Header Ads

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য রাজনীতি কি নতুন সমীকরণের দিকে যাচ্ছে !! (১)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
প্রশ্নটা শুধু আমার মাথায় নয়--আমার পরিচিত রাজনীতিতে সক্রিয় কিছু বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনাতেও এসে যাচ্ছে এবং তাঁদেরও ধারণা, এই মুহূর্তের রাজ্য রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে অনেকটাই সেই সঙ্কেত ফুটে উঠছে। এর প্রধান কারণ, রাজ্যের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ দলের ভেতরের শ্বাসরুদ্ধকর আবহাওয়ায় অনেকেই বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছেন না। এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থাটা দুই দলের ভেতরেই উল্লেখযোগ্য কিছু নেতানেত্রীকে নতুন পথের সন্ধানে বিশেষভাবে তাড়িত করছে। তাদের মনে হচ্ছে চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলে এটাই সেরা সময়--এই সময় হাতছাড়া করলে তাদের পক্ষে ভবিষ্যতে আর কোনোভাবেই উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। তৃণমূল এবং বিজেপি’র মধ্যে কারা এই অস্থিরতায় ভুগছেন আমি জানি--কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখার জন্যে আমি তাদের কারুর সঙ্গেই কোনোরকম যোগাযোগ করে তাদের মতামত নেওয়ার চেষ্টাও করি নি। বিভিন্ন জোরালো সূত্র মারফৎ আমার কাছে যেসব খবরাখবর আসে আমি তার ভিত্তিতেই বিষয়টাকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। 
 
সম্প্রতি এবিপি আনন্দ একটি ‘‘১০০ শতাংশ সেফোলজি তত্ত্ব-ভিত্তিক সমীক্ষা’’ করে জানিয়ে দিয়েছে আগামী বিধানসভা ভোটে তৃণমূল ড্যাং ড্যাং করে ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে। এই সমীক্ষা প্রকাশ্যে আসা মাত্র খুব স্বাভাবিক কারণেই আত্মতুষ্টির চূড়ায় বসে থাকা তৃণমূল শিবিরে নিশ্চিন্ততার ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় নি। যেমনটা দেখা গিয়েছিল গত লোক সভা নির্বাচনের প্রাক্ মুহূর্তে। এবিপি বলেছিল, এ রাজ্যে বিজেপি গোটা চারেক আসনের বেশি পাবে না এবং কেন্দ্রে মোদী সরকারকে (এনডিএ) ক্ষমতায় বসতে হলে এনডিএ’র বাইরের আরও অনেক দলের সাহায্য চাইতে হবে--অন্যথায় বিজেপিকে বিরোধী আসনে বসতে হবে। তাদের এই সমীক্ষার ফল দিল্লিতে দিদির প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং তৃণমূলের নেতৃত্বে কেন্দ্রে জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তা দিতে পেরেছিল। সুতরাং আমি যখন ফেসবুকের মতো একটা জোরালো সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলছি এ রাজ্যে বিজেপি ১৬থেকে ১৮-টা আসন পেতে পারে এবং কেন্দ্রে বিজেপি এককভাবেই ২৯০ থেকে ৩০০-টি আসন এবং এনডিএ হিসেবে ৩৩৩ থেকে ৩৩৫-টি আসন পাবে তখন আমার ঐ বিশ্লেষণ ও প্রেডিকশন্ নিয়ে যে তুমুল খিল্লি হবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা ছিল না। তা নিয়ে অবশ্য আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তখনই আমার মনের মধ্যে একটা খটকা তৈরি হয়েছিল--এবিপি এত টাকা খরচ করে দাপুটে সেফোলজিস্টদের কর্পোরেট স্টাইলে পর্দায় বসিয়ে তুমুল বৈঠকের আয়োজন করে রাজ্যে ও কেন্দ্রে বিজেপি’কে একেবারে পথে বসিয়ে দিতে চেয়েছিল কেন? তাদের বৈঠকে যেসব সুসজ্জিত চূড়ান্ত বৌদ্ধিক বাগ্মীরা পর্দা ফাটাতে আসতেন তাঁরাও তো ভোট রাজনীতির বিজ্ঞান বা তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিচারে কিছু কম যান না--তথাপি ঐ সমীক্ষা প্রতিষ্ঠা পেল কেন? এর উত্তরে আমার মনে হয়েছে তৃণমূলের আত্মতুষ্টিভাবটাকে চূড়ান্ত জায়গায় তুলে দিয়ে তাদের এটাই বুঝতে না দেওয়া যে, বিজেপি কিভাবে কোন দিক দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে নিচ্ছে। এবারেও এত আগে থেকেই তৃণমূলকে নিশ্চিয়তা দানের একই উদ্দেশ্য যদি কাজ করে থাকে তাহলে আমি অন্ততঃ অবাক হব না !
 
না, আমি অন্ততঃ একেবারেই বলছি না তৃণমূল নিশ্চিত ক্ষমতায় ফেরার মতো জায়গায় রয়েছে। আগেই বলেছি, আবারও বলছি--তৃণমূল এই মুহূর্তে ৮৮-টি আসনে জেতার জায়গায় এবং মোট ১১০-টি আসনে অল্প-স্বল্প ব্যবধানে হলেও জেতার সম্ভাবনায় রয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি ৩৬ থেকে ৫৪-টি আসনে জেতার ও মোট ১০৪-টি আসনে তৃণমূলকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে দাঁড় করানোর জয়গায় রয়েছে। যে ৫৪-টি আসনে বিজেপি জেতার মতো জায়গায় রয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৩০-টি আসনই উত্তরবঙ্গের। উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি লোকসভা নির্বাচনের পর সাংগঠনিক দিক থেকে আরও খারাপ হয়েছে বিশেষ করে, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে। অবিবেচিত সাংগঠনিক রদবদলই বিশেষ করে কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার-জলপাইগুড়ি-দার্জিলিংয়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উত্তরবঙ্গের কামানেওয়ালা কিছু প্রগলভ নেতা ছাড়া অনেকেই এই দলে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভাবতে ভাবতে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। এদের অনেকেরই ধারণা কোনক্রমে যদি দলের টিকিট পাওয়াও যায় তাহলে জিতে আসার কোনোরকম গ্যারান্টি আর আগের মতো নেই। কারণ, কর্পোরেট মগজ পি-কে’র সৌজন্যে তাঁরা ইতিমধ্যেই দুর্নীতিগ্রস্ত অকর্মণ্য এবং দলে থেকেও অন্যদলের সঙ্গে যোগাযোগ করার সন্দেহের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। ফলে পুরনো জার্সিতে জনগণ আর তাদের বরদাস্ত করার মেজাজে নেই। সুতরাং......!
এই পরিস্থিতি শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়--কম বেশি গোটা রাজ্যেরই বড় সমস্যা। পি-কে’র হাতে দলের ভালমন্দের ভার তুলে দেওয়ার ফল যে কোনো দিক থেকেই সুখকর ও স্বস্তিদায়ক হয় নি এটা দলের বহু নেতাকর্মীর অভিযোগ। পি-কে সম্পর্কে তাদের ধারণা ও অভিজ্ঞতা মোটেই ভাল নয়। প্রকৃতপক্ষে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকাদের সংখ্যা কিন্তু কমার বদলে দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাজ্যের তৃণমূল সমর্থকদের একটা বড় অংশই মুকুল-শোভন-অর্জুন-শুভ্রাংশু-সব্যসাচী-শান্তনু-জনবার্লাদের দলত্যাগে বাধ্য হওয়ার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি। তাদের চিন্তা বেড়েছে শুভেন্দু-সুব্রতদের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিয়েও। অন্দরমহলের রাজনীতির মধ্যে স্বচ্ছ বাতাসের মারাত্মক অভাব যারা বোধ করছেন তারা কি ভাবছেন তা নিয়েই এখন বিশেষ বিশেষ মহলে জোর চর্চা চলছে। শুভেন্দু’র অনুগামী নেতা-কর্মীর সংখ্যা রীতিমতো ঈর্ষণীয় এই মুহূর্তে--ফলে তাঁকে কেন্দ্র করে নানান চর্চা চলছে ভেতরে বাইরে। এঁরা যদি দলত্যাগে বাধ্য হন তাহলে রাজ্য রাজনীতি যে নতুন খাতে বইতে শুরু করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বিজেপিতে গিয়ে মুকুল-অর্জুন-সব্যসাচী-শোভন-জন বার্লা’রা কি স্বস্তিতে রয়েছেন? উপযুক্ত মর্যাদা পাচ্ছেন? একেবারেই পাচ্ছেন না। মুকুল এখনও দলের সাধারণ সদস্য। তাঁর অনুগামীদের কিছু ছেলেভোলানো পদ দিয়ে ‘মর্যাদা’দেওয়ার নাটকও অভিনীত হয়েছে। কিন্তু একমাত্র বাবুল সুপ্রিয় খোদ নরেন্দ্র মোদীর বাছাই নেতা বলে হাফ-মন্ত্রীত্বেই দু-পর্বে টিকে রয়েছেন। মুকুল যাদের হাত ধরে দলে এনে সাংসদ সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়িয়ে দিলেন তাদের কাউকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হয়েছে? ১৮ সদস্যের বাংলা বিজেপি টিমে একজনও পূর্ণমন্ত্রী নেই--নেই কারণ আরএসএস তৃণমূল থেকে যাওয়াদের কোনোরকম মর্যাদা দিতে সম্মত নয়। ১০০% আরএসএস নিয়ন্ত্রিত দলে বাংলার এইসব নেতানেত্রীরা কতদিন টিকে থাকতে পারবেন শুধুমাত্র শো-পিস হিসেবে? বাংলার মানুষ মেনে নেবে? নিচ্ছে কি শেষপর্যন্ত? বোঝা যাবে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর। বাংলা রাজনীতিতে আরএসএসের প্রভাব বিজেপিকে কোনেদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না। এটা কেন্দ্রীয় নেতারা না বুঝলে এই দলের কোনো ভবিষ্যৎ এই রাজ্যে তৈরি হবে না। পুরোপুরি আরএসএস প্রভাবিত বঙ্গ বিজেপিতে মুকুল ও অন্যান্য যারা সঙ্ঘশিক্ষিত নন তারা দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর নেতা হিসেবে খুব বেশিদিন টিকতে পারবেন না--কারণ, তাদেরও নিঃশ্বাস নিতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। এরাও যদি আচমকা বেরিয়ে এসে নতুন কিছু ভাবেন তাহলে অবশ্যই রাজ্য রাজনীতিতে এক চমকপ্রদ সমীকরণ তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাম ও কংগ্রেসের ভূমিকা কি হতে পারে বা হতে চলেছে তাই নিয়েই আগামীকালের আলোচনা !
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.