Header Ads

চলছে স্বাস্থ্য নিয়ে হাস্যরস !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
থ্রি-স্টার বা ফাইভ-স্টার হোটেলের দিনপ্রতি বেড ভাড়া কত? যথেষ্ট ভাল কিন্তু তারকাখচিত নয় হোটেল বা রিসর্টের বেড ভাড়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষের স্বচ্ছ ধারণা আছে ধরে নেওয়া যেতে পারে। থ্রি-স্টার বা ফাইভ-স্টার হোটেলে দু’চার দিন বিনোদনের জন্যে বা প্রয়োজনে যাদের যেতে হয় তারা ইকোনমিক্যালি সাধরাণ মানুষ নয়--রইসদার লোক। সাধারণ মানুষ তাদের সাধ্যের মধ্যেই নড়াচড়া করতে চান--বলা যেতে পারে বাধ্য হন। আমাদের দেশের--বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং পরিকাঠামোর মধ্যে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ছন্দে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতো সামান্য একটুও স্পেস আছে বলে কিন্তু একেবারেই মনে হচ্ছে না। 
 
অথচ, এই সেদিন, দেশের প্রধানমন্ত্রী সহ গোটা বিশ্ব বিমুগ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গে শুনলো--বাংলায় চিকিৎসার জন্যে মানুষের কোনো পয়সা লাগে না--বিনামূল্যে চিকিৎসা হয় এবং এই খবরটা যেন প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন ! সেদিন ক’জন মানুষ হো-হো করে হেসেছিল আমার জানা নেই--কিন্তু আমার মতো কোটি কোটি মানুষ যে অসহায় ক্রোধে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়েছিল তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। 
 
গতকালই একটি বেসরকারি হাসপাতালের একটি বিল দেখছিলাম--সেখানে দিনপ্রতি বেডভাড়া চার্জ করা হয়েছে ১৫,০০০ টাকা ! পরীক্ষা-নিরীক্ষা-ওষুধপত্র-কনসাল্টিং ফী ইত্যাদি নানা রকম যোগ করে বিলের মোট অঙ্ক গিয়ে ঠেকেছে প্রায় সাড়ে দশলাখের কাছাকছি ! এইসব বেসরকারি নার্সিংহোম বা হাসপাতালের বেড-চাদর-বালিশ ইত্যাদি সব পারস্য বা ফ্রান্স থেকে আসে কিনা তা-ও আমার জানা নেই। কিন্তু জানি--একজন করোনা পজিটিভ রূগীকে সুস্থ করে বাড়ি পঠানোর জন্যে (উইদাউট ভেন্টিলেশন) খুব বেশি হলেও ২৫/৩০ হাজারের বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এবং ভারতীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক চিকিৎসার জন্য যে বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাতে ওর চেয়ে বেশি খরচ হবে কেন? বেসরকারি নার্সিংহোম বা হাসপাতালগুলো তাদের সাজসজ্জার খরচবাবদ না হয় দ্বিগুণ টাকা নিলেন--মানা যায়--কিন্তু একেবারে দশ-পনের-বিশ লাখ ! এ সাহস বা এই দিনদুপুরে বেলাগাম ডাকাতির ধৃষ্টতা তারা কাদের বরাভয়ে চালিয়ে যেতে পারছে? বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের মতো এইসব বেসরকারি নার্সিংহোম বা হাসপাতালের পাশেও প্রভাবশালীদের অন্তহীন শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ না থাকলে এভাবে সাধারণ মানুষের রক্ত চোষা যায়? অনেকেই যারা আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছে না তারা সব চিন্তাভাবনা জলাঞ্জলি দিয়েই পরপারে চলে যাচ্ছে--কিন্তু যারা সর্বস্বান্ত হয়ে ঘরবাড়ি বেচে বা বন্ধক রেখে ফিরছে--তারা কি সত্যি সত্যি বেঁচে ফিরছে? এসব যারা ভুক্তভোগী তারা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
সরকারি হাসপাতাল চত্বরে যেমন দরিদ্র মানুষের রক্ত চোষার জন্য বেশ কিছু দালাল ঘুর ঘুর করছে--টাকা দিলেই বেড বিক্রি করছে--দ্রুত করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে তুলে দিচ্ছে এবং আরও কত কি করছে --তেমনই বেসরকারি নার্সিংহোম বা হাসপাতালেও বিলিং সেকশনে একটা করে একস্ট্রা চেয়ার পাতা আছে। তারা ২০%-এর হিসেব কষে নিজেদের ‘‘প্রাপ্য’’ বুঝে নিচ্ছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠছে। অভিযোগ খুব একটা মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে না এই কারণেই যে, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার নামে অত্যন্ত সাধারণ চিকিৎসার (হ্যাঁ, করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা খুবই সাধারণ, যদি না কেউ নানান রোগে জর্জরিত হয়ে হাসাপাতালে মৃতদেহে পরিণত হচ্ছেন) জন্য যে ভাবে কোটি কোটি টাকা নির্দ্বিধায় লুণ্ঠন চলছে তাতে এই সন্দেহটা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য পরিষেবার নামে সরকারি একাংশের এবং বেসরকারি ১০০% লুণ্ঠনের যে অমানবিক ও নৃশংস ছবি প্রকাশ্যে এসে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের নড়বড়ে ক্ষয়িষ্ণু চেহারাটাকে প্রকট করে তুলছে তাতে দৃশ্যতঃই শেষপর্যন্ত স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে বিব্রতবোধ করতে দেখা গেল। তিনি অনেকটাই দল ও সরকারের ভাবমূর্তির কথা ভেবে বেসরকারি নার্সিংহোম ও হাসপাতালগুলিকে ‘‘চাপে’’ ফেলে দিলেন। কেমনতর সেই চাপ? একটু খতিয়ে দেখা যেতেই পারে।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, মোট আনুমানিক বিলের ২০%-এর বেশি অগ্রিম জমা রাখা যাবে না এবং সেটা ৫০ হাজারের বেশি হবে না। এ থেকে বেশ কয়েকটা কথা স্পষ্ট হল। প্রথমতঃ বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ ২৫-৩০-৫০ হাজার হবে না, আড়াই লাখ হবেই। কিন্তু এতে তারা রাজি হবে কিনা সে সম্পর্কে তাদের অভিমত আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও প্রকাশ্যে আসে নি। ধরে নেওয়া যাক তারা রাজি হল এই নির্দেশ মানতে--সে ক্ষেত্রে একবার এইসব গুহায় ঢুকলেই আড়াই লাখ প্রণামী দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। একেবারেই প্রাণের দায় বড় না হলে সাধারণ মানুষ এইসব বেসরকারি চত্বরে পা রাখেন না। সাধারণতঃ যারা আসা-যাওয়া করেন তাদের কাছে আড়াই লাখ (গোপন চুক্তি থাকলে অন্য কথা) কোনো ব্যাপারই নয়। ইডি বা সারদা-রোজভ্যালি কিংবা অন্য যে কোনো আর্থিক কেলোতে ফেঁসে গিয়ে যারা গ্রেপ্তারী এড়াতে এইসব স্বাস্থ্য পরিষেবার আশ্রয় নেন তাদের কাছেও ঐ সামান্য টাকাটা কিছুই নয়। কিন্তু অনেক দরিদ্র মানুষকেও নানা কারণে বাধ্য হয়ে এখানে কখনোসখনো আসতে হয়। চাপটা তাদের ক্ষেত্রেই বেড়ে গেল বই একটুও কমল না !
একবার যদি কেউ এইসব স্লটার-হাউসে ঢুকে পড়ে তাহলে তার সামনে মাত্র দুটি রাস্তা খোলা থাকে--হয় মৃত্যু না হয় রাস্তার ভিখিরি হয়ে বাকি জীবন চরম দুর্দশার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করা। এখন তো করোনা ভাইরাস এইসব লুটেরাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। একবার চত্বরে পা দিলেই করোনা পরীক্ষা--তার পর ভুল রিপোর্টে করোনা রুগী (তিন জায়গায় তিন রকমের রিপোর্ট--এমনটাও হামেশাই হচ্ছে, অথচ কারুর জেল-জরিমানা কিছুই হচ্ছে না!)--এবং এর পরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে ফাইভ-স্টার হোটেলের চোদ্দ দিনের বিল উইথ মেডিকেল ট্রিটমেন্ট ! ভয়াবহ অঙ্কের বিল হাতে পেয়ে পরিবার পথে বসে যাচ্ছে ! এটাই হল এই মুহূর্তে বাংলার স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রকৃত চেহারা। কোয়ারেন্টাইন--আইসোলেশন হোমের নারকীয় দৃশ্যাবলীর ব্যাখ্যায় আর যাচ্ছি না। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ দেখতেই পাচ্ছে কারা মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে আর কারা রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠছে !
এইসব অমানবিক কাণ্ডকারখানাকেও কী নির্লজ্জের মতো হাস্যকর ছেঁদো যুক্তির সাহায্যে জাস্টিফাই করা হচ্ছে--মানুষ তা দেখছে। কিন্তু মানুষের কিছু করার নেই। জীবন-ই যেখানে অনিশ্চিত ও অমঙ্গলময় হয়ে ওঠে তখন বলির পাঁঠা হওয়া ছাড়া কী-ই বা করার থাকে ! করোনা ভাইরাস অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি মানুষকে মানুষ নিয়ে ভাববার নিদারুণ এক কর্মশালায় একত্রিত করে গেল--নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করেই। মানুষ কি আর এখন আগের দৃষ্টিতে কিছু দেখতে পাচ্ছে? দেখতে পাবে কখনো? সময়ই উত্তর দেবে সময়মতো !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.