Header Ads

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে !! (১)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
সিপিএম তথা বামফ্রন্ট নয় নয় করেও প্রায় সাড়ে তিন দশক রাজত্ব করে গেছে। প্রথম দু’দশকে তাদের রাজপাটের ওপর একটা সহনযোগ্য মলাট ছিল--গলায় গামছা দিয়ে বা বুকের ওপর পা দিয়ে ভোট ছেনতাই করতে হত না খুব একটা। তার সবচেয়ে বড় কারণটা ছিল তাদের সর্বস্তরের সুসংগঠিত সংগঠন। ছাত্র-যুব-শিক্ষক-মহিলা-শ্রমিক-সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট থেকে যেখানে যতগুলো সংগঠনের প্রয়োজন সিপিএম তা তৈরি করতে পেরেছিল এবং তাদের দিয়ে কি ভাবে ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানো যায় তা নিয়ে অবিরাম দলীয় স্তরে রিসার্চ-ওয়ার্ক চলতো সময় বিশেষে প্রমোদ দাশগুপ্ত-সরোজ মুখোপাধ্যায়-অনিল বিশ্বাসের নিবিড় ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে।

সংগঠনগুলোর ভেতরে খেয়োখেয়ি কামড়াকামড়ি’র আত্মঘাতী রাজনীতি মাথা চাড়া দেওয়ার বিশেষ সুযোগ অনিল বিশ্বাসের আমলেও তৈরি হয় নি। দলীয় অধঃপতনের সূচনা হয়েছিল অনিল বিশ্বসের মৃত্যুর পর। দলের মাথায় যিনি বসলেন তিনিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণের বিচারে বঙ্গ সিপিএমের একজন ‘প্রবাদ প্রতিম’ নেতা বটে ! সবসময়ে খবরের শিরোনামে থাকার প্রবল নেশা থেকে তিনি আজও বেরিয়ে আসতে পারেন নি। মিডিয়ার ফোকাস তাঁকে সবসময়ে ঘিরে থাকুক এটা জ্ঞানে বা সজ্ঞানে তিনি চেয়ে থাকেন এবং এর জন্যে তাঁর কেন যেন মনে হয়েছিল--নানান রকমের অঙ্গভঙ্গি সহ ক্যারিকেচারের পাশাপাশি অসংলগ্ন বাচালতা করাটাও আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে না নিতে পারলে জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠা যাবে না এবং দলের ভাবমূর্তির সঙ্গে একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করা যাবে না ! ফলে অনিল জমানার পরের দিন থেকেই বলতে গেলে দলের ভেতরের নানা স্তরে যেসব দুর্বলতা চাপা দেওয়া ছিল তা প্রকট হতে থাকলো।
আর এক প্রবাদ প্রতিম নেতা জ্যোতি বসু যতদিন  মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দাপটের সঙ্গেই বিরোধীদের সামলে কেন্দ্রকে প্রায় নির্বাক্ রেখেই রাজত্ব করে গেছেন--শুধু সামলাতে পারেন নি দিল্লীর  ‘পালিত বুড়ো’দের। আক্ষরিক অর্থেই সে সময়ে একজন পাঞ্জাবী বৃদ্ধ দলের সর্বাধিনায়ক থাকলেও তাঁকে নিয়মিত কারাতের করাতের নিচে থাকতে হয়েছে। করাতের ধার তখন বেশ তীক্ষ্ন ছিল--কারণ, কারাত লবি অর্থাৎ দক্ষিণের লবির প্রতাপের কাছে জ্যোতি বসুর প্রায় অলৌকিক জ্যোতিও মারাত্মকভাবেই মলিন হয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নিশ্চিত সুযোগও যখন দক্ষিণী করাতের নিচে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে যা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হিসেবে--বিশেষ করে সিপিএমের দলীয় হারাকিরি রাজনৈতিক দলিলে চিরকাল কালো কালিতে লেখা থাকবে। জীবনে একটি নির্বাচনেও না দাঁড়িয়ে ময়দানী রাজনীতি না করে শুধু দলীয় বৈঠকে এবং নির্বাচনী প্রচার মঞ্চে মাইক ফুঁকে তত্ত্বের কচকচানি করেই কারাত লবি পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমকে নাবালক ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে আজও ! বঙ্গ সিপিএমের দায়িত্ব শুধু ‘পালিত বুড়ো’দের দাদাগিরি যাতে সমান প্রতাপে চলতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করা।
জ্যোতি বসু’র পরে মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আগাপাশতলা শ্বেতশুভ্র ইমেজ নিয়ে যিনি এলেন তাঁর শিক্ষাদীক্ষা সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনা এবং সততার প্রতি আপোষহীন জেদ খুব সঙ্গত কারণেই তাঁকে অহঙ্কারী করে তুলেছিল। তাঁর অধিকাংশ সিদ্ধান্তের মধ্যেই দল তো বটেই বিরোধী নেতানেত্রীরাও ঔদ্ধত্য এবং দাম্ভিকতাকেই দেখতে পেতেন। বঙ্গ রাজনীতিতে পুরোপুরি ‘মিসফিট’ এই নেতার প্রকৃত জায়গা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর অথবা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ। দলের মধ্যে (নীতি নির্ধারক) এমন এক পিস্ নেতৃত্বও ছিল না যার সঙ্গে তাঁর মানসিক সংযোগ সত্যিকারের কিছু প্রয়োজনীয় পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তৈরি হতে পারে। বঙ্গ সিপিএমের অধঃপতনকে যারা দ্রুত নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল দলীয় সেইসব আকাট মুর্খদের সঙ্গে তো বটেই--‘পালিত বুড়ো’দের মধ্যে অতি সক্রিয় থাকা বঙ্গবিদ্বেষী ভামেরাও নানাভাবে তাঁকে বিরক্ত ও বিব্রত করে গেছে। ফলে সিপিএম বিরোধী নেতাদের পক্ষে বুদ্ধবিরোধী রাজনীতিকে  সফল করে তোলার লড়াইটা খুব সহজ হতে পেরেছিল। দলের ভেতর থেকে সর্বাঙ্গীণ সমর্থন যদি তিনি পেতেন--তলায় তলায় সুরঙ্গ কাটার রাজনীতি যদি তাঁকে প্রতি মুহূর্তে বিব্রত না করতো তাহলে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই অন্যভাবে লেখা হত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য’র দুর্ভাগ্য তিনি যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে বসলেন ততদিনে দলের প্রতিটি স্তরে পচন ধরে গেছে। চিকিৎসার কোনো সুযোগই যেমন তিনি নিজে পান নি--দলও--বিশেষ করে ‘পালিত বুড়ো’রাও তাঁকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে তাঁর পাশে সেভাবে দাঁড়ান নি। আজ বুদ্ধবাবুকে দেখলে সত্যি সত্যি বেশ মানবিক দুঃখ ও হতাশা তৈরি হয় অনেকের মধ্যেই। তাঁর হতাশা তাঁর প্রগাঢ় অভিমান তাঁর স্বেচ্ছা নিপীড়ন মানুষ হিসেবে অনেককেই ব্যথিত করে।
কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কারাতের করাতি সিদ্ধান্ত দলকে প্রায় শুইয়ে দেওয়ার ভবিষ্যৎ রচনা করার দিনটিতেই বোঝা গিয়েছিল  সিপএমের কফিনে শেষ পেরেকটা ‘পালিত বুড়ো’দের ক্যাপ্টেন কারাত-ই ঠুকে দিলেন ! প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুধূ পশ্চিমবঙ্গ থেকেই নয় --গোটা দেশ থেকেই বিলুপ্ত হতে বসেছে সিপিএম। পশ্চিমবঙ্গে অলআউট লড়াইয়ের যে ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছিল তাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস চিরকালই আবেগতাড়িত সংগঠননির্ভর দল। রেজিমেন্টেড সংগঠন কোনো স্তরে কখনোই ছিল না। নেতারা যাকে যেখানে বসাতেন (একটা দলীয় নির্বাচন-নাটক অবশ্য অভিনীত হত) তিনিই সংগঠনের নেতা হয়ে বসতেন। এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে সোমেন মিত্রকে চ্যালেঞ্জ করেও মমতা যখন হেরে গেলেন--তখন বুঝলেন এই কংগ্রেসে থেকে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। তাই জীবনের সাংঘাতিক ঝুঁকিটি তিনি নিয়েই ফেললেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি দলত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন ! তার আগেই তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামীরা মুকুল রায়ের নেতৃত্বে ও তৎপরতায় নতুন দল গঠনের কাজ বেশ খানিকটা গুছিয়ে ফেলেছিলেন। মমতার এই সিদ্ধান্ত শুধু বঙ্গ রাজনীতিতেই নয় গোটা দেশের রাজনীতিইে এক চরম দুঃসাহসী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। প্রথম প্রথম তাঁকে নিয়মিত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। প্রকাশ্যে মুখে তাঁকে সবসময়ে উপেক্ষা করার ভাব দেখালেও--পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করলেও সুযোগ পাওয়া মাত্র হার্মাদদের দিয়ে প্রাণঘাতী আক্রমণ শানাতেও দ্বিধা করে নি সিপিএম। মমতার ওপর সেই একের পর এক রক্তাক্ত হামলা রাজ্যের মানুষকে বিচলিত করেছে--ক্ষুব্ধ করে তুলেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। মমতার পক্ষে জনআবেগ তৈরিতে সিপিএম যে আত্মঘাতী রাজনীতি করেছে তার সুফল তুলতে রাজ্যব্যাপী সুসংহত সংগঠন ছাড়াই মমতার পক্ষে যে মারাত্মক কঠিন হয় নি সেটা এখন দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। ‘পালিত বুড়ো’দের অসম্ভব রকমের আত্মতুষ্টি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর অগাধ বিশ্বাস এবং পতন যে সব কারণে স্পষ্ট হয় সেই মানুষকে মানুষ জ্ঞান না করা--সবাইকে মুর্খ অচেতন অ-সাংস্কৃতিক অ-তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক বিচারে একেবারেই নাবালক ভাবার যে নির্বোধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকল সিপিএম তথা বামফ্রন্ট তারই এক অপ্রত্যাশিত বিস্ময়কর (সিপিএমের বিচারে) প্রবল ধাক্কায় একেবারে ছিটকে গেল সিপিএমের রাজপাট। শুধু ছিটকেই গেল না--গোটা দেশের রাজনীতিতে রীতিমতো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল ! এই অবস্থা থেকে সিপিএমের উঠে দাঁড়ানোর আগেই প্রবল বিক্রমে তাদের শূন্যস্থান ভরাট করে রীতিমতো প্রাসঙ্গিকই হয়ে উঠলো না বিজেপি--আগামী বিধান সভা নির্বাচনেও তাদের প্রায় অপাংক্তেয় করে রাখার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠলো। বিজেপি’র অপ্রতিরোধ্য উত্থানের পেছনে শুধু তৃণমূল বা কংগ্রেসের অবদান নেই--সিপিএমের অবদানও কিছুমাত্র কম নয় !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.