Header Ads

রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কোথাও কিছু ঠিক নেই--নবান্নের দরবার আলো করা ‘ভগবান’রা পর্দার আড়ালে লুকিয়েছেন !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
যখন এ রাজ্যে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিচ্ছিরি রকমের রাজনৈতিক লীলাখেলা চলছিল এবং নবান্নের দরবার ালো করে হুজুরে হাজির ‘ভগবান’রা বড় বড় বাণী দিতে দিতে মাঝে মাঝেই বলছিলেন--‘আতঙ্কিত হবেন না--ভয় পাবেন না। সরকার এবং সরকারের সঙ্গে আমরা তো আছি !’ তখনই আমি এ রাজ্যের মানুষ অল্প দিনের মধ্যেই কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছে তা খুব স্পষ্ট করেই লিখেছিলাম। বলেছিলাম এ রাজ্যের গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই তোলাবাজদের হাতের মুঠোর মধ্যে চলে গেছে। 
 
সুপার-ডুপার দাবিগুলো বিচ্ছিরিরকমের বকোয়াস ছাড়া যে আর কিছুই নয় তা হাসপাতালগুলোতে যারা পা রাখতে বাধ্য হয়েছে তারা জানে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে যখন যাচ্ছেতাই রকমের নির্বোধ সাপলুডোর খেলা চলছিল তখন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের পাশে বসে বসে ‘ভগবান’রা এমন সব ছবি তুলে ধরতে মরিয়া প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছিলেন যাতে কারুর পক্ষে কল্পনাই করা সম্ভব ছিল না কিছু দিনের মধ্যেই এ রাজ্যের স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর নড়বড়ে অবস্থা মাত্র ১৭ বছরের একটি তরতাজা ছেলের চিকিৎসা না করে ‘ভগবান’রা দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করবেন না ! ছেলেটিকে মর্মান্তিক হয়রানের শিকার করে প্রত্যক্ষভাবেই মেরে ফেলার সময়ে ‘ভগবানপুত্র’দের মুখগুলোও কি একবারের জন্যেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে নি ! ১৬ ঘন্টা ধরে মৃতদেহ আগলে বসে থাকা পরিবারের সদস্যদের মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণাও কেন ছুঁতে পারছে না প্রশাসনের দায়িত্ববোধকে? এতটাই অমানিবিক হৃদয়হীনতা নিয়ে বড় বড় লেকচার ঝারতে যাদের অসুবিধে হয় না--বিবেক যাদের লজ্জাবোধ করে না তাদের মুখের দিকেই চরম দুর্ভাগ্যবশতঃ মানুষকে তাকিয়ে থাকতে হয় !
 
 
লকডাউনের সূচনা পর্বের মুহূর্ত থেকেই এ রাজ্যে লকডাউন নিয়ে চূড়ান্ত ফাজলামি ও দায়িত্ববোধহীন ছেলেখেলা শুরু হয়েছিল তার সচিত্র বিবরণে সচেতন মানুষ ঘরের মধ্যে বসে থেকেও বার বার শিউরে উঠেছে। লকডাউনকে তোয়াক্কা না করার একটা নতুন উন্মাদনা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। বাজার-হাটে রাস্তাঘাটে বেপরোয়া ভঙ্গিতে গায়ে গা লাগিয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রতি সেকেণ্ড সর্বনাশকে দ্রুত আলিঙ্গনে মত্ত হচ্ছে দেখেও সর্বজ্ঞানী রাজনীতিক ও তাদের বশংবদ ভগবানরা প্রতি মুহূর্তে অভয় দিয়ে চলেছেন--‘ভয় পাবেন না--আতঙ্কিত হবেন না!’ এ ভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত না করে যদি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতেন--‘আতঙ্কিত হওয়ার ও ভয় পাওয়ার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, কারণ, অবস্থা আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে মানুষ হাসপাতালে বেড পাবে না--চিকিৎসা পাবে না--রাস্তাঘাটে মরে পরে থাকলে তাদের সৎকার করারও কেউ থাকবে না। ঠিক এইভাবে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে যদি মানুষকে সচেতন করা যেত এবং কঠোর হাতে লকডাউন পালনে মানুষকে বাধ্য করা হত তাহলে আজ এই ছবি দেখতে হত না।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজ্যে আসা বিশেষ ট্রেনগুলোকে আমরা কটাক্ষ করে ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি--অথচ গতকালই বর্ধমানে ত্রাণ বন্টনের নামে ‘করোনা বিলি’র বিষয়টা নিয়ে টুঁ-শব্দ করছি না। বড় বড় মিছিলের আয়োজন করে, রেশন লুটের ডামাডোল তৈরি করে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যাপকহারে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিতেও দু’বার ভাবছি না--আমরা সত্যি সত্যি একখনও মনুষ্যপদবাচ্য বলে দাবি করার জায়গায় আছি কিনা একবারও ভাবছি না--সরকারও ভাবতে বাধ্য করছে না। এ রাজ্যে লকডাউনের নামে যে চূড়ান্ত ধাষ্টামো ও ন্যাকামো হল এবং এখনও হচ্ছে তার চড়া দাম দিতে হবে নিরাপরাধ জনগণকেই। কারণ, শুধু ড্রপলেটের মাধ্যমেই নয় করোনা ভাইরাস যে বাতাসবাহিতও তার প্রমাণ গবেষকরা পেয়েছেন। এ রাজ্যের --বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ড্রপলেট বা বাতাসবাহিত ব্যাপারটাই বিন্দুমাত্র বোঝেন বলে মনে করার কোনো সুযোগই রাখছেন না। শুধুমাত্র তাদের পথসভা মিছিল ত্রাণ বন্টন (পড়ুন করোনা বন্টন)-এর চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে কী বিরাট সংখ্যক মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারেন বা হচ্ছেন তা বোঝার মতো যন্ত্রপাতি তাদের মাথার কোনো অংশেই সক্রিয় নয়। এই ভয়ানক দায়িত্বহীনতার দায় কে নেবে? এসব প্রশ্ন তোলা যাবে না--আর তুলবেনই বা কোথায়? সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বেড-এর দাম হু-হু করে বেড়ে গেলেও ভগবানদের অধর কাঁপছে না।
বর্তমানে, রাজ্যে সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের সংখ্য়া ৫৮২ এবং প্রতিটি সেন্টার পিছু খরচ নাকি প্রতিদিন ৫৪ হাজার টাকা ! কিন্তু এই বিপুল টাকা কাদের মাধ্যমে কিভাবে খরচ করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সুস্থ কোনো মানুষ যদি একার এইসব সেন্টার কিভাবে চলছে দেখতে যান তাহলে তৎক্ষণাৎ তিনি মুর্চ্ছা যাবেন। সেখানে মধুচক্র থেকে আরও অনেক কিছুই হচ্ছে বলে মানুষের অভিযোগ প্রকাশ্যে উঠে আসছে। চূড়ান্ত অব্যবস্থার নানান ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে--প্রশাসনের কিছু যাচ্ছে আসছে?
এই মুহূর্তে সেখানে ৫ হাজার ৬০৫ জন রয়েছেন। এ পর্যন্ত সরকারি কোয়ারানটিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯৯ হাজার ২৭ জন ! এখনও পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে মোট ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ৮১০ জনের মধ্যে এই মুহূর্তে হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৪১ হাজার ৫২০ জন। ছাড়া পেয়েছেন ২ লক্ষ ৯৪ হাজার ২৯০ জন। ভিনরাজ্য থেকে যাঁরা ফিরছেন, তাঁদের জন্য এই মুহূর্তে রাজ্যে ২ হাজার ৬০৩টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । বর্তমানে সেখানে ১১ হাজার ৯০১ জন রয়েছে। ছাড়া পেয়েছে ২ লক্ষ ৫৯ হাজার ৪২৫ জন! এছাড়া এই মুহূর্তে রাজ্যে করোনা হাসপাতালের সংখ্যা মাত্র ৭৯। এর মধ্যে ২৬টি সরকারি ও ৫৩টি বেসরকারি। করোনা হাসপাতালগুলিতে মোট শয্য়ার সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার ৬০৭। আইসিইউ যুক্ত শয্যার সংখ্যাও মাত্র ৯৪৮। জনগণের বুঝতে কি কিছু বাকি থাকছে পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে কোন দিকে চলেছে ?
শুভ্রজিতের মা-বাবা তাদের একমাত্র সন্তান হারিয়ে হাহাকার করছেন--সংবেদনশীল কিছু মানুষও তাদের হাহাকার মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করছেন। কিন্তু সরকার এবং ‘ভগবান’রা এই কিশোরের মৃত্যু নিয়ে একটি শব্দও এখনও খরচ করেন নি--তাঁর এখন স্ক্রিপ্ট রচনায় ব্যস্ত--শুভ্রজিতের মৃত্যুতে যে তাদের বিন্দুমাত্র গাফিলতি নেই সেটা প্রমাণ করাটাই আগে জরুরি--কারণ, হতভাগ্য ছেলেটির মা-বাবা পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছেন--আদালত পর্যন্ত বিষয়টা গড়ালে যুৎসই জবাব তো তৈরি রাখতে হবে !
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। আমরা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকার ও তার বশংবদ ভগবানদের অন্তঃসারশূন্য অভয়বাণীতে বিশ্বাস করে ছিনিমিনি খেলেছি--এখন সত্যি সত্যি ঈশ্বর ছাড়া আর কারুর থাকার কথা নয়। তবে ড্রপলেট এবং বাতাসবাহিত করোনা সংক্রমণের বিষয়টা যারা ঠিকঠাক বুঝে এখনও ব্যবস্থা নিতে পারবেন তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন--যারা এখনও বুঝবেন না তাদের জন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কারুরই কিছু করার নেই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.