Header Ads

মুকুল-শুভেন্দু-ই বড় ফ্যাক্টর একুশের নির্বাচনে !! (২)

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

একুশের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মুকুলকে নিয়ে তুমুল চর্চা ও জল্পনা চলতেই থাকবে। কারণ, মুকুল দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরই প্রবল শিরঃপীড়ার কারণ। পদে পদে উপেক্ষা হেনস্থা কোণঠাসা করার অত্যন্ত নিম্নমেধার চক্রান্তের শিকার হয়ে নিজের হাতে গড়ে তোলা দল ছেড়ে বেরিয়ে আসার মর্মান্তিক জ্বালার এখনও পুরোপুরি উপশম হয় নি মুকুল রায়ের। সুতরাং তাঁর রাজনৈতিক অঙ্ক মেলানোর মেধা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা যাদের আছে তাদের স্বস্তিতে থাকার কথা নয়।

তৃণমূলে এরকম দু’একজন নেতা আছেন যারা মুকুলকে নিয়ে আদৌ নিরুদ্বেগ থাকতে পারছেন না। খোদ তৃণমূল নেত্রী গত লোকসভা নির্বাচনে মুকুলের অঙ্ক মেলানোর খেলায় যেভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাতে এটা স্পষ্টতঃই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না যে তিনি মুকুলকে নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই। এটা আরও বেশি করে বোঝা গেছে যখন তিনি তৃণমূলকে বাঁচানোর তাগিদে মুকুলের বিকল্প হিসেবে এক আদ্যান্ত কর্পোরেট মগজ ভাড়া করে আনলেন বহুমূল্যের চুক্তিতে ! কিন্তু সেই কর্পোরেট মগজ মুকুলের বিকল্প হয়ে ওঠা তো দূরের কথা মাঝে মাঝে কিছু চটকদার তুবড়ি উড়িয়ে দলের ভেতরের কঙ্কালসার কাঠামোটাকে প্রকাশ্যে তুলে ধরলেন। তার ভেতরের অজস্র ফাটল দুর্নীতি’র অসংখ্য ছিদ্র জনতার চোখের সামনে প্রকট হয়ে উঠলো। দলের প্রতিটি স্তরে প্রমাদ গোণা শুরু হয়ে গেল। সত্যি বলতে কি বলা ভাল--ত্রাহি মধুসূদন রব উঠে গেল !
ঠিক এই জায়গাটাতেই আমার বার বার সঞ্জয় গান্ধী এপিসোডের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে যায়। সঞ্জয় গান্ধী যুব কংগ্রেসের নেতুত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে গোটা দেশব্যাপী একই সঙ্গে দলীয় ও সরকারি কর্তৃত্বকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের বহু প্রবীণ দাপুটে নেতারাও মারাত্মক ক্ষুব্ধ ও হতাশ হলেও সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেন নি। সেই এপিসোডের বিস্তৃত বিশ্লেষণে যাচ্ছি না--তবে এটুকু উল্লেখ করতেই হবে যে সঞ্জয়ের সুকৌশলে গড়ে তোলা যুবশক্তি ও তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধিকারের মারাত্মক চড়া মূল্য চোকাতে হয়েছিল দলকে। তখন ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে কোনো প্রশান্ত কিশোর ছিল না--ছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এবং তাঁর রাজনৈতিক মগজ। তাঁর পরামর্শেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সরকার ও দলকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী--কিন্তু পারেন নি দলের ভাঙন রোধ করতে এবং সরকার বাঁচাতেও। চরম মূল্য দিতে হয়েছিল তাঁকে।
রাজ্য রাজনীতিতেও কি কোথাও কংগ্রেসের এই দুঃসময়ের ছায়া পড়তে দেখা যাচ্ছে? দক্ষ সংগঠক মুকুল রায়কে কেন দল ছাড়তে হল? মুকুলের পরেই দক্ষ ও জনপ্রিয় সংগঠক হিসেবে যার নাম দলের কর্মী সমর্থকদের মুখে মুখে  ফেরে সেই শুভেন্দুকেও কেন ভাবতে হচ্ছে দলে তাঁর গুরুত্ব ও অবস্থান নিয়ে? কেন তাঁর সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। বিশিষ্ট প্রবীণ নেতাদেরও কেউ কেউ ক্ষোভ এবং বিরক্তি চেপে রাখতে পারছেন না। কেন উত্তরবঙ্গ সফরের রেকর্ড তৈরি করেও মমতা উত্তরবঙ্গ থেকে একজন সাংসদও দিল্লিতে পাঠাতে পারলেন না? প্রশান্ত কিশোর সামগ্রিকভাবে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার পাশাপাশি সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরির চেষ্টা না করে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য পূরণে নিজের মগজ ঢেলে দিচ্ছেন কিনা তার কোনো সঠিক পর্যালোচনা হচ্ছে না বলেই অনেকে মনে করছেন এবং বিরক্ত ও হতাশ হচ্ছেন।
শুভেন্দুরও বিরক্তি ও হতাশা মাঝে মাঝেই তার মন্তব্যের মধ্যেই ফুটে উঠছে। দলের একাংশে একটা জোরালো আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে--মুকুলের দশা ঘটতে চলেছে না তো শুভেন্দুরও? যদি তাই হয় তাহলে দলটা কতদিন টিকবে? মুকুল বরাবরই পথে নেমে জনতার মধ্যে মিশে রাজনীতি করার বদলে প্রমোদ দাশগুপ্ত-অনিল বিশ্বাসের মতো দলের মেরুদণ্ড হিসেবে টেবিলে বসে দলকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দেওয়ার রাজনীতি করতেই চেয়েছিলেন--সেক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য নিয়ে কোনো সন্দেহই কেউ করেন না। তাঁর শত্রুরাও পারেন না তার রাজনীতির গাণিতিক মেধা নিয়ে সন্দেহ করতে।
শুভেন্দু কিন্তু প্রথমেই জননেতা--তারপরে নিজের প্রবল আত্মশক্তি ও জনপ্রিয়তার পুঁজিতে স্বাভাবিক কারণেই ভাল সংগঠক। তাঁর মতো জনপ্রিয় সংগঠক এই মুহূর্তে আর দ্বিতীয় একজনও দলে নেই। কোন কোন চামচা মহল আমার এই কথায় বেদম চটে যাবেন জানি, তবু আমি যতটুকু রাজনীতি বুঝি তার জোরেই এ কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। জনপ্রিয় সংগঠক বলেই দলনেত্রী যখনই যেখানে দলের কাঠামো নড়বড়ে হয়ে উঠতে দেখেছেন সেখানেই শুভেন্দুকে তা মেরামত করতে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। দেখতে দেখতে কাঠামো যেমন শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে--একই সঙ্গে শুভেন্দুর জনপ্রিয়তা ও অনুগামীর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতোই বেড়ে গেছে। গোটা জঙ্গলমহল তো বটেই--রাজ্যের প্রায় সর্বত্র (উত্তরবঙ্গেও) শুভেন্দুর এই জনপ্রিয়তা এবং যুবকর্মী সমর্থকদের ব্যাপকহারে অনুগমন অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই দলের একাংশে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে ফেলল। মুকুলের মতো শুভেন্দুকেও দলে কোণঠাসা করে ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে যে যুব আবেগ ও যুব শক্তিকে সংহত করে তার অভিমুখ শুভেন্দুর দিক থেকে অন্যদিকে সরাতে হবে এটা ভীষণভাবে অনুভূত হতে থাকল। সকলেই জানেন--প্রশান্ত কিশোরের কাজকর্ম শুভেন্দুর অভিজ্ঞতালব্ধ রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না একেবারেই। শুভেন্দুর রক্তে বাবা শিশির অধিকারীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং নন্দীগ্রাম আন্দোলনের চূড়ান্ত সংগ্রামের যে সম্পৃক্ততা রয়েছে তার ছিটেফোঁটাও প্রশান্ত কিশোরের মধ্যে নেই। সুতরাং প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে শুভেন্দুর কোনো সম্পর্কই প্রায় তৈরি হয় নি। ফলে প্রশান্ত কিশোর যে আদাজল খেয়েও শুভেন্দুর রাজনৈতিক মাটি একটু আলগা করতে পারেন নি এটা যত স্পষ্ট হয়েছে ততই শুভেন্দুকে মুকুলের মতোই কোণঠাসা করার রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ছবিটাই স্পষ্ট হয়েছে সাংগঠনিক রদবদলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে। শুভেন্দুর সক্রিয়তার পরিধিকে একেবারে ছোট করে ফেলার জন্যে পর্যবেক্ষকের পদটাই তুলে দেওয়া হল। শুভেন্দুকে আর জেলায় জেলায় ছুটে বেড়াতে হবে না--যাদের সংযোগে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছিল তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও হবে না। তাঁকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটা বোঝাতে তাঁকে সাত সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য করা হল। কিন্তু যে কোনো ভোটাভুটিতে তাঁর বিরোধী (যদি মতের অমিল হয়) ভোটের কোনো মূল্যই থাকবে না সংখ্যাগরিষ্ঠ চার সদস্যের ভোটের কারণে--এই চার সদস্য হলেন--রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মুখ্যসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সর্বভারতীয় যুব তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ! শুধু শুভেন্দু-ই নন তাঁর অসংখ্য অনুগামীরাও বুঝলেন দলে শুভেন্দুর গুরুত্ব কতটা বাড়ল। কিন্তু অনুগামীদের প্রত্যাশা ছিল একেবারেই অন্যরকম--অনেকটাই বেশি--ফলে তীব্র হতাশায় তাদের প্রতিক্রিয়া যে তীক্ষ্ন হবেই সেটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয় !
ফলে রদবদলের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠে গেল রাজনৈতিক মহলে--এবার তাহলে শুভেন্দু কি করবেন? নানারকম জল্পনাও তৈরি হল। কেউ ভাবছেন শুভেন্দু সদলে বিজেপিতে চলে যাবেন। কেউ কেউ ভাবছেন শুভেন্দু দল ছেড়ে বেড়িয়ে এসে কংগ্রেস-সিপিএম (দাগী হার্মাদ ছাড়া) এবং তৃণমূলেরই ভয়ানক ক্ষুব্ধদের সঙ্গে নতুন একটি জোট তৈরির কথাও ভাবতে পারেন। সেই জোটে যদি মুকুল রায় এবং অধীর চোধূরীও আসেন তাহলেও হয়তো অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অনেকেই এটা ভাবছেন। কিন্তু সেটাও যে খুব সহজ তাও নয়। তবে সম্ভাবনাটা যে তৈরি হতে পারেই তা নিয়ে আমার অন্ততঃ কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচন যদি ছ-মাস পিছিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসনে হয় তাহলে যেসব তৃণমূল বিধায়ক এখনই মনে করছেন টিকিট পেলেও তাদের জেতার বিশেষ চান্স নেই তারা দল ছাড়তে এক সেকেণ্ডও দেরি করবেন না। নিজেদের জেতা নিয়ে তীব্র সংশয়ে প্রায় অবসাদে চলে যাওয়া এরকম ১২০-১২৫ জন বিধায়ক আছেন যারা রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসন ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার কথাই ভাবতে পারছেন না। এদের অনেককেই এমনিতেই ধরে রাখা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েই গেছে। ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তনে রাজ্য রাজনীতিতে যে অপ্রত্যাশিত সমীকরণ তৈরি হতেই পারে এটা অনেকেই মনে করছেন।
তবু এ রাজ্যের রাজনীতিকদের সাহস ও সদিচ্ছা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন থাকার কারণে দেখা যেতে পারে--সহজেই জিতে আসার লক্ষ্যে এরা বিজেপিতেই নাম লেখাচ্ছেন--বিশেষ করে মুকুল যদি তখনও বিজেপিতেই থাকেন--এবং অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে। বিজেপি প্রাণপণে সেটাই চাইবে। এই অবস্থায় শুভেন্দু যদি দলত্যাগের কথা না-ও ভাবেন তাহলেও তাঁর সক্রিয়তা যদি ৫০%-ও কমে যায় এবং সামগ্রিকভাবে তা তাঁর নিজের জেলাকে কেন্দ্র করেই সক্রিয় থাকে তাহলে জেলায় জেলায় বিপর্যয় নেমে আসবে--রদবদলের নামে যে থোর-বড়ি-ডাঁটা, ডাঁটা-বড়ি-থোরের রকমফের করা হয়েছে তাতে বড় ধরণের পতন ঠেকানো যাবে বলে আমার মনে হয় না। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব ফিডব্যাক পাচ্ছি তাতে আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র ইতিবাচক কোনো ভাবনা তৈরি-ই হচ্ছে না।
কাজেই সমস্ত দিক খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে এটা বলতেই পারি একুশের নির্বাচনে মুকুল ও শুভেন্দু সত্যি সত্যি বড় রকমের ফ্যাক্টর হতে চলেছেন। শুভেন্দুর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ওপর আমার বিশেষ ভরসা আছে--তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেই নেবেন।
যত দিন যাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির নানারকম অদলবদল তত স্পষ্ট হবে। সে সব নিয়ে অনেক কিছুই লেখার থাকবে। লেখার ইচ্ছেও থাকবে--সুতরাং এ প্রসঙ্গে আজ এই পর্যন্তই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.