুমিল্লা-বদরপুর রেল যোগাযোগের পর বদরপুর হয়ে ওঠে রেলওয়ে সাব ডিস্ত্রিক্ট, লোকো শেড, ক্যারেজ ও মালপরিবহনের অন্যতম কেন্দ্র; বদরপুঘাট, একই ভাবে  বিস্তার লাভ করে লোয়ার  হাফলং ও হাফলং টাউন । এই সময়ে জীবিকার সন্ধানে রেল স্টেষনের ধার দিয়ে বসতি স্থাপন করেন সংলগ্ন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি, শ্রীহট্ট, সন্দ্বীপের বহু লোক । পরিকাঠামো উন্নত করতে তৈরি হতে থাকে একে একে, লোকোশেড, লোকো রিপেয়রিং শপ, ক্যারেজ শেড, পাওয়ার হাউস, হাসপাতাল ও রেলওয়ে কর্মচারীদের জন্য কোয়ার্টার, বিশাল বাংলো । হাজার কয়েক কর্মচারী ও উচ্চপদাধিকারিদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, ধোপা, নাপিতের প্রয়োজন মেটাতে  পেশাগত কাজ জানা সম্প্রদায় ; এছাড়াও অনেক এমন কাজ ছিল যার জন্য স্থানীয়ভাবে অনেক দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের  দরকার হয়ে পরে । ১৯১৪ সালের বিশ্ব যুদ্ধের সময় এই স্থানের গুরুত্ব প্রচুর বেড়ে যায়, ইতিমধ্যে সাদিয়া-ডিব্রুগড়-চট্টগ্রাম সরাসরি মিটার গেজ মালপরিবহন শুরু হয় ।  এই সময়ে রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ একটি Master Plan তৈরী করে লামডিং রেলওয়ে কলোনি, রেলওয়ে বাজার, খেলার মাঠ, ইন্সিটিউট, গির্জা, মন্দির (কালিবাড়ি) শশ্মান ঘাট, ক্রিশ্চিয়ান কবর স্থান, হাসপাতাল পানীয় জলের ফিল্টার  প্ল্যান্ট এর নির্মাণের কাজ শুরু করেন । পুরো রেলওয়ে এলাকার জল নিষ্কাশন এর জন্য পাকা নালা-নরদমা গুলির বিভিন্ন স্তরের Network করা হয়েছিলো । এই  বিশাল নির্মাণ কাজে ব্যবহার্য  ইটের চাহিদা মেটাতে রেলওয়ে নিজেই শুরু করে ইট ভাঁটা (বর্তমানে ব্রিক ফিল্ড), পাথর  সরবরাহ হতো মাইবং এর  Rly. Stone quarry থেকে।  সেই নক্সায় দেখা গেছে  Officer Colony, Loco Colony, Crossing gate, Sweeper Colony, Medical Colony, Babu Patty, DTS Hill, Mistry Patty, Office Colony ও Kalibari Colony. পুরনো পোস্ট অফিসের সামনে থেকে সরাসরি চওড়া রাস্তা চলে যেত রেলওয়ে বাজার-মাছবাজার  পর্যন্ত, রেল লাইনের সমান্তরাল ছিল পাকা ধোবি ঘাট, ও বার্মা সেলের তেলের ডিপো । রাস্তাগুলির নাম ছিল ইউরোপিয়ানদের নামে।  ব্যবসায়ীদের থাকার জন্য লিজের মাধ্যমে জমি দেওয়া হয়েছিল তারা এই জমিতে বসত বাড়ি, দোকান ইত্যাদি নির্মাণ করেন । এর অনেক তথ্য দুর্গা বাবুর মুখ থেকে শোনা। 
ওনার কথায় জানা যায় হরুলংফার নদীর পাড়ে অল্প কিছু Semi pukka quarter ছিল, এর পরেই নাগাদের বসতি, পুব লামডিং, রেল লাইনের পার হলেই পুরোটাই জঙ্গল এবং কারবি-ডিমাসা- কাছাড়িদের বাস, অফিসার কলোনির সাথেই ছিল জঙ্গল যা লোকো কলোনি কে বেষ্টন করে বর্তমান সাউথ হিল হয়ে ফরেস্ট টিলা ও কালিবাড়ি পর্যন্ত  প্রসারিত ছিল । 
দুর্গা বাবুর পিতা স্বঃ যামিনি কুমার পাল, ছিলেন সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ, ও প্রনব বিদ্যাপীঠের শিক্ষক , তিনি ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর ৬৯ বছর বয়েসে মারা যান, তাঁর জন্ম হয়েছিলো নোয়াখালী জেলার নারায়নপুর গ্রামে সেখান থেকে চলে আসেন লামডিং জীবিকার সন্ধানে ।  দ্বিতীয় পুত্র মনমোহন পাল  লামডিং কলেজে শিক্ষকতা করতেন ও অপরিণত বয়সে মারা যান ।  
 দুর্গা বাবু রেলওয়েতে চাকুরি করলেও থাকতেন সরকারি হাসপাতালের সামনে পৈত্রিক বাসস্থানে,  ফলে তার সাথে স্থানীয় জনগণের যোগাযোগ ছিল নিবিড়। অবসর নিয়ে উনি সক্রিয় সমাজসেবা শুরু করেন, ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি’র সভাপতি, ২০০২ সালে পুরসভার উপাধাক্ষ, পেনশনারস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মাধক্ষ্য, সাধূকুটি হনুমান মন্দিরের সভাপতি, তিনি স্বরুপানন্দের শিষ্য ছিলেন ও আজীবন তাঁর কর্ম জীবনের মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, তার উপস্থিতি সর্বক্ষেত্রেই লক্ষণীয় উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে ।  লামডিং শহরের আইন শৃঙ্খলার সমস্যা হলে ওনাকে প্রশাসনের তরফে সমাধান করতে আমন্ত্রন করা হত। পেনশন অফিসে সোম থেকে শনি নিয়মিত আসতেন । 
ঘরোয়াতে তার নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল, ঘরোয়ার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে সম্বর্ধিত করা হয় । ওনার মৃত্যুর ফলে আমরা একজন সৎ, দায়িত্বশীল নাগরিককে হারালাম, লামডিং হারালেন একজন ‘কথক’কে যিনি অনর্গল লামডিংর “Evolution” বর্ণনা করতেন । রেখে গেলেন শোকসন্তপ্ত, স্ত্রী, দুই পুত্র-পুত্রবধু, তিন কন্যা-জামাতা, নাতিনাতনি সহ একাধিক আত্মীয় পরিজনদের ও অসংখ্য গুন্মুগ্ধদের ।     

- ঘরোয়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, 
বেঙ্গালুরু

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.