Header Ads

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে !! (৫)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সম্মানজনক অবস্থানে দলকে টেনে তুলতে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে কতটা কি করতে পারেন মমতা সে প্রসঙ্গে ঢোকার আগে দেখে নিতে হবে ভোটের অঙ্কে গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে তৃণমূলের অবস্থানটা ঠিক কেমন ছিল। অঙ্ক বলছে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের ঘাড়ের ওপর প্রায় উঠে এসেছিল বলা যায়। আসনের হিসেবে মোট ৪২-টির মধ্যে তৃণমূলের দখলে আসে মাত্র ২২-টি আসন, যা কিনা দলের বিবেচনায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের সামিল। কিন্তু সত্যি সত্যি বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে নি--চতুর্দিকে ঘন কালো মেঘ স্তরে স্তরে জমে ছিল--ক্ষমতার দম্ভে আত্মতুষ্টির চূড়ায় বসে থাকা নেতাকর্মীরা সেই পুঞ্জিভূত মেঘ দেখতে পান নি। ফলে সময়মতোই বজ্রপাত হয়েছিল এবং আচমকা বজ্রপাতে গোটা দলটার মধ্যেই যে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল তা যে আজও কমে নি তা বোঝা যাচ্ছে তাদের ধারাবাহিক ভুলের রাজনীতির মধ্যে আরও বেশি করে তলিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখে !
 
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে ১৮-টি আসন ছিনিয়ে নেয় এবং আরও ২৯-টি আসনে মাত্র এক হাজার থেকে তিন হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যায়। লোকসভার আসনের ক্ষেত্রে এই সামান্য ব্যবধানকে যদি বিজেপি তাদের ‘নৈতিক জয়’ বলে মনে করে তাহলে খুব একটা বাড়াবাড়ি করছে বলে মনে করা ঠিক হবে না। এই ২৯-টির মধ্যে যদি আরও গোটা দশেক আসন পিছলে বিজেপি’র দিকে গড়িয়ে যেত তাহলে তৃণমূল দলটাই ভেঙে তছনছ হয়ে যেত--ধান্ধাবাজ দলবদলু সুবিধাবাদীরা তৎক্ষণাৎ দল ছেড়ে পালাতো--‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’র চিরকালীন ফর্মূলায় ! দলের ধারণায় এই ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’-এর দধিচী যে মুকুল রায় সেটা প্রকাশ্যে মর্মযন্ত্রণায় কাতর নেতাকর্মীরা স্বীকার না করলেও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় তুলে আনতে দ্বিধা করেন নি।
তৃণমূল যেখানে মোট ২,৪৭,৫৬,২৮৫ (৪৩.২৮%) ভোট পেয়ে ২২ আসনে জয় পেয়েছে--বিজেপি সেখানে মোট ২,৩০,২৮,৩৪৩ (৪০.২৫%) ভোট পেয়ে ১৮-টি আসনে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। মাত্র ১৭,২৭.৯৪২ ভোট কম পেয়েও মোট ১২১+২৯ আসনে বিজেপি যে লালটুকটুকে সঙ্কেত ছুঁড়ে দিয়েছে তৃণমূলের দিকে তার যথার্থ মোকাবেলা একমাত্র মমতার পক্ষেই সম্ভব ছিল--সেটা না করে চড়া মূল্যে প্রশান্ত কিশোরকে উড়িয়ে এনে তার হাতে দলের প্রায় খালি অক্সিজেন সিলিণ্ডার তুলে দিয়ে বলা হল সিলিণ্ডার ভরে দাও ! বাংলার রাজনীতিতে এ ধরণের ইয়ার্কির পরিণাম খুব সুস্বাদু হবে এই ভাবনাটাই একেবারেই অপরিপক্ক বালকোচিত ভাবনা তা বুঝতে মানুষকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি। প্রশান্ত কিশোর কি করলেন? প্রমাণ করলেন--দলের ভাঁজে ভাঁজে ওপর থেকে নিচু তলা পর্যন্ত পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ছিল এবং রয়েছে। তিনি প্রমাণ করলেন দলের মধ্যে গাদাগুচ্ছের মাথামোটা রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানহীন পিপীলিকা এমনভাবে সদাসর্বদা ওড়াউড়ি করে বেড়াচ্ছে যাদের পাখা নিজে থেকে খসে না গেলে তাদের বেপরোয়া উড়ে বেড়ানো বন্ধ করা তাঁরও ক্ষমতার বাইরে--এটা বুঝতে পেরেই তিনি মাঝে মাঝেই আওয়াজ ছাড়ছেন এদের সঙ্গে নিয়ে দলকে কিছুতেই জেতানো যাবে না ! ফলে ‘বাঁশ বনে ডোম কানা’র মতো তিনি নিজেই দিশেহারা হয়ে এই অভিজ্ঞান লাভ করলেন যে দাপুটে দুর্নীতিমাস্টারদের টিকিগুলো বেশ শক্ত সুতোয় বাঁধা--যে সুতো স্পর্শ করার অনুমতি তাঁর নেই ! এই পরিস্থিতিতে দলের মধ্যে একটি বিভাজন রেখা তৈরি করতে হল তাঁকে যার একদিকে প্রবল দাপুটে দুর্নীতিবাজরা যা খুশি তাই করে যাওয়ার লাইসেন্স প্রাপ্ত--অন্যদিকে বিপুল পরিমাণে বিক্ষুব্ধ হতাশ প্রায় দলনিরপেক্ষ অবস্থানে চলে যাওয়া নেতাকর্মীর দল। এদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের যাদুকাঠি প্রশান্ত কিশোরের হাতে নেই। তবু তাঁর চেষ্টায় যা হল তাতে দলের ভেতরের অসংখ্য ফাটলের চিহ্ন বাইরে বেরিয়ে এল ! মমতা যখন নিশ্চিন্তে রাজ্য ও সর্বভারতীয় রাজনীতি করতেন মুকুলের ওপর দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে তখন কিন্তু দলের এ চেহারা ছিল না। কাটমানি-তোলাবাজি-সিণ্ডিকেটরাজ-নিয়োগপত্র নীলামে তোলা--ইতিত্যাদি’র রমরমা যে ছিল না তা নয়--কিন্তু তখন দলে দলে সামনে এসে কান ধরে ওঠবোস করে কাউকে বলতে শোনা যায় নি--আমি কাটমানিখোর তোলাবাজ চোর--আমি টাকা ফেরৎ দিয়ে দেবো ! প্রশান্ত কিশোর এটা করে দেখাতে পেরেছেন। এতে দলের কি সত্যি সত্যি কিছু লাভ হয়েছে? দল কি এর ফলে ড্যাং ড্যাং করে একুশের ভোটে জিতে যাবে? তেমন কোনো লক্ষণই কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বরং দুর্নিিতর অভিযোগে গোটা রাজ্য তোলপাড় হচ্ছে। ‘ছোটখাট ভুল’ বলে আর এই সুনামি ঠেকানো যাচ্ছে না। বিজেপি ‘পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা’র যথাসাধ্য ডিভিডেণ্ড কুড়িয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি রাস্তাঘাটে বিজেপি সাংসদ-মন্ত্রী সহ দিলীপ ঘোষকে পুলিশি অবরোধের মধ্যে রেখে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ছবি প্রতিদিন প্রায় ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে ! মুচকি মুচকি হাসছেন বিরোধী নেতারা। বিজেপি ঠিক যেমনটি চাইছে প্রশান্ত কিশোরের কর্পোরেট মেধা যেন ঠিক সেটাই সুবর্ণপাত্রে সাজিয়ে তুলে দিচ্ছে তাদের হাতে ! ডাল মে বহুৎ বহুৎ কালা নেই তো ! নিজেদের মাথায় টোকা মারার কথাও কেউ ভাবছে না কেন কে জানে !
হাতে সময় প্রায় নেই বললেই চলে। মমতা নিজে ভয়ঙ্কর ব্যস্ততার মধ্যে প্রায় দিশেহারা অবস্থায় রয়েছেন। ওদিকে মুকুল-দিলীপ এবং মোদী-অমিত শাহ ঘুঁটি সাজাবার অঢেল সময় পাচ্ছন এবং তার সদ্ব্যবহারও করছেন। তাঁদের কেউ ব্যস্ত বিব্রত করছে না--তাদের ঘরের মধ্যে রেখেই রাস্তায় নাচানাচি করছে তৃণমূল কংগ্রেস--ভাবছে জনআবেগ বিপুল জনসমর্থনে পরিণত হয়ে তাদের ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ২০১৬ সালের পরিস্থিতিও নয়। ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে গেছে তৃণমূল কংগ্রেস। অনেকটাই স্বেচ্ছায়। এই পরিস্থিতি থেকে টেনে তোলার ক্ষমতা প্রশান্ত কিশোরের আছে বলে যারা মনে করছেন তারা রাজনীতি বোঝেন না--রাজনীতির প্রকৃত পাঠ তাদের এখনও নেওয়া হয় নি। এই পরিস্থিতিতে দলের অস্তিত্ব এখনও নির্ভর করছে মমতার ১০০% সক্রিয়তার ওপরেই। তিনি কতটা পারবেন কিংবা আদৌ পুরো দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেবেন কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে।
পচে যাওয়া গন্ধ ওঠা দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে আর একসেকেণ্ডও দেরি না করে ঝেঁটিয়ে বিদেয় না করতে পারলে--প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার লেনদেন বন্ধ করতে না পারলে এবং বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হত্যা করা হচ্ছে--এই অভিযোগ করার সুযোগ তুলে না নিলে আগামী ফলাফল কিন্তু আর একটি বিনা মেঘে বড়মাপের বজ্রাঘাতে ছত্রকার হয়ে যেতে পারে !
রাজ্যের মেধাবী বেকার ছেলেমেয়েদের নীলামে ডাকতে বাধ্য না করে তাদের মেধার মর্যাদা রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। কমাতে হবে ঔদ্ধত্য প্রগলভতা বাচালতা এবং অশালীন অমার্জিত ভাষায় ব্যক্তিআক্রমণের নেশা। রাজ্যের মানুষ কোনো দলেরই চাকরবাকর নন। তাদের করুণা ও ক্ষমাঘেন্নার ওপর নির্ভর করেই রাজপাটের সুযোগ অর্জন করে নিতে হয়। চটকদারি এবং দীর্ঘস্থায়ী জনকল্যাণকর নয় এমন রাজনীতি বা কর্মসূচী বেশিদিন মানুষকে ধরে রাখতে পারে না। এটা বুঝে উঠতে না পারলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
প্রসঙ্গতঃ আরও অনেক কথা বলার ছিল--এমনিতেই বেশ দীর্ঘ হয়ে গেল এই প্রসঙ্গ। নির্বাচনের আগে আরও অনেক কথাই বলতে হবে। আগাীকাল বলব কি করলে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ গড়ে তোলা যেত এবং তেমন কিছু ঘটার সম্ভবনা রয়েছে কিনা তাই নিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.