Header Ads

অভিশপ্ত ২০২০ আমৃত্যু গাঁথা থাকবে মানুষের মনে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

প্রতিদিন খবরের কাগজের হেড-লাইনে মৃত্যুশীতলতার স্পর্শ। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে লক্ষ-লক্ষ মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে প্রবল চিৎকার--আতঙ্কের আবহ তৈরির মরিয়া প্রয়াস। গান-পাগল মানুষেরও গানে অরুচি ধরে যাচ্ছে, সিনেমা-নাটক-সিরিয়ালও সেভাবে টানছে না। যে নারী বা যে পুরুষ বাইরে থাকছে তাকে নিয়ে প্রবল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। বেঁচে থাকা না থাকা নিয়ে হিমশীতল অনিশ্চয়তার এই সন্ধিকালের মুখোমুখী হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না মানুষের।


বিশ্বে এক নম্বর হয়ে ওঠার মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত নেশাই এই প্রাণঘাতী মহামারী ছড়িয়ে দিল সারা বিশ্বে ! যারা ছড়ালো তাদের পরিণতিও অনেকেই প্রত্যক্ষ করে যাবেন হয়তো--কিন্তু এই মুহূর্তে যা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে তার বীভৎসতার কোনো তুলনা হয় না একেবারেই !

হাজার হাজার মানুষ পটাপট মারা যাচ্ছে--মৃত্যুশয্যায়ও সাড়ে তিন হাত ঠাঁই নেই এখন। বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। চিকিৎসা নেই--একটা শেষ শয্যাও নেই। মৃত্যুপথযাত্রীদের ছুটিয়ে মারা হচ্ছে এক দরজা থেকে আর এক দরজায়। কোথাও ঠাঁই মিলছে না। এই পরিস্থিতি চোখে দেখা তো দূরের কথা--মানুষের দুঃস্বপ্নেও কখনো উঁকি মারে নি।
লোহার শিকে আটকে মৃতদেহ ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে তোলা হচ্ছে সেইসব মানুষের দেহ--হাসপাতালে পড়ে থাকা সেইসব মানুষের দেহ খুবলে খাচ্ছে কুকুর--রাস্তায় রাস্তায় দম আটকে বিনা চিকিৎসায় বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকছে সেইসব মানুষের দেহ যাদের সকলের মধ্যেই হৃদয় ছিল, তাদের সকলের ওপরেই কোনো না কোনো মানুষের ভরসা ছিল প্রয়োজনীয়তা ছিল,  তাদের  সকলের জন্যেই মায়া-মমতা-যৌনতা-মানসিক ও সামজিক বন্ধনও ছিল। শুধু ছিল না এই মর্মান্তিক পরিণতির কোনও রকম সম্ভাবনার আভাস ! শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা মানুষই হোক বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্তই হোক--হাসপাতাল জায়গা দিচ্ছে না করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট না থাকলে ! পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে এমন ঘটনার কথা এখনও শুনি নি। একজন নাগরিক নিয়মিত কর দিচ্ছে (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ), ভোট দিয়ে রাজনৈতিক পামরদের হাত ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে কি এইভাবে কুকুর-বেড়ালের মতো পথে-ঘাটে প্রাণ দেওয়ার জন্যে? ডাক্তার তাকে ছোঁবে না, হাসপাতাল তাকে শেষশয্যার আশ্রয়টুকুও দেবে না--সীমাহীন কালোটাকা না থাকলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাও হবে না--হলেও সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে হবে?
পৃথিবীর কোথাও এই ধরণের চূড়ান্ত অমানবিক অসভ্যতার খবর আমি খুঁজে পাই নি। আমি দেখেছি গণ-কবর খোঁড়ার দৃশ্য, দেখেছি হাসপাতাল উপচে পড়া রুগীর ভিড়ের মধ্যেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিস্ময়কর মানবিক আন্তরিকতা। মানুষের প্রতি মানুষের জাগ্রত বিবেকের ছবিই দেখেছি। কিন্তু আমার এই পোড়া দেশে তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাচ্ছি কি? এদেশের নিরন্তর প্রগলভতায় অভ্যস্ত চিকিৎসক-গবেষকরা গ্রাম-শহরে গিয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছেন না যে মৃতদেহ সৎকার না করাতেই বিপদ কত বাড়তে পারে এবং সৎকার থেকে করোনা-ভাইরাস ছড়ায় না। তাঁরা যেমন এটা বোঝাতে যাচ্ছেন না বা বোঝানোর অবশ্যিকতা অনুভব করছেন না--ঠিক তেমনই অপদার্থ অসহায় (রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীন) প্রশাসনও কারফিউ বা ১৪৪ ধারা জারি করে মৃতদেহগুলি সৎকার করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এই ধরণের মারাত্মক পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের পথে প্রতিপদে রাজনৈতিক বাধা বাধ সেধে চলেছে। কারণ ঐ একটাই--ভোট বড় বালাই। সুতরাং প্রতি মুহূর্তে মানুষের শিরদাঁড়ায় কম্পন দেখা দেবেই--এক শ্রেণীর ক্ষমতা ও অর্থপিশাচ শবসাধক তাদের তন্ত্র সাধনা চালিয়ে যাবেই--আর এক শ্রেণীর মানুষ তার শেষ মুহুর্তেও জেনে যেতে পারবে না--তার অপরাধটা কি ছিল !
একদিকে করোনা ভাইরাস মৃত্যুর মোচ্ছব চালিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে শবসাধকদের মৃতদেহের তৃষ্ণা মিটছে না। এই আবহেও খুনোখুনির উল্লাসে তারা মাতোয়ারা হচ্ছে--যারা হচ্ছে তারা যে তথাকথিত জানোয়ারদেরও লজ্জা দিয়ে চলেছে সেই বোধটাই এইসব মানবেতরদের মধ্যে কাজ করছে না। চারপাশে হাজার হাজার মানুষের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু মিছিলের মধ্যেও রক্তাক্ত হানাহানিতে যাদের এত রুচি তাদের কোন বিচারে মানুষ বলে মনে করা সম্ভব? এইসব নরপিশাচদের জন্যেই তো আজ এই পরিস্থিতি--বিবেক লুপ্ত এক নতুন সমাজ গড়ে উঠছে দেখতে দেখতে !
২০২০ তাই অভিশপ্ত চিহ্নিত হয়ে গেল বিশ্বের বুকে। কত দ্রুত বদলে দিল মানব সমাজের চিরচেনা প্যাটার্নটাই। বদলে দিল সম্পর্কের সমীকরণ। হৃদয়হীনতার যে নতুন মানচিত্র তৈরি করে দিল করোনা-ভাইরাস তাতে খুব স্বাভাবিকভাবে মানুষ আর শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ-বর্জন করতে পারবে না। খুবই সংক্ষিপ্ত করে নেবে নিজস্ব ভুবনটিকে। সেই ভুবনডাঙায় আর আদিগন্ত সবুজ মাঠ থাকবে না--থাকবে না শিশিরে পদচোরণার কোনো চিহ্ন। সংশয় সন্দেহ আর অচেনা অজানা কাঁটা ছড়ানো পথেই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে যেতে হবে ২০২০ সালের পরেও জীবিত থেকে যাওয়া মানুষদের !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.