একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য রাজনীতি কি নতুন সমীকরণের দিকে যাচ্ছে!! (২)
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যদি রাজ্য রাজনীতিতে কোনো নতুন সমীকরণ তৈরি হয় তাহলে বাম ও কংগ্রেসের অবস্থানটা কি দাঁড়াবে সেটা এখনও সামান্য হলেও একটা প্রশ্ন হিসেবে সামনে উঠে আসতেই পারে। এমনিতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে গত লোকসভা নির্বাচনের চেয়ে ভাল কিছু করে দেখানোর জায়গায় সিপিএম-কংগ্রেস উঠে আসতে তো পারেই নি--বরং বলা যেতে পারে আরও বেহাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে তারা। মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীদের ইদানীংকার কথাবার্তা শুনে মনে হতে পারে তাদের মতো সর্বজ্ঞানী পরম প্রজাহিতৈষী উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী অত্যন্ত সুশীল নেতাদের হাতে রাজ্যটাকে তুলে দিলে রাজ্য জুড়ে মলয় বাতাস বইবে--স্বাস্থ্যে শিক্ষায় সম্পদে রাজ্যের মানুষ ঝিকমিক করে উঠবে !
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তাদের রাজপাটের প্রায় সাড়ে তিন দশকের ইতিহাস নির্বোধ রাজ্যবাসী এখনও যে ভুলতে পারে নি তা ২০১১ থেকে আজপর্যন্ত যতগুলো ভোট হল তার প্রত্যেকটিতে বুঝিয়ে দিতে কসুর করছে না। তাঁরা এখন মুখে যে সব কথা বলছেন যেসব পরামর্শ দিয়ে চলেছেন তার সিকিভাগও তারা নিজেদের শাসনামলে প্রজাস্বার্থে করে দেখাতে পারেন নি। ফলে সুযোগ পাওয়ামাত্র জনগণ তাদের নয়নের মণিকে কোমায় পাঠিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করে নি। তারপর থেকে সিপিএম তথা বাম নেতাদের রাজনৈতিক পুঁজি বলতে স্রেফ বড় বড় বোলচাল সহ চিরকালীন সেই পাঠশালার পণ্ডিতমশায়ের ভূমিকায় নিরন্তর নেচে ওঠা ছাড়া আর কিছুই নেই যা দেখে জনগণ তাদের দিকে ঘুরে তাকাবার কথা ভাবতে পারে। অন্ততঃ আগামী আট-ন’মাসের মধ্যে যে তাদের বামপ্রীতি উপচে পড়বে না এটা বুঝতে কারুর কোনোরকম সমস্যা নেই।
পরিস্থিতি এখন এতই অনিশ্চিত যে গোটা রাজ্যে একটা আসনেও সিপিএম নিশ্চিতভাবে জিতবেই তা বলার সাহস প্রায় কারুর নেই। কংগ্রেসের অবস্থাও প্রায় একই রকম। তবু এর মধ্যেও মুর্শিদাবাদ ও মালদহে গোটা কয়েক আসন কংগ্রেসের জুটলেও জুটতে পারে। আগেই বলেছি, বাম ও কংগ্রেসের ঝুলিতে মেরেকেটে ১০ থেকে ১৫-টি আসন গেলেও যেতে পারে--হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য শোনালেও এই মুহূর্তের এটাই বাস্তব ছবি। রাজনীতি করতে চান কিন্তু সিপিএম বা কংগ্রেসে থেকে তিলে তিলে ভবিষ্যৎ ক্রমশঃ অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছে বুঝেও যারা এখনও দলে টিকে আছেন তৃণমূল ও বিজেপি’র মতাদর্শকে গ্রহণযোগ্য নয় বিবেচনা করে তারাও একটা সম্মানজনক বিকল্পের অপেক্ষা করছেন। তৃণমূল-বিজেপি নয়, আবার সিপিএম-কংগ্রেসও নয়--নতুন একটা পঞ্চম রাজনৈতিক জোট যাদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে কারা এ রাজ্যে সরকার গঠন করবে। রাজ্য রাজনীতিতে যদি তেমন কোনও সমীকরণ তৈরি হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়--বিজেপি’র স্বপ্নভঙ্গ হবে নিদারুণ ভাবেই। রাজ্য কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরীর অবস্থাও বেশ করুণ। তিনি এখন কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা হিসেবে সংসদে হাত-পা ছুঁড়ছেন বটে, তবে তা ক’দিনের জন্যে তিনি নিজেও সেটা জানেন না। বিজেপিতে নাম না লেখালে কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগও রীতিমতো সুদূরপরাহত। রাজ্য রাজনীতিতেও কংগ্রেস প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। রাহুল গান্ধীও আদাজল খেয়ে লেগেছেন কংগ্রেস দলটাকেই তুলে দেওয়ার জন্যে। মোদী বিরোধিতায় তিনি যে প্রতিদিন বালখিল্য তুর্কিনাচন নেচে বিরোধীদের হাতে খিল্লির মশলা তুলে দিচ্ছেন তাতে রীতিমতো বিরক্ত হলেও বহু কংগ্রেস নেতা কিছু বলতেও পারছেন না আবার মেনে নিতেও পারছেন না। এইরকম একটা অবস্থায় তিনিও যদি কোনো সম্মানজনক বিকল্পের কথা ভাবেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শুভেন্দু-সুব্রত-শোভন-সাধন পাণ্ডে-রাজীব-কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ সহ আরও বেশ কিছু তৃণমূলে আশ্রয় নেওয়া নেতাদের সঙ্গে বিজেপিতে সঙ্ঘ উৎপীড়িত উপেক্ষিত মুুকল ও তার হাত ধরে এক ঝাঁক নেতা যদি বেরিয়ে এসে নতুন একটি জোট বা দল গঠন করেন তাহলে রাজ্যের মানুষ যদি সেই জোট বা দলের পাশে গিয়ে হৈ-হৈ করে দাঁড়িয়ে পড়েন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমি যাদের নাম উল্লেখ করলাম তাদের সম্পর্কে আমার কাছে অবশ্য নিশ্চিত কোনো খবর নেই। সম্ভাবনার কথা ভেবেই তাদের নাম উল্লেখ করলাম। এরা খুব প্রয়োজনীয় এবং জরুরি হলেও এমন সিদ্ধান্ত যে নেবেন-ই এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অনেক সমস্যা আছে এমন একটা ক্রান্তিকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রধান সমস্যা ‘ইগো’। দ্বিতীয় দুশ্চিন্তা অনিশ্চয়তা। সবচেয়ে বড় সমস্যা--এদের মধ্যে অনেকেই ‘অধীনতামূলক রাজনীতি’তে অভ্যস্ত--ঝুঁকি নেওয়ার অভ্যাস বা দৃঢ়তা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে প্রতিনিয়ত অপমান উপেক্ষা মর্যাদাহানির বৃত্তেই হামাগুড়ি দেওয়ার রাজনীতিতেই তুষ্ট থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ‘ইয়েস স্যার’ বা ‘ইয়েস ম্যাম’ বুলি সর্বস্ততার মধ্যেই এরা ডানা ঝাপ্টাতে ভালবাসেন। সুতরাং এমন একটা সত্যিকারের পরিবর্তনের পরিবর্তন সাধনে তারা একত্রিত হয়ে নতুন একটা জোট তৈরি করে রাজ্যের মানুষকে স্বস্তি দেবেন এমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই যে তৃণমূল ও বিজেপিতে এখন অনেকেই প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। কিন্তু হাস্যকর প্রবল ‘ইগো সমস্যা’ ও সাহসের অভাব তাদের জীবন্মৃত নেতা হিসেবে দলের আনাচে কানাচে ঝুলে থাকতে বাধ্য করছে।
সেক্ষেত্রে যদি নতুন একটা বিকল্প পঞ্চম জোট তৈরি না হয় তাহলে কি হতে চলেছে একুশে? মুকুল হয়তো বিশেষ কোনো দায়বদ্ধতার কারণে অমিত শাহ’র হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দেবেন এবং তার ফলে মুকুলের রাজনৈতিক প্যাঁচপয়জারে তৃণমূলের ভিত কেঁপে উঠতে পারে। দল ছাড়তে পারেন এমন তালিকাভুক্ত নেতারা অনেকটাই বাধ্য হয়েই মুকুলের হাত ধরবেন। তাদের কেউ কেউ জিতেও যাবেন। প্রশান্ত কিশোরকে যিনি বা যারা দলের ভালোর জন্যে বহুমূল্যের বিনিময়ে নিয়ে এসেছিলেন তাদের অত্যন্ত গূঢ় ও গভীর গোপন উদ্দেশ্য ছারখার হতে চলেছে। তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও একই সঙ্গে বিরাট প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে কয়েক মাস সময় লাগবে। তৃণমুলের রাজনীতিতে ভার্চুয়াল ন্যাকামির যে কোন জায়গা নেই সেটা চড়া মূল্যের বিনিময়ে বুঝতে হবে আগামী নির্বাচনেই।
দিনহাটা থেকে চাঞ্চল্যকর যে আওয়াজ উঠেছে তার মধ্যে যাত্রাপালার নায়কের ন্যাকামো ছাড়া বিশেষ উদ্বেগের কিছু নেই। কিন্তু হাওড়া থেকে অত্যন্ত স্থিতধী ভদ্র নম্র নেতা রাজীব ব্যানার্জী যে বিষ্ফোরক মন্তব্য করেছেন তাতে কানের পর্দা ফেটে যাওয়া বিচিত্র নয়। ইতিমধ্যেই শুভেন্দুকে চার জেলার জায়গীরদার বানিয়ে তুষ্ট করার যেমন চেষ্টা শুরু হয়েছে তেমনই হয়তো রাজীবের মান-অভিমানও ‘ভার্চুয়ালি ট্যাকল্’ করে নেওয়ার চেষ্টাও হবে। একই উদ্দেশ্যে জলপাইগুড়িতে মোহন বসুকে ট্যাকল্ করতে ছুটে গেছেন অরূপ বিশ্বাস ! ‘অধীনতামূলক স্বাধীনতা’য় অভ্যস্ত নেতাদের নিয়ে কিছুদিন সমস্যা থাকে না--কিছুদিন ট্যাকল্ও করা যায় কিন্তু দীর্ঘকাল যে করা যায় না সেটা আর ধমকে চমকে ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। এইসব অনিবার্য্য ঘটনার ঘনঘটায় দল যে টালমাটাল হবেই এটা বোঝার জন্যে মগজ ভাড়া না করে সাংগঠনিক সক্রিয়তার মধ্যে থেকেই বোঝা যেত এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেওয়া যেত। কিন্তু সর্বনাশটা দানা বেঁধেছে দলের সর্বস্তরে বেপরোয়া অর্থলোলুপতার রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণেই। নির্দিষ্ট কোটা পূরণের তাগিদে এবং নিজের অভাব পূরণের উন্মত্ত তাগিদে টাকা হাতানোটাকেই দলীয় কর্তব্য বলে ধরে নিল যারা তারা সিপিএমর হার্মাদই হোক বা লোকাল কোনো সমাজবিরোধী--তারাই সামনের মুখ হয়ে উঠলো--পেছনে চলে গেল সামনের উজ্জ্বল মুখগুলো। পথেঘাটে সভা-সমিতিতে বিরোধী দলের লোকজন তো বটেই যে কেউ আঙুল তুলে --চোর কাটমানিখোর তোলাবাজ বলছে নির্দ্বিধায় ! নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হবে না? মুকুল রায় ভুলে যাবেন--কেন তাকে তাঁর নিজের হাতে গড়ে তোলা দলটাকে ছেড়ে আসতে হলো? প্রতিশোধ নেবেন না? প্রথম ঝাপ্টা দিয়েছেন লোকসভা নির্বাচনে--আগামীতে বড় ঝাপ্টার প্রস্তুতি নিলে তাকে তো দু’হাতে ঢেলে সব রকম সহায়তা দেবেনই অমিত শাহ। এখন শুধু এটাই দেখার তৃণমূল ও বিজেপিতে সত্যি সত্যি যাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তারা কি করেন রাজ্যের স্বার্থে রাজ্যের মানুষের স্বার্থে !!
কোন মন্তব্য নেই