Header Ads

কোভিড-১৯ সময় মায়া অ্যাঞ্জেলুর ইতিবাচক মানসিকতার রসায়ন

- সুধৃতি দত্ত-


কোভিড-১৯ লকডাউন সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক অতুলনীয় ঘটনা যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে এক কঠিন মানসিক শক্তি পরীক্ষায় ফেলেছে। সত্যিই, এ এক কঠিন সময় সকলের জন্যে। করোন ভাইরাস অতিমারির ফলস্বরূপ পৃথিবীতে যে সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে তার সাথে স্বাভাবিকভাবে যে কেউই নিজেকে হতাশাগ্রস্থবোধ করতে পারে। অথবা, মানসিকভাবে এ পরিস্থিতি সহ্য করতে অসহায় হতে পারে।

তবুও, মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকাটা  যেকোন সংকটের সফল মোকাবিলার মূল উপাদান। বর্তমান সময়ে, আগের চেয়ে আরও বেশি জীবনের ছোট মুহূর্তগুলিকে উপভোগ করার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই  নেতিবাচক চাপ এবং হতাশার প্রভাবগুলি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। 

এক দশক আগে প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারে বিখ্যাত আমেরিকান কবি ও সামাজিক কর্মী মায়া অ্যাঞ্জেলু বলেছিলেন আফ্রিকান আমেরিকানদের পূর্বসূরিরা দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সর্বদা জীবনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এবং তারই জন্যেই তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শৃখলমুক্ত হতে পেরেছিলো । অ্যাঞ্জেলুর দাদু-ঠাম্মা দাসত্বের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

"জীবনে বহুবার পরাজয়ের মুখোমুখি হতে লাগতে পারে তবে নিজেকে পরাজিত করা চলবে না। আসলে, জীবনে পরাজয়ের মুখোমুখি অভিজ্ঞতা জীবনশক্তি এবং সহ্যশক্তি তৈরি করে," বলেন মায়া অ্যাঞ্জেলু।

স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিজ্ঞানীরা বিশ্বকে মারাত্মক ভাইরাসের খপ্পর থেকে বাঁচাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে কিনা আমরা ভাইরাসের আক্রমণে কাছে নতজানু হয়ে যাচ্ছি? আমরা কি মানসিক আঘাত ও হতাশার কাছে পরাজয়ে স্বীকার করছি ? প্রশ্নগুলোর উত্তর - অবশ্যই, না।

জীবনের হাতাশাগ্রস্ত হয়ে নেতিবাচকতার জগতে ঢুকে পড়া খুব স্বাভাবিক।আর, আশা নিয়ে এগিয়ে যায় বহুক্ষেত্রে কঠিন মনে হতে পারে । জীবনে আশার প্রদীপ আমাদের উজ্জবিত রাখে। আমরা অতীত থেকে আশার কিরণ পাই। নিজেদের জীবনের বহু অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান সময়ের হতাশাকেও জয় করতে পারি।

জীবনের প্রথম চেষ্টায় প্রত্যেকেই সাফল্যের স্বাদ পায় না। আসলে, খুব কমই লোকে এ ব্যাপারে ভাগ্যবান ।বেশিরভাগ মানুষের জীবন হ'ল নিজেকে জানার এক প্রচেষ্টা। সে যাত্রা হল আমরা কে, আমরা কীসে সেরা এবং আমরা কীভাবে এ বিশ্বে পার্থক্য আনতে পারি তা খুঁজে বের করার এক প্রয়াস।

দুর্ভাগ্যক্রমে, অবর্ণনীয় বাধা আমাদের পথকে জর্জরিত করে তা আমাদের যাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে।সাফল্যকে  সহজেই ম্যানেজ করা যায়। তবে, লোকেরা প্রায়শই তাদের ব্যর্থতাকে ম্যানেজ করতে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। আমরা ব্যর্থতাকে কিভাবে প্রতিহত করি তার উপরই নির্ভর করে জীবনের সাফল্য ও সফলতার প্রকৃত মূল্যায়ন।

আমাদের উচিত যারা কঠিন সময়ে সাফল্য পেয়েছিল তাদের আত্মজীবনী পড়া উচিত। আত্মজীবনীতে বিচার ও যন্ত্রণার উপশমের জন্য লেখকদের কাছে আকর্ষণীয় গল্প রয়েছে।এপিজে আবদুল কালাম একজন সফল ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন। যিনি ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সদস্য ছিলেন। প্রথম জীবনে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে। তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন। তাঁর প্রকল্প গড়ের চেয়ে কম বলে বৃত্তি প্রত্যাখ্যান হয়েছিল ।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, বিখ্যাত সূত্র ই = এমসি স্কোয়ার, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্টটি আদি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জনক । তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। তিনি চার বছর বয়সে কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন। দেরিতে কথা বলার আরম্ভ করার জন্য শিক্ষকরা বিদ্যা শিক্ষার শুরুর দিকে তাকে অনুপযুক্ত মনে করেছিলেন।

ওয়াল্ট ডিজনি ছিলেন একজন আমেরিকান উদ্যোক্তা, অ্যানিম্যাটর, লেখক, ভয়েস অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক। তিনি আমেরিকান অ্যানিমেশন শিল্পের পথিকৃৎ ছিলেন। এক ব্যক্তি সর্বাধিক অস্কার জেতার রেকর্ডও রয়েছে তার দখলে। পর্যাপ্ত সৃজনশীল না হওয়ার কারণে তাকে একটি পত্রিকা থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাকে বলা হয় যে তার কল্পনা এবং ভাল ধারণার অভাব আছে।

জে কে রাওলিং একজন ব্রিটিশ লেখক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং সমাজসেবী। তিনি হ্যারি পটার ফ্যান্টাসি সিরিজ লেখার জন্য সারা বিশ্বে সুপরিচিত। তিনি একাধিক পুরষ্কার জিতেছে এবং ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি সে সিরিজের অনুলিপি বিক্রি হয়েছে । ইতিহাসের সর্বাধিক বিক্রিত বই সিরিজ হয়ে উঠেছে হ্যারি পটার । তার প্রথম বইয়ের খসড়া কিন্তু প্রকাশকরা ত্রিশবার অগ্রাহ্য করেন।

জীবনে সফলতা লাভ করা প্রতিষ্ঠিত লোকদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জীবনের অমূল্য পাঠগুলি শিখি। অদম্য প্রচেষ্টা অসাধারণ কীর্তির উপাদান। আমরা প্রতিভা এবং উদ্ভাবনীশক্তি দ্বারা বানানো এক পৃথিবীতে বাস করি। সাফল্যের রহস্যগুলি উল্লেখযোগ্য জীবনীগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে মনীষী ব্যাক্তিদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণার নিতে হবে।

প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আমাদের বেঁচে থাকার আশার আলো দেখায়। এরূপ উদ্দীপিত লড়াইয়ের উদাহরণ ইতিহাসে পরিপূর্ণ।ফরাসী বিপ্লব হোক, বা রাশিয়ান বিপ্লব, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী আন্দোলন, কিংবা আমেরিকাতে নাগরিক অধিকার আন্দোলন - এরূপ প্রতিটি বিপ্লবের গল্পই হল প্রত্যাশা ও ইতিবাচকতার জ্বলন্ত প্রতীক।

জীবনের সফলতা আমাদের মানসিকতার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। জীবনে দক্ষতার অবশ্যই প্রয়োজন। সমান দক্ষতার দু'জনকে মধ্যে যার মানসিকতা ভালো সে ব্যক্তিটিই জীবনে জয়ী হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, ইতিবাচক থাকা এবং ভাল মনোভাব রাখা সর্বদা সহজ নয়। ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে সাহায্য করার জন্য আমরা অনেক কিছুই করতে পারি।

জাপানের ওকিনাওয়া জুড়ে ছোট ছোট পাড়াগুলিতে, বন্ধুরা 'সাধারণ উদ্দেশ্যে' একসাথে মিলিত হয়। কখনও প্রতিদিন এবং কখনও কখনও সপ্তাহে দু'দিন মিলিত হয় গসিপ করতে। অথবা, জীবন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বা প্রয়োজনে পরামর্শ অথবা আর্থিক সহায়তার জন্য। তারা এই দলগুলিকে তাদের 'মাই' বলে। পাঁচটি ছোট বাচ্চাকে একসাথে গ্রুপ করা হয়  এবং তারা সারা জীবন একে অপরের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। এরূপ কিছু 'মাই' নব্বই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে জাপানে!

প্রশান্ত মহাসাগরীয়রা যোগ-ব্যায়াম, বই পড়া, পরিবারের সাথে সময় ব্যয় করা, দাদু-দিদিমা  এবং বাবা-মাকে সাহায্য করার মতো ক্রিয়াকলাপগুলি খুব উপভোগ করছে যা তাদের লকডাউনেও জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে।

প্রতিটি অন্ধকার মেঘের একটি রূপালী আস্তরণের থাকে।সে রুপালি আস্তরণটিকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে হয়। আর, সর্বশক্তিমানের কাছে বিনীত প্রার্থনা যে তিনিঁ যেন আমাদেরকে সকল প্রতিকূলতাকে সহ্য করার ও নির্ভীক হওয়ার শক্তি যোগান।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক কবিতার প্রথম দুই পংক্তিতে লুকিয়ে আছে নির্ভীক হওয়ার রসায়ন।

সে পংক্তি দুটি হল :

বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

[লেখক নুতন দিল্লির নয়া ঠাহরের ব্যুরো চিফ।হোয়াটস্যাপ: ৯৯৯৯২১৯৬৮২ ]

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.