Header Ads

মেঘালয়ের সবচেয়ে পরিচিত সাংবাদিক প্যাট্রিসিয়া মুখিমের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কিছু অভিযোগ উঠেছে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে

বাসব রায়

কে এই প্যাট্রিসিয়া মুখিম?

উত্তর-পূর্বের বাইরের মানুষরা তাঁকে কতটা জানেন, জানি না, তো লিখি। তিনি পরিচিত সমাজকর্মী, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক হিসেবে। বর্তমানে মেঘালয়ের এক নম্বর ডেইলি নিউজপেপার শিলং টাইমস-এর সম্পাদক। বয়স ৬৭। লেখালিখির মূল বিষয় মেঘালয়ে অবৈধ খনন (কয়লার জন্য), খাসি সমাজ। ২০০০ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স পুরস্কার দিয়েছে। পেয়েছেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম সোলজার অব হিউম্যানিটি অ্যাওয়ার্ড, শিবপ্রসাদ বরুয়া ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড, চামেলি দেবী জৈন পুরস্কার। এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত সাংবাদিক সম্ভবত সঞ্জয় হাজরিকা। তবে তিনি থাকেন দিল্লিতে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে উত্তর-পূর্বের সবচেয়ে সম্মানিত সাংবাদিক এখন ওই প্যাট্রিসিয়া মুখিমই। 

কী হয়েছিল ঘটনা?

প্যাট্রিসিয়া পোস্টে লিখেছেন ইংরেজিতে (লিংক দেখতে পারেন), লসোহতুনে কয়েকজন অনুপজাতি যুবক বাস্কেটবল খেলছিল। তখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের আক্রমণ করে কিছু খাসি যুবক। আহত কয়েকজন এখন হাসপাতালে। প্রসঙ্গত আহতরা সবাই বাঙালি।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে মুখিম লিখেছেন, অনুপজাতিদের ওপর ধারাবাহিকভাবে এই আক্রমণ চলছে। যাদের পূর্বপুরুষ কয়েক দশক ধরে মেঘালয়ে রয়েছেন, অনেকে ব্রিটিশ শাসন থেকেই রয়েছেন। ঘটনা হল, ১৯৭৯-র পর এরকম আক্রমণকারীরা কখনো গ্রেফতার হয়নি। 

এরপর তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, এরকম চলতে থাকলে গোটা দেশের কাছে মেঘালয় ভালো বিজ্ঞাপন হয়ে উঠবে না। অপরাধীদের কোনো সমাজ হয় না। মেঘালয় সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ করুক, সরকার যে আছে সেটা বোঝানোর দায় সরকারের।

ব্যস, এরপর পোস্টে গালিগালাজ শুরু হয় এবং একটি ‘ভিলেজ কাউন্সিল’ তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করে। তাদের অভিযোগ, প্যাট্রিসিয়ার এই পোস্টে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হতে পারে। কেননা তাঁর পোস্টে ১৯৭৯ সালের উল্লেখ আছে। তখনই ঘটেছিল উপজাতি-সমতলবাসী মানুষের সংঘর্ষ। 
অকুতোভয় প্যাট্রিসিয়া মুখিম জানিয়েছেন, তিনি আদালতে লড়াই করবেন। 

এবার সরে আসি প্যাট্রিসিয়া থেকে। মেঘের আলয় থেকে নেমে আসি সমতলে, অসমে। ইয়ান্ডাবু চুক্তির, ১৮২৬, হাত ধরে অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালি এসেছে। প্রায় দুশো বছর হল অসমে বাঙালিদের বসবাস। বরাক উপত্যকায় বাঙালির বসবাস আরও প্রাচীন, নাহোক তিনশো বছর তো হবেই। 

কিন্তু ঘটনা হল, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, অসমের সামাজিক জীবনে বাঙালির কোনো কণ্ঠস্বর নেই। উদাহরণ চান?

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে অসমের চার-পাঁচটা নিউজ চ্যানেলে বহুবার প্যানেল ডিসকাশান হয়েছে। ওই আইনের সুবিধা, যদি কেউ পায়, তাহলে অসমে সেটা পাবে হিন্দু-বাঙালিরা ; হ্যাঁ, মুসলমান-বাঙালিরা নয়, হিন্দু বাঙালিরা। কিন্তু মজার কথা হল, বাঙালিদের মর্যাদা, সংকট, সমস্যা নিয়ে আলোচনা, আর আলোচনায় কোনো বাঙালি নেই। হা হা হা।

গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী কল্পনা রায়ের বাড়ি শিলঙে। তাঁর বাবা হিরণ্ময় ধরকে চিনি। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর অসমের হয়ে রনজি ট্রফি খেলেছেন। শিলঙে ওই পরিবারের বসবাস একশো বছর অতিক্রান্ত, কিন্তু বাঙালি বলেই তাঁরা কিছু বলতে পারেন না, কিংবা বললেও কেউ শুনবে না। 

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদেরও একই অবস্থা। এখানে দুতিন পুরুষ কাটানোর পরও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কোনো বাঙালিই বাঙালির পরিচয়ে বাঙালির সমস্যা-যন্ত্রণা-আশা-ভালোবাসার কথা বলতে পারেন না। 

প্যাট্রিসিয়া ঠিক এই কথাটাই লিখেছেন যে একটি রাজ্যে ৫০-৭০ বছর বসবাসের পরও কেন কোনো মানুষ সেই রাজ্যের হবেন না? কেন তাদের চিরকালই ভাবা হবে আউটসাউডার?

সম্প্রতি ফেসবুক উত্তাল হয়েছিল সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার পর। সেখানেও গল্পটা একই, বলিউডে চলে গুষ্টিতন্ত্র। তারকাদের গুষ্টির বাইরের কেউ হলে তার জন্য বেছানো থাকবে কাঁটা। মাড়িয়ে যেতে পারলে, থাকলে, যেমন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। আর না-পারলে সুশান্ত সিং রাজপুত। 

উত্তর-পূর্বের ছেলেমেয়েরা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, হচ্ছে, এটা খুবই পরিচিত ঘটনা। তাদের জন্য ‘চিঙ্কি’ শব্দটাই সৃষ্টি হয়ে গেল। মেইনল্যান্ড ইন্ডিয়া উত্তর-পূর্বের মানুষকে স্বীকৃতি দেয় না। এনিয়ে অসমের সংবাদমাধ্যম, রাজনীতি, সমাজজীবনে বিস্তর অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু উলটোদিকটা হল, অসমের রাজনীতি-প্রশাসন-সমাজজীবনে অন্যভাষীদের কোনো গুরুত্ব নেই। অর্থাৎ উত্তর-পূর্বের বাইরে যে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার ছেলেমেয়েরা সেটাই এই অঞ্চলের মানুষ করছে অন্যভাষীদের প্রতি। 

নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, অসমের বিভিন্ন স্থানে সমতলবাসীদের কেউ পছন্দ করেন না। আমি দীর্ঘদিন ডিমাসা-কুকি-খেলমা-মার-রিয়াং-চাকমা-কার্বি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ছিলাম, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি। তাই ধরে নিতে পারেন, যতটা মাল ততটাই বাটখারা। একটুও জল নেই, তথ্যে। 

একটু আগে যাকে ‘আউটসাইডার’ বললাম সেটাই মান্য ভাষায় ‘অপর’। দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে এটা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কৌম মানসিকতার প্রতিফলন সমাজের সর্বস্তরে। 

খুব কাঁচা একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। 

বছর খানেক আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা কবিতা নিয়ে লম্বা লম্বা পোস্ট দিতাম, নিয়মিত। তো খাপ বসল, কেন? না, বাসব রায় বাইরে থেকে (উত্তর-পূর্বের বাইরে) এসেছে, তাই উত্তর-পূর্বের কবিতা নিয়ে কিছু লেখার অধিকার তার থাকতে নেই। 

এই কৌম মানসতার বিরুদ্ধে প্যাট্রিসিয়া মুখিম একেবারে সঠিক আলো ফেলেছেন। আর কেউ না-থাকুক আমি জীবন বাজি রেখে তাঁর পক্ষে। ফেসবুকে এইটুকু সাক্ষ্য দিয়ে রাখলাম। 

- রাজ‍্যের বিশিষ্ট সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.