Header Ads

করোনা নিয়ে একটার পর একটা ভাইরাল খবর, ভয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে

অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার যুব ডাক্তার সাকলাইন রাসেল সম্প্রতি করোনা-র এফেক্টে একটি অন্য মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। সেটি হলো অনবরত অকারণ নানা রোগের ভয়। এই বুঝি আমার কিছু হলো~এইরকম ভাবনা। 
  গুয়াহাটির একটি নামকরা হাসপাতালের স্বাস্থ্যবিষয়ক বুলেটিনেও এরকম বলা হচ্ছে~

"একটার পর একটা ভয়ের খবর, সামাজিক দূরত্বের বাধ্যবাধকতা আর পাড়াপ্রতিবেশী, সঙ্গীসাথি লোকজনের সাথে কথা বলে মন হালকা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে করোনা মহামারি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে যে জর্জরিত করবে তা এক প্ৰকার নিশ্চিত বলে মত প্ৰকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পুব এশিয়াৰ আঞ্চলিক সঞ্চালক ডা: পুনম ক্ষেত্ৰপাল সিং৷ তিনি বলেন~ 
"এই মহামারি মানুষের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, শঙ্কা আর হতাশা বাড়িয়ে তুলেছে৷ সামাজিক দূরত্বের জন্য অন্যের থেকে দূরে থাকা আর প্ৰতি মুহূর্তে পরিবর্তিত তথ্যপাতি বিষয়ে অবগত হয়ে থাকার ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটা স্বাভাবিক, কর্তৃপক্ষ তাই এই দিকের প্ৰতিও সচেতন হওয়া উচিত।"
•••
  করোনা-সময়কালেই বিশ্ব জুড়ে বহু মানুষের মনে একটা ভয় ত্রাস ঢুকে গেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ মিডিয়া। সাধারণ কথাকে অতি নাটকীয় ঢঙে মেলোড্রামা করে পরিবেশন করে বেশির ভাগ চ্যানেল। সঙ্গে থাকে উৎকট বাজনা। সাথে উত্তেজনা। নানান মশলা। অনেক সময় বীভৎস সব বিশ্লেষণ। তর্কাতর্কি। শ্বাসরুদ্ধ বিতণ্ডা। টিআরপি বাড়ানোর তালে এরা যা খুশি তা-ই করছে। 
      টিভি নামক এই মানসিক অত্যাচারের ভয়ংকর প্রভাব যে মানুষের মনে অনবরত পড়ছে~সেই সাবধানবাণী শুনিয়েছেন স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্ণধার। করোনা উপলক্ষে তাঁর একটি ভিডিওতে দেখলাম, তিনি বলছেন~টিভির খবর লাগাতার দেখবেন না, সকালে বিকেলে নজর রাখুন~পরিস্থিতির দিকে। বরং নাচে গানে নানা হবিতে মত্ত থাকুন। 
   টিভির খবর না-হয় এড়িয়ে চলা গেল! কিন্তু মোবাইল?! সেটা তো নিত্যসঙ্গী~এমনকি শয্যাসঙ্গী। অনেকে আমাকে বাথরুম থেকেও ফোন করে। কী অদ্ভুত!! মোবাইলে তো সোশ্যাল মিডিয়ার তাণ্ডব। কত রটনা, কত ঘটনা! টিভি যায় ডালে ডালে, মোবাইল যায় পাতায় পাতায়। পোর্টাল এসে গেছে। অজস্র লাইভ। এ বলে আমাকে দ্যাখ্, ও বলে আমায়। ইমিউনিটি বাড়ানোর হাজার নিদান। ইউটিউবে শয়ে শয়ে বিশেষজ্ঞ। সবার আবদার~প্লিজ আমারটা সাবসক্রাইভ করুন। প্রায় হাতে-পায়ে ধরার উপক্রম। 
    এসবের ঘূর্ণিপাকে আমরা ঘুরছি। পাজল্ড। কনফিউশন। আর উৎকণ্ঠা বাড়ছে। 
•••
   উৎকণ্ঠার নানা প্রকার। ইংরেজিতে বলে~Anxiety। পাশাপাশি নানা ফোবিয়া (Phobia) বা আতঙ্ক। শুনলে অবাক হবেন~শতাধিক ফোবিয়া আছে। এবং এর নানা নামও রয়েছে। আরশোলার ফোবিয়া তো হিন্দি সিনেমার পপুলার এলিমেন্ট। "মিস্টার ইন্ডিয়া"-তে শ্রীদেবী আরশোলা দেখে চিল-চিৎকার করেছিলেন~এখনও কান পাতলে শুনতে পাবেন। সময়ের সাথে সাথে নয়া ফোবিয়া জন্ম নেয়।
    নতুন একটি ফোবিয়ায় আপনি আমি আক্রান্ত~এবং নিজেরাই সেটা জানি না। এটিকে বলা হয় নোমোফোবিয়া (Nomophobia)। এর লক্ষণ হচ্ছে সেলুলার ফোনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার ভয়ঙ্কর আতঙ্ক।
      যাইহোক, এটা ঠিক যে এইরকম বহু ফোবিয়া মানুষের মধ্যে চিরকালই ছিল। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এগুলোর কোনো কোনোটি বেড়েছে ভয়ানকভাবে। 
•••
   আর যে-মনোরোগটি এখন সবচেয়ে আলোচিত~সেটি হল রোগের ভয়। বা অনবরত রোগের দুশ্চিন্তা। বাংলায় যাকে বলে রোগের বাতিক। সত্যজিৎ রায়ের একটি বিখ্যাত গল্পের নাম "বাতিকবাবু"। এক পাগলাটে ক্ষ্যাপা প্রফেসার রাস্তার ফেলে দেওয়া নানা জিনিস কুড়োতেন। সেটা না-করে থাকতে পারতেন না। সেটাই তাঁর বাতিক। চিকিৎসাশাস্ত্রের বাংলা নাম~ বায়ুরোগ। ইংরেজিতে বলা হয়~Obsessive-compulsive disorder। এই যে করোনার ভয়ে আমরা দিনরাত হাত ধুয়েই চলছি, এটার একটা পুরাতনী নাম আছে~শুচিবায়ু। এটাও কিন্তু মনোরোগ। সন্দেহ নেই~করোনা-পরবর্তী সময়ে এটারও হয়তো বাড়বাড়ন্ত হবে। তবে হাত ধোয়ার অভ্যাসটি সুস্থ থাকার জন্য কতটা যুক্তিসংগত এবং সময়োপযোগী সেটা বোঝা যায়~বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস (Global Handwashing Day) পালনের মধ্যে। 
•••
   করোনার আতঙ্কটির নতুন রূপ অনবরত "আমার কিছু হয়েছে" ভাব। সামান্য গলা ধরা~কাশি নেই, কাশি কাশি ভাব~খুশখুশ~মাথায় চিন্তা~ করোনা হয়নি তো! কপাল সামান্য গরম~গলা শুকিয়ে গেল~পড়িমরি থার্মোমিটার~দেখি তো টেম্পারেচার কত! ঘাড়ে টনটন~বিপি বাড়েনি তো!! মাই গড এখন কী হবে! যদি স্ট্রোক হয়~অমুকের তো হলো এই সেদিন...! বুকের ভেতর চিনচিন~কী করি~হার্ট অ্যাটাক হবে না তো! এখন তো হাসপাতালে যাওয়াও রিস্কি। অ্যালার্জি ছিল বরাবর~ডাস্ট, কোল্ড~হাঁচতে হাঁচতে বড় হয়েছি অনেকেই। তাও হাঁচি শুরু মানেই যেন~করোনার থাবা! বাজারে যেতে ভয়। ঘরে শাকসবজি এনে বেকিং পাওডার দিয়ে ধুয়েও মনে খচখচ...! 
    এই যে মনোরোগ~এটাকে বলে~"হাইপোকনড্রিয়াসিস"। দাঁতভাঙা নাম। কিন্তু সারা বিশ্বে এখন এটার চূড়ান্ত বিকাশ দেখা যাচ্ছে। কাল্পনিক রোগের আতঙ্ক। রোগী নিজেই বোঝে~বিষয়টি একটা কল্পনাজনিত পাগলামি~তাও ওই অবসেশন। এই বুঝি কিছু হলো আমার~হয়েছে আমার~এইরকম ভাব। ইংরেজিতে এই রোগের শেকড়কে নাম দেয়া হয়েছে~নিউরোসিস। 
    অসমের একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক হোমেন বরগোহাঞির বয়স এখন প্রায় নব্বই ছুঁইছুই। তিনি তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায় লিখেছেন~"সমস্ত মানুষের মতোই আমারও কয়েকটি মানসিক সমস্যা আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো~anxiety neurosis বা উদ্বেগজনিত মনোবিকার। যেকোনো সমস্যার দ্বারা সহজে বিচলিত হওয়া বা খামোকা ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা করাই এই মানসিক রোগের প্রধান লক্ষণ। একসময় আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার এটাই ছিল প্রধান কারণ।"(মূল অসমিয়া থেকে অনূদিত। দ্র. "সারাংশ", পৃ. ২৫৯)।
•••
   তাহলে কি এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় নেই? হোমেনবাবু নিজে কী করে এটা থেকে মুক্ত হয়ে এখন নব্বই ছুঁলেন? 
       তিনি নিজেই সেটা লিখেছেন~"দিঘল অনুশীলনের দ্বারা নিজের মনটিকে প্রশিক্ষিত করে , আর বহু জ্ঞানগর্ভ বইপত্র পড়ে আমি এই রোগটিকে সম্পূর্ণ না-হলেও বহু পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমার নিজের মত হলো~সব সময় উদ্দেশ্যধর্মী কাজ আর চিন্তায় নিজের মনকে ব্যস্ত রাখতে পারলে কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা মনে প্রবেশ করতে সহজে পারে না।"
    ঠিক এই কথা অনেক আগেই বলে গেছেন~আমেরিকার প্রখ্যাত জীবনমুখী লেখক ডেল কার্নেগি। তিনি লিখেছেন~দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধশ্রান্ত সেনাদের মধ্যে একটি মনোরোগ ছড়িয়েছিল~নাম~"সাইকোনিউরোটিক ডিসঅর্ডার"। ভয়, আতঙ্ক~যুদ্ধের বিভীষিকা।  সেনাবাহিনীর ডাক্তারেরা নিদান দিলেন~ওষুধ নয়~ব্যস্ততাই এদের আরোগ্যের একমাত্র উপায়। মাছ ধরা, নানা রকম খেলা~ছবি তোলা~বাগান করা~নাচ ইত্যাদি। ব্যস, হু হু করে রোগ কমতে লাগল।
    অর্থাৎ নানারকম ভালো কাজে ব্যস্ততা, হবি বা শখ মানুষকে মনোরোগ থেকে অনেকটা রক্ষা করতে পারে। একসময় বাঙালি পরিবারে ষোল ঘুঁটি, দশ-পঁচিশ, লুডো, তাস, দাবা, চোরপুলিশ~কত রকম ঘরোয়া খেলা ছিল। এখন যৌথ পরিবার নেই, আর অবসর বিনোদনও নেই। পুরো অবসরই কেড়ে নিয়েছে মোবাইল। 
•••
   উইলস্টন চার্চিল লিখেছেন~মৃত্যুর আগে এক ব্যক্তি তাঁকে বলেছিল~"আমি সারা জীবন ধরে এমন কিছু সমস্যা বা ঘটনার বিষয়ে দুশ্চিন্তা করে করে নিজেকে ক্ষয় করে এলাম~যেসব ঘটনা আমার জীবনে কোনোদিনই ঘটল না।"
   এটাই চরম সত্য। বাংলাতে একটি কথা আছে~বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। করোনাকালে এই মনের বাঘকে তাড়াতেই হবে।
•••
লেখক : কটন বিশ্ববিদ্যালয়
                             গুয়াহাটি

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.