Header Ads

প্রসঙ্গ : একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র সরকার গঠনের সম্ভাবনা কতটা !! (৩)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
বঙ্গ বিজেপিতে এই মুহূর্তে মুকুলের পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে আলোচনায় উঠে আসে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের নামও। ব্যক্তিগতভাবে আমি তপন শিকদার-জুলু মুখার্জ্জীর সময় থেকে শুরু করে বছর তিনেক আগেও জানতাম না বঙ্গ বিজেপিতে দিলীপ ঘোষ নামে এমন এক দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন যিনি বঙ্গ রাজনীতির মঞ্চে সরাসরি রাজ্য সভাপতির পদে অভিষিক্ত হওয়ার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন !

বঙ্গ রাজনীতিতে তাঁর চমকপ্রদ আত্মপ্রকাশই রাজ্যসভাপতি হিসেবে, এই বিস্ময়কর আত্মপ্রকাশের নিশ্চয়ই একটা জোরালো প্রেক্ষাপট ছিল--একটু খোঁজখবর নিতেই জানা গেল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে তাঁর সেবকজীবনের একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সুতরাং রাহুল সিনহার জায়গায় ধারে ও ভারে বেশ কয়েকজন থাকলেও দিলীপ ঘোষকেই রাজ্যসভাপতি’র পদে মনোনীত করা হল বাংলার ময়দানী রাজনীতিতে তাঁর কোনোরকম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও পরিচিতি না থাকলেও। তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে মুকুলের যোগদান এবং দিলীপের রাজ্যসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করার সময়ের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ ছিল না এবং তখনও বিজেপি’র রাজনৈতিক অবস্থান এই রাজ্যে বিশেষ পাত্তা পাওয়ার মতোও ছিল না। সত্যি বলতে কী মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিজেপি-থ্রেট বলতে কিছুই ছিল না। তপন শিকদারের পর রাজ্য বিজেপিতে এমন কাউকে দেখা যায় নি যিনি নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতার দৌলতে রাজ্য বিজেপিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন।  ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সমস্ত হিসেব তছনছ করে দিয়ে মোদীর বিপুল উত্থানের মুহূর্তেও এ রাজ্য থেকে বিজেপি মাত্র দুটি আসন পায় যার একটি বলতে গেলে বিমল গুরুংয়েরই ! অন্তঃসারশূন্য বখতিয়ার হিসেবে খ্যাত এবং জীবনে আজ পর্যন্ত একটি নির্বাচনেও না জেতার রেকর্ডের অধিকারী রাহুল সিনহা তখন রাজ্য সভাপতি। এ বোঝা বিজেপিকে বহন করতে হচ্ছিল আরএসএস-এর পছন্দের কারণে। রাজ্য বিজেপি’র কিছু বিশিষ্ট রাজনৈতিক মুখ থাকলেও তাঁরা সঙ্ঘের গুডবুকে ছিলেন না। সেই কারণেই রাহুল সিনহা ! ২০১৪’র পর মোদী-অমিতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মমতার বিরুদ্ধে ময়দানী রাজনীতিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করার জন্যেই সঙ্ঘের বাছাই তালিকা থেকে উড়ে এল দিলীপ ঘোষের নাম। মমতার স্টাইলেই তিনি হম্বিতম্বি ধমক-চমকের পথ-রাজনীতিতে বিপুল উদ্যমে নেমে পড়তে দেরি করেন নি। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে ‘যে যে ভাষায় বোঝে সেই ভাষায়’ হুঙ্কার দিতে দিলীাপ ঘোষ সঙ্কোচ বোধ করেন নি। ফলে রাজ্য বিজেপিতে বেশ খানিকটা গতি এলেও প্রতিপক্ষকে যথাযথ ঘা দিয়ে দুর্বল করার ক্ষমতাটা দিলীপ ঘোষের ছিল না। ইতিমধ্যে দল ছাড়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মুকুলের সঙ্গে  বিজেপি’র দিল্লীর কর্তাদের কথাবার্তা ক্রমশঃ পেকে উঠছিল। মুকুল বুঝে গিয়েছিলেন দলের হাফপ্যান্টীয় কটূ রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি কিছুই করে উঠতে পারবেন না এবং দিনে দিনে নিজের হাতে গড়ে তোলা দলটার পতন দেখতে হবে তাঁকে অপমান হেনস্থা সহ্য করতে করতে দলের এক কোণে জবুথবু হয়ে বসে থেকে। সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না বলেই তাঁকে বাধ্য হয়ে পা বাড়াতে হল বিজেপি’র দিকে। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে মুকুল রায় নামক অত্যন্ত ধারালো অস্ত্রটি ছিল ঈশ্বরের বরদানের মতোই--তাই লুফে নিতে তাঁরা দেরি করেন নি। অনেক কথা হয়েছিল নিশ্চয়ই--মুকুলের পরিকল্পনাও বিজেপি নেতাদের (বিশেষ করে অমিত ও মোদী’র) বিশেষভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। তাই মুকুল সেই অর্থে কোনো উল্লেখযোগ্য পদ না পেলেও কেন্দ্রীয় নেতার স্বীকৃতী পেয়ে নিজের পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করে দিতে গিয়ে দেখলেন বঙ্গ বিজেপি’র অবোধ নাবালক অরাজনৈতিক মেধাহীন শাবকদের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত কঠিন হচ্ছে। তবু  বাইরে থেকে তৃণমূলের কাঠামোয় একের পর এক আঘাত হেনে বিজেপি’র মরা গাঙে জোয়ার তুলে দিলেন। বলতে গেলে তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনার দৌলতেই (এবং অমিত-মোদীর সমর্থনে) ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে প্রায় মাটিতে শুইয়ে দিলেন মুকুল। 
ঠিক এই জায়গাটিতেই মুকুল-দিলীপের রসায়নিক সমীকরণ ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করলো। বঙ্গ বিজেপিতে সরাসরি একটা ফাটল তৈরি হয়ে গেল। মুকুলকে যারা প্রথম থেকেই চায় নি তাদের রাতের ঘুম ছুটে যাওয়ার উপক্রম হল। জল্পনা শুরু হয়ে গেল--তাহলে কি মুকুলই বঙ্গ বিজেপি’র শেষ কথা হতে চলেছেন? নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল আরএসএস-ও। কৈলাশ বিজয়বর্গীয়’র সঙ্গে মুকুলের শক্তপোক্ত সমঝোতায় প্রমাদ গোণা শুরু হয়ে গেল। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন--মুকুল-ই যদি শেষ কথা হয়ে  ওঠেন তাহলে টিকিট পাওয়া থেকে মন্ত্রীত্ব পাওয়া--সব ব্যাপারেই তো মুকুলের ইচ্ছা গুরুত্ব পাবে ! ইতিমধ্যে দিল্লীতে মুকুলের সঙ্গে পর পর দু’দিন অমিত শাহ’র দীর্ঘ বৈঠক ও কলকাতায় একই সঙ্গে অমিত শাহ ও মুকুল রায়ের জন্যে নতুন দুটি অফিস খোলার ঘোষণায় রীতিমতো কম্পন শুরু হয়ে গেছে মুকুল বিদ্বেষী শিবিরে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভাবগতিক এরা চেষ্টা করেও বুঝতে পারছেন না। মুকুল এবং অমিতের মধ্যে এমন কিছু একটা পরিকল্পনা  নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে যা বাস্তবায়িত করার জন্যে দু’জনের জন্যে দুটি নতুন অফিস খুলতে হচ্ছে ! পরিকল্পনার আঁচ এখনও পায় নি তৃণমূল কংগ্রেসও। বোঝাই যাচ্ছে বেশ একটা রহস্য দানা বাঁধছে বিধানসভা নির্বাচনের আগে। দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় ঘাঁটি গেড়ে বসার জন্যে মুকুলের পাশাপাশি অফিস খুলছেন--এমন ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে প্রায় কেউ-ই মনে করতে পারছে না। মুকুলকে নিরিবিলিতে ঘুঁটি সাজানোর কাজে মনোনিবেশ করার জন্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই পদক্ষেপ নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সুতরাং বিধানসভা নির্বাচনে মুকুলের যে একটা বিশেষ গুরুত্ব থাকছেই সেটা বুঝতে কারুর অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু গুরুত্বটা ঠিক কী ধরণের সেটাই কারুর কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। মুকুলও কোথাও তাঁর পরিকল্পনার খাতা খুলছেন না।
দিলীপ ঘোষের রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর এবং বিজেপিতে মুকুলের প্রবেশের পর থেকে রাজ্য বিজেপিতে যে আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়েছে তা যদি দিলীপ ঘোষ এবং তাঁর রাজনৈতিক নাবালক অনুগামীরা ঠাণ্ডা মাথায় বিচার বিশ্লেষণ করে দেখার মতো মেধাকে সক্রিয় করতে পারতেন তাহলে বুঝতে পারতেন--মুকুল-দিলীপ সমন্বয় রাজ্য বিজেপিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারতো। যেমনই হোক না রাজ্য বিজেপিতে দিলীপের মতো নেতার প্রয়োজন যেমন রয়েছে--ঠিক তেমনই আরও বেশি প্রয়োজন রয়েছে মুকুলের সঙ্গে দিলীপের হাতে হাত রেখে গভীর সমঝোতার মাধ্যমে দলটিকে পরিচালনার কথা ভাবা। ভাবলে বিজেপি’র স্বপ্ন পূরণ হওয়াটা অলীক বলে মনে হবে না। শুধুমাত্র দিলীপের নেতৃত্বে গাদা গাদা প্রগলভ রাজনৈতিক মেধাহীন চঞ্চল অস্থির নাবালক নেতা-কর্মী নিয়ে যে মমতার মুঠো থেকে বাংলাকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব নয় সেটা অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী বুঝলেও রাজ্য সভাপতি ও তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী অনুগামীরা বুঝতে পারছেন না। অনেকটা এই কারণেই অমিত শাহ’র মতো সর্বভারতীয় দাপুটে নেতাকে কলকাতায় অফিস খুলে নজরদারির পাশাপাশি বাংলায় পরিবর্তনের পরিবর্তন ঘটানোর কাজে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হচ্ছে !
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.