অধ্যাপক অমরেশ দত্তের প্রয়াণে নীরব নমস্কার
সঞ্জীব দেবলস্কর
আর মাত্র দুটি মাস পেরোলেই তিনি একশ দুই বছরে পা দিতেন আমরা ঠিক উপলব্ধি করতে
পারিনি এই নীরব উপস্থিতি যে ছিল একটি বিরাট সৌভাগ্য এক জীবন্ত কিংবদন্তি, বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিটি দীর্ঘ জীবন
আমাদের সঙ্গে রয়েছিলেন এই রাজ্যে, এই দেশে, এই বিপন্ন সময়েই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশভাগের কিছুটা অভিজ্ঞতা তো তিনিও পেয়ে গেছেন,
স্বাধীনতা-উত্তর
অভিজ্ঞতা---দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক দুঃসময়,
গৌরবের টুকরো টুকরো
মুহূর্তগুলো, জাতীয় জীবনে
বহুস্তরীয় সৃজনশীলতার বিকাশ, বিচ্ছিন্নতার
আগ্রাসন, চিন্তার দীনতা,
মানবিকতার অবক্ষয়,
অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে
নিষ্ফল আক্রোশ—এসবের মধ্য দিয়ে
গিয়ে সর্বশেষে বিশ্বব্যাপী অদৃশ্য মারণব্যাধী, এও তাঁকে দেখে যেতে হল। তাঁর প্রয়াণ সংবাদ
আমাদের কাছে খুব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, কিন্তু এ কোন সময়টিকে তিনি নির্বাচন করলেন, কিংবা তাঁর ভাগ্যবিধাতাই নির্ধারণ করলেন তাঁর
জন্য। আজও কান পাতলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে পাই “She
should have died hereafter, There would have been a time for such a word..” . তিনি পড়াচ্ছেন, মহাকবির নাটক ম্যাকবেথ। পত্নীর মৃত্যু সংবাদ
পেয়ে বিপন্ন, বিমূঢ় ম্যাকবেথ
উপলব্ধি করছে এ দুঃসহ বার্তা গ্রহণ করার ক্ষমতাও তাঁর অবশিষ্ট নেই, জীবন তাঁর কাছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, “অ্যা ওয়াকিং শ্যাডো—আ্যা টেল টোল্ড বাই আ্যান ইডিয়ট, ফুল অব সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি সিগনিফায়ারিং
নাথিং।’ শোক প্রকাশ করবার
অবস্থায় আমরাও কি আর আছি এ দুঃসময়ে! আমাদেরও তো অসহায়ের মতন শুধু দেখে যাওয়া এ
মহাবৃক্ষের পতন (মহাগুরুর নিপাত)
ব্যক্তিটি তো কেবল মাত্র উত্তর-পূর্ব ভারতের নন, তাঁর খ্যাতি সারা দেশব্যাপী, এবং বিদেশেও। খ্যাতিমান শেস্কপিয়ার জি, উলসন নাইট, ই এম ডবলিউ টিলিয়ার্ডও রয়েছেন তাঁর গুণমুগ্ধদের
তালিকায়। তাঁর গুণমুগ্ধ পূর্বোত্তর ভারতের হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা। জনজাতীয়
ছেলেমেয়েদের প্রতি তাঁর ছিল পক্ষপাত ; অসমিয়া বাঙালিদের তিনি কারণে অকারণে ভর্ৎসনা করতে ছাড়তেন না, তবু এরা তাঁর প্রশংসাতে পঞ্চমুখ; তাঁর মুখের বাক্যগুলো একটি প্রজন্মের মুখে মুখে
আপ্তবাক্যের মতো ফিরেছে। দু’বছর আগে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর এক অনাড়ম্বর আয়োজনে শেষ দেখার দিনে গভীর
আত্মতৃপ্তির সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমে
অদ্যাবধি তিনি কোনো দেশবিরোধী, অমানবিক কাজ,
পারিবারিক বা ব্যক্তিগত
কেলেঙ্কারিতে তাঁর কোনো ছাত্রছাত্রীর জড়িত হবার খবর পান নি। দীর্ঘ পরমায়ু নিয়ে এ
দুঃসময়ে ছাত্রছাত্রীরা যে তাঁর এ বিশ্বাস অটুট রাখতে সফল হয়েছে এ বিশ্বাস নিয়েই
তিনি বিদায় নিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের উপর এ বুঝি তাঁর ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি দায়িত্ব
চাপিয়ে যাওয়া।
শিলচর শহরের অভয়াচরণ পাঠশালা, কাছাড় হাইস্কুলে এবং গুরুচরণ কলেজ হয়ে পশ্চিম
বঙ্গ , উত্তর প্রদেশ,
মধ্যপ্রদেশের সাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে অবশেষে ফিরে এসেছিলেন নিজভূমিতে—গৌহাটি,এবং অতঃপর ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনার
দায়িত্ব গ্রহণ, সেই সঙ্গে
বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটিকে সময়ের উপযোগী ভাবে গড়ে তোলার কাজেও তাঁর আত্মনিয়োগ।
মধ্যিখানে আবার দেশের অন্যতম প্রধান সারস্বত প্রতিষ্ঠান, ‘সাহিত্য অকাদেমি’র বিশেষ প্রকল্প,যার পেছনে ছিল পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরুর দীর্ঘ
লালিত স্বপ্ন সেই ‘ভারতীয় সাহিত্যের
কোষগ্রন্থ’ (Encyclopaedia of
Indian Literature) সমাপ্ত করে একটি
বহু প্রতীক্ষিত ঐতিহাসিক জাতীয় কর্তব্য সম্পাদন করে এসেছেন।ল ১৯৮৪ সালে গৃহীত এ
প্রকল্পটিতে ছিল ২২টি ভারতীয় ভাষার সাহিত্য স্রষ্টা সহ তাঁদের সাহিত্য কৃতি নিয়ে
সাত হাজার পাঁচশোটি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রাচীন , মধ্যযুগ এবং বর্তমান কালের জাতীয় সাহিত্যের
আত্মপ্রকাশ এবং বিবর্তনের রূপরেখা তুলে ধরবার প্রয়াস। অমরেশ দত্তের সুযোগ্য
নেতৃত্বে ১৯৮৭, ৮৮, এবং ৮৯ সালে এ প্রকল্পের তিনটি খণ্ড প্রকাশিত
হয়েছে। এর পরবর্তী আরও তিনটি খণ্ড নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে এত ভাষা, এত সংস্কৃতি এত এত কর্মীদের সমন্বয়ে মহাকাব্যিক
পরিসরে এই মহা-গ্রন্থ বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে বিশেষ ভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর সহকর্মী, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড০ হীরেন গোঁহাই প্রয়াত অধ্যাপকের প্রতিভার মূল্যায়ন করে
বলেছেন, তাঁর মধ্যে একজন
পণ্ডিত, শিক্ষক এবং কবির
সমন্বয় ঘটেছিল। ইংরেজি সাহিত্যের উপর তাঁর মৌলিক চিন্তাগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতীয়ত্বের
স্বাক্ষর। কয়েকটি প্রজন্মের ছাত্র তো বটেই এ সময়ের বিশিষ্ট বিদ্বজ্জনের উপরও
অধ্যাপক অমরেশ দত্তের প্রভাব অপরিসীম।
জাতীয় জীবনের বড়ো দুর্দিনে আজ এ শিক্ষাগুরু আমাদের থেকে বিদায় নিলেন। এত
কৃতিত্বের অধিকারী এ নীরব ব্যক্তিটির কোনো খবরই রাখলেন না আমাদের দেশের পদ্মশ্রী,
অকাদেমী, জ্ঞানপীঠ সম্মান প্রদানকারীরা। রাখলে এহেন
ব্যক্তির শতবর্ষ হয়ে উঠতে পারতো একটি জাতীয় উৎসব। সবার অলক্ষ্যে শতবর্ষ অতিক্রান্ত
সচল, সক্ষম সতত সুচিন্তক এ
ব্যক্তিটি আজ (৬ আগস্ট, ২০২০) সকালে
বিদায় নিলেন। তাঁর উদ্দেশে এ অধম ছাত্রের নীরব নমস্কার।
কোন মন্তব্য নেই