Header Ads

গায়কের 'বেলা বোস' নয়, দিদির রাজ্যসভার সেনাপতি ডেরেক 'তুমি কি শুনছো'...


[ মাননীয়া মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন সরকারের কোভিডের সঙ্গে লড়াইয়ের কৌশলের প্রশংসা করে ডেরেক ও ব্রায়ান আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেই লেখার প্রতিটি বিষয়ের তথ্যগত ভুলকে যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেছেন কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনবিদ্যার তরুণ বাঙ্গালী গবেষক রুদ্র প্রসন্ন ব্যানার্জী। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় আপন প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছিলেন। আবার, বলাই বাহুল্য, আনন্দবাজার সেই চিঠি ছাপান নি। বঙ্গদেশ প্রকাশ করছে সেই চিঠি পাঠকদের অবগতির জন্য। নয়া ঠাহর লেখকের অনুমতি নিয়ে চিঠিটি নিজ পাঠকের জন্য ছাপালো।]


  ডেরেক ও ব্রায়ান
মাননীয় ডেরেক বাবু,
আপনার লেখা পড়ে “যমালায়ে জীবন্ত মানুষ” এর ভানু ব্যানার্জীর সেই বিখ্যাত কৌতুক মনে পড়ছে, যিনি ভালো কাজ করবেন ভেবেছিলেন বলে পুণ্য চেয়েছিলেন, আপনারাও ভালো কাজ ভেবেছিলেন বলে ভোট চাইছেন। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে ২০ শে জুলাই ২০২০ আনন্দবাজার পত্রিকায় আপনার লেখা “কোভিড-যুদ্ধ: দিদির ১৯ টি মাস্টার স্ট্রোক” কোন সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার পরিচয় নয়। অবশ্য আপনি কতটা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আমি জানিনা, কারণ স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার ব্যাপারে টুইটারে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করায় ২০১৩ সাল থেকে আপনি আমাকে ব্লক করে রেখেছেন। আসুন দেখে নেওয়া যাক কিভাবে ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করে আপনি আমাদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছেন।

১) আগে থেকে কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড নির্মাণ: আমাদের রাজ্যের বর্তমান কোভিড রোগীরা যে শুধু বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন তাই নয়, নন-কোভিড রোগীরা পশ্চিমবঙ্গের কোন হাসপাতালে বেড পাচ্ছে না। অতএব হয় আপনি মিথ্যা কথা বলছেন নাহলে রাজ্য সরকার আগে থেকে কোভিড আইসোলেশন নির্মাণে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে বাইরে থেকে আসা বিমান বা ট্রেনের যাত্রীদের সরকারিভাবে কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে না। সব রাজ্যই করছে।

২) যত দ্রুত সম্ভব সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ: আপনার দাবি অনুযায়ী করোনাকে হু (WHO) বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসেবে ঘোষণা করার আগেই আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তা অনুভব করতে পেরেছিলেন। ডেরেকবাবু, নিজের লেখার মানে বোঝেন নাকি অনুপ্রাণিত হয়ে অসত্য বলছেন?

৩) বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বার্তা দিলেন: আপনার দাবি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সর্বপ্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে লকডাউনের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে কোন লিস্ট রেল দপ্তরে পাঠানো হয়নি। উপরি পাওনা “করোনা এক্সপ্রেস” আর “জামাই আদর”!

৪) সর্বাগ্রে লকডাউনের সিদ্ধান্ত: শুরু থেকেই আমরা দেখেছি লকডাউন চালু করতে গিয়ে কিভাবে পুলিশ প্রশাসনকে কিছু বিশেষ এলাকা থেকে লাথি খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। সমস্ত অফিস কাছারি খুলে দিয়ে সোশ্যাল ডিস্টেন্স জলাঞ্জলি দিয়ে সাধারণ মানুষকে অফিসে যেতে বাধ্য করেছে আমাদের রাজ্য সরকার। পরিণাম স্বরূপ আপনার দলের পরিচালিত যে সমস্ত পৌরসভা করোনা মুক্ত বলে প্রচার করা হচ্ছিল সেই সব জায়গায় আজকে করোনা রোগীর সংখ্যা শতাধিক (উদাহরণ: উত্তরপাড়া)। মিষ্টির দোকান না খুলে সরকার দুধ কিনে গরিবদের বা বাচ্চাদের পাঠাতে পারত। অবশ্য পাঠাবে কে? যাকে পাঠানোর দায়িত্ব দেবেন সেই তো খেয়ে নেবে। এখন আবার শুনছি সপ্তাহে দুদিন করে লকডাউন, মানুষের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করার একটা সীমা থাকা উচিত!

৫) দরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশন: যদি দরিদ্র মানুষের কথা আপনারা চিন্তা করতেন তাহলে ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ এর বিরোধিতা করতেন না।

৬) নাগরিকদের জন্য উচ্চ মানের মাস্ক বিতরণ: খুব দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সোশ্যাল ডিসটেন্স পালন না করে শুধুমাত্র মাস্ক পরে করোনা সংক্রমণ রোখা সম্ভব নয়। তাই আপনারা ৩ কোটির জায়গায় ৩০কোটি মাস্ক বিতরণ করলেও তা মানুষের কোনো কাজে আসেনি।

৭) গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি: আপনার কমিটির হেড ডঃ অমিত মিত্র একদিনের জন্য গত চার মাসে ঘর থেকে বেরোন নি। আর অভিজিৎ বাবু তো সবাইকে একবার হাত ধুতে বললেনl সে তো আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রাধান ও বলে গেছেনl তাহলে কমিটি কি কাজ করল ?

৮) বাংলায় বিনামূল্যে চিকিৎসা: বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা তো দেবেই। বেসরকারীতে জানেন কি হচ্ছে? অবশ্য এই সমস্ত নিউজ যে সমস্ত ছোটখাটো চ্যানেল (উদাহরণ: আরামবাগ টিভি) দেখায় তাদের আপনারা নিউজ দেখানোর কাজ থেকে বঞ্চিত করে রাখছেন।

৯) ১০ লক্ষ টাকা অর্থমূল্যের বিমা কভারেজ: কোভিড যোদ্ধাদের জন্য মাত্র দশ লক্ষ কভারেজ? মহারাষ্ট্র ৫০ লক্ষ টাকা, দিল্লি ১ কোটি টাকা !

১০) পেনশন: কার জন্য? কত টাকা? কোন বীমা কোম্পানি দেবে? নাকি সরকারি কোষাগার থেকে? কতো টাকা খরচ করেছেন? কাউকে এখনো দিয়েছেন? কেউ দরখাস্ত করেছে?

১১) পরীক্ষাগারের সংখ্যা ২৭ গুণ বাড়ানো হয়: ২৮ শে এপ্রিল অব্দি আমাদের আমাদের রাজ্যে ৪৪২ শতাংশ কম টেস্টিং হয়েছিল। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ টিম আসার পরে কাজ কিছুটা এগোলেও জনসংখ্যার অনুপাতে তা পর্যাপ্ত অবস্থায় পৌঁছয়নি। বর্তমানে কোন রাজ্য কতগুলি টেস্টিং সেন্টার আছে সেই হিসেব কি আপনার জানা আছে? উত্তরপ্রদেশ -১৩৮, মহারাষ্ট্র-১২২, তামিলনাড়ু-১০৬, মধ্যপ্রদেশ-৮২, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ৫৫!

১২) কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস: ৮ নম্বর পয়েন্টে আপনি বলেছিলেন বিনামূল্যে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যদি তাই সত্যি হয় তাহলে চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস করার প্রশ্ন উঠছে কিভাবে? বিরোধিতা করতে করতে আপনি শেষে স্ববিরোধিতা করে বসলেন!

১৩) সেফ হোম: দয়া করে খবর নিয়ে দেখবেন এখন অবধি মানুষ এই সমস্ত আইসোলেশন সেন্টারের ঠিকমতো খাবার জল অবধি না পাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে রাস্তায় নেমে সংবাদমাধ্যমের সামনে অনুরোধ করছে বিষ দেওয়ার জন্য।

১৪) কর্মনিযুক্তির দিকে বিশেষ নজর: বিগত ছয় বছরে কেন্দ্রের যে সমস্ত প্রকল্পগুলি আপনারা শুধুমাত্র বিরোধিতার কারণে পশ্চিমবঙ্গে আস্তে দেননি তার ছোট একটি তালিকা হল: সাগরের গভীর সমুদ্র বন্দর , মুম্বাই কলকাতা ফ্রেট করিডোর, অমৃতসর কলকাতা ফ্রেট করিডোর, ইস্টকোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোরিডোর, লুধিয়ানা ডানকুনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোরিডোর, NH 34, NH 35, কলকাতা ও বাগডোগরা বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, কলকাতা কল্যাণী মেট্রো সহ আরও পাঁচটি মেট্রো প্রকল্প ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় সরকারের এই হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গুলি এলে আজকে বাংলা ছেড়ে আমাদের রাজ্যের মানুষদের কাশ্মীরে আপেল কুড়াতে গিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে গুলি খেয়ে প্রাণ দিতে হত না।

১৫) শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা: কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর জন্য ৮৫% ভর্তুকি দিয়েছে এবং রাজ্য সরকার ১৫% টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। আপনি বেমালুম মিথ্যে কথা লিখেছেন কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে ট্রেন ভাড়া নিয়েছে।

১৬) ২৪x৭ কোভিড-১৯ হেল্পলাইন: মানুষ হাসপাতালে বেড পাচ্ছে না আর আপনি হেলপ্লাইনের গল্প শোনাচ্ছেন।

১৭) গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত হেল্পলাইন: আপনার প্রতিবেদনটি যেদিন প্রকাশিত হয়েছে, তার আগের দিনে আমাদের রাজ্যে একটি স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। তার কিছুদিন আগেই এক বিধায়কের মরদেহ ঝুলতে দেখেছে বাংলার মানুষ।

১৮) বাড়ি বাড়ি মিড ডে মিল পৌঁছে দেওয়া: উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাব সহ একাধিক রাজ্য সাধারণ মানুষের বাড়িতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দিয়েছে, আর আপনারা জানলা দরজা খুলে ঘরে বসে থাকতে বলেছেন!

১৯) কোভিড-১৯-এ মৃতদের স্বজনের জন্য চাকরির বন্দোবস্ত: আপনি এখানে ক্ষতিপূরণের কথা বলছেন। আর এই ক্ষতির জন্য দায়ী কে? ডাক্তাররা রেইনকোট পড়ে চিকিৎসা করছেন আর এদিকে রং পছন্দ না হওয়ায় আপনারা পি.পি.ই. ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বিনা পি.পি.ই. তে করোনা যোদ্ধাদের মারা যেতে হচ্ছে আপনার সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতার জন্য, তাই মৃতদের পরিবারের কাউকে চাকরি দিয়ে আপনারা দয়া দেখাচ্ছেন না।

শেষে বলি, একসময় আপনাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী অরুনাভ ঘোষ বলেছিলেন, “শিরদাঁড়া এবং মস্তিষ্ক একসঙ্গে তৃণমূলে নেই”। মানব সমাজের এই ভয়ানক দুর্দিনে, এইসব লিখে আপনি কেন নিজে অরুনাভবাবুকে সত্য প্রমাণ করছেন?



                                                               




ধন্যবাদান্তে,   


রুদ্র প্রসন্ন ব্যানার্জি,
গবেষক, অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা

(সৌজন্য: বঙ্গদেশ.কম)





কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.