Header Ads

ইতি(হাস)কথায় দার্জিলিং !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
নেপাল থেকে দলে দলে নেপালী তথা গোর্খা জনগোষ্ঠী দার্জিলিংয়ে এসে বসতি স্থাপন করার ধারাবাহিকতা আজও বজায় রেখে দাবি করে থাকে তারাই দার্জিলিংয়ের ভূমিপুত্র বা আদি অধিবাসী। কিন্তু দার্জিলিংয়ের ইতিকথা বা ইতিহাসে এই দাবির পক্ষে একটি শব্দও নেই--সত্যি বলতে কি এদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবেই চিহ্নিত করে এসেছে। ইতিহাসে স্পষ্ট করেই দার্জিলিংয়ের জন্মকথা থেকে তার শীর্ষস্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত লেখা রয়েছে। ইতিহাসের পাতা উল্টে সেটা দেখার আগে এটাও বলে নেওয়া দরকার দার্জিলিংকে বিতর্কিত ভূখণ্ড হিসেবে দেখার বা দেখানোর রাজনীতি কিন্তু এখনও জোরদারভাবেই চলেছে। বিতর্ক এখনও থামে নি--তার কারণটা শুধুমাত্র রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
 
প্রকৃতপক্ষে দার্জিলিং ছিল সিকিম রাজ্যের অধিকৃত ভূখণ্ড। নেপাল থেকে এসে গোর্খারা এই ভূখণ্ডটি বার বার দখলের চেষ্টা করতে করতে কমবেশি বসতি স্থাপনে সফল হয়েছিল। দার্জিলিং নেপাল সংলগ্ন বলেই নেপালী তথা গোর্খা জনগোষ্ঠীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এই নেপালের সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে ১৮১৪ সালে নেপালের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধও হয়েছিল। সেই যুদ্ধের ফলে নেপাল সিকিমের যে সমস্ত এলাকা দখল করেছিল তার সবটাই ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। ইংরেজরা সেইসব ভূখণ্ড সিকিম অধিপতিকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এর মধ্যে একটা চুক্তিপত্রও তৈরি হয়েছিল। ইংরেজ সেই মুহূর্ত থেকে সিকিমের অভিভাবক হিসেবে মান্যতা পাওয়ার পাশাপাশি সিকিমের সঙ্গে নেপাল বা অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসার দায়িত্ব থাকবে ইংরেজদের ওপরেই--চুক্তির এই শর্ত সিকিম অধিপতি মেনে নিয়েছিলেন।
এর কিছুকাল পরেই নেপাল ও সিকিমের মধ্যে ফের বিরোধের সূত্রপাত হয়। লাট সাহেবের ওপর তার বিচারের ভার ন্যস্ত হয়। তদনুসারে লাটসাহেব ১৮২৮ সালে লয়েড সাহেবকে বিরোধের যাবতীয় কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিতর্কিত অঞ্চলে পাঠান। লয়েড ও তাঁর সহযোগী গ্রান্ট সাহেব রিঞ্চিনপং পর্যন্ত গিয়েছিলেন এবং তাঁদের এই যাত্রাপথের মধ্যেই ছিল দার্জিলিং। তাঁরা দুজনেই দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্য্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক্ হয়ে গিয়েছিলেন। লয়েড ১৮২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছ-দিন মাত্র দার্জিলিং দেখেছিলেন--তাঁর আগে কোনো ইউরোপবাসী দার্জিলিং দেখেছেন এমন কোনো প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।
লযেড এবং গ্রান্ট উভয়েই দার্জিলিং দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন--স্বাস্থ্যের জন্য, ব্যবসার জন্য এবং নেপাল-ভূটানের দ্বারদেশে সামরিক উদ্দেশ্যে ঐ জায়গাটা যে ইংরেজদের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় সেটা তাঁরা তদানীন্তন বড়লাট বেন্টিঙ্ক সাহেবকে দার্জিলিংকে স্বাধিকারভুক্ত করার জন্য পরামর্শ দেবেন। দিয়েওছিলেন পরামর্শ এবং সুযোগও দ্রুত এসেগিয়েছিল। কতগুলো নেপালী-গোর্খা লেপচা অধ্যুষিত সিকিমে উৎপাত শুরু করায় লয়েড তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেন এবং নেপালী-গোর্খাদের স্বদেশে ফিরে যেতে বাধ্য করেন।
এর পরেই ১৮৩৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একটি দলিল সম্পাদিত হয় এবং ঐ দলিল মোতাবেক সিকিম রাজ ইংরেজ শাসকের হাতে বিনামূল্যে দার্জিলিং সঁপে দেন। দলিলে লেখা ছিল--‘লাটসাহেব দার্জিলিং শৈল এলাকাটি পাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন--কারণ, দার্জিলিং শীতপ্রধান অঞ্চল; সরকারি কর্মচারীরা অসুস্থ হলে ঐ স্থানে এসে স্বাস্থ্যলাভ করতে পারবেন। তার জন্য লাটসাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্কে যুক্ত আমি সিকিমাধিপতি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে দার্জিলিং দান করলাম।’
সিকিমাধিপতি কোনো মূল্য বা সমতুল্য কোনো অঞ্চলের দাবি করেন নি। তখন তার মূল্যও তেমন কিছুই ছিল না। তবুও ইংরেজ-রাজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই প্রথমতঃ বার্ষিক তিন হাজার টাকা, পরে সেই অঙ্ক বাড়িয়ে ছ-হাজার টাকা করে দিয়ে এসেছেন। ইংরেজাধিকারে এসে দার্জিলিংয়ের লোকসংখ্যা হু-হু করে বাড়তে শুরু করে দিয়েছিল। ১৮৩৮ সালে দার্জিলিংয়ের অধিবাসী সংখ্যা, অবিশ্বাস্য মনে হলেও মাত্র ১০০ জন ছিল। সেই জনসংখ্যা ১৯০১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২,৪৯,১১৭ ! এর মধ্যে শুধুমাত্র দার্জিলিং শহরেই জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৬,৯২৪ জনে। ইংরেজ সরকারের হস্তগত হওয়ার পর দার্জিলিংয়ে অসংখ্য সরকারি নির্মাণ ও স্থাপনা মাথা তুলেছিল এবং তখন থেকেই দার্জিলিং বাংলারই একটি জেলা হিসেবে মানচিত্রে উঠে আসে। তখন থেকেই দার্জিলিং বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। নেপালী বা গোর্খাদের ভূমিপুত্র হিসেবে দাবির তাই কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে কেউ মনে করেন না।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.