Header Ads

কভিড-১৯-এর খোঁজ এবং মহামারীর ভবিষ্যৎ !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
চিনে আবির্ভূত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে ভাইরোলজিস্টরা সার্স-কোভ-২ -এর জিনে একই ধরনের গল্প দেখতে পেলেন। জানুয়ারিতে হুবেই প্রদেশের এক দম্পতি রোমে আসেন ইউরোপের ঐতিহাসিক শহরটি দেখতে। ২৯ জানুয়ারির মধ্যে তাদের লাজারো স্পালানজানি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হতে হয়। এরপর পরীক্ষা করা হলে তাদের সার্স-কোভ-২ পজিটিভ আসে।
বার্তোলিনি নামে এক ভাইরোলজিস্ট এবং তার সহকর্মীরা হাসপাতালে সেই নারীর কাছ থেকে নেয়া নমুনার জেনেটিক সিকোয়েন্স করে তা জিআইএসএআইডিতে পোস্ট করা সিকোয়েন্সের সঙ্গে তুলনা করে দেখেন। ইতালিয়ান গবেষকরা দেখেন দূরবর্তী ফ্রান্স, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার আরো পাঁচজন রোগীর সঙ্গে এটির বৈশিষ্ট্য মিলে যাচ্চে। সার্স-কোভ-২ স্পষ্টতই গোটা গ্রহ প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে।
 
জেনেটিক এবং জিন সায়েন্স বিশেষজ্ঞ হার্ম ভ্যান বাকেল বলেন, সার্স-কোভ-২-এর সব স্ট্রেইন সমান তীব্র নয়। এর জিনগত মূলের কিছু শাখা বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেখানে অন্যগুলো দ্রুত সমাপ্ত হয়ে যায়।
তার দল নিউইয়র্কে প্রথম জেনেটিক সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে। যা কিনা দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রে হটস্পটে পরিণত হয়। মার্চের মধ্যে শহরটিতে অর্ধডজন কিংবা তার বেশি স্বতন্ত্র সার্স-কোভ-২-এর পরিচিতি পাওয়া যায়। যার মধ্যে মাত্র দুটি স্ট্রেইনের কারণে ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। বাকিগুলো বাইরে এসেছিল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত না হয়েই।
ফলে এটা নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই যে, দুটি স্ট্রেইন সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিল কিনা, বিশেষ করে শহরের অধিক ঘনবসতি অঞ্চলে। উদাহরণস্বরূপ একটি এলাকা, যেখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল এবং তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল কিংবা সেই স্ট্রেইনগুলো আক্ষরিক অর্থেই অনেক বেশি সংক্রামক ছিল কিনা। কিন্তু প্রাথমিকভাবে চলমান কোনো ভাইরাসের জেনেটিক কোড নির্ধারণ করার কাজ বিজ্ঞানীদের ভালোই সহায়তা করতে পারে এবং সরকার ঠিক করতে পারে কোন্ স্ট্রেইনটি উদ্বেগজনক ও কোনটি নয়।
৩৬ জন রোগীর জেনেটিক সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চার্লস চিইউ বলেন, কে আক্রান্ত হয়েছে এটা জানতে যদি অনেক বেশি টেস্টিং উপলব্ধ হয় তবে প্রধান চলমান স্ট্রেইন চিহ্নিত করা সম্ভব হবে এবং কীভাবে তা ছড়ায় তা নির্ণয় করা যাবে। পাশাপাশি এসব তথ্য ব্যবহার করে কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা এবং সংক্রমণসংক্রান্ত অভ্যাসগুলোও অনুশীলন করা যাবে। তিনি বলেন, এ সুযোগ আমাদের ছিল যে যদি আমরা অনেক বেশি টেস্ট ও কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হতাম তবে সম্ভবত আমরা ভাইরাসকে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসা থেকে আটকাতে পারতাম।
একই রকম সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে শিকাগোতে, যেখানে ৮৮টি ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্সিং থেকে প্রকাশিত হয় যে প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল তিনটি প্রধান স্ট্রেইন থেকে। যার একটি নিউইয়র্কে চলমান স্ট্রেইনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। একটি ওয়াশিংটনের কেসগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট এবং তৃতীয়টি শিকাগোর বাইরে ছড়ায়নি। এটা যা বলছে তা হলো কঠোরভাবে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা গেলে তা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়া রুখতে পারত।
চলমান জেনেটিক সিকোয়েন্সিং কর্তৃপক্ষকে ভাইরাসের বিস্তৃতি কমাতে কৌশল প্রয়োগ করতে সাহায্য করতে পারে। দু-মাসের লকডাউনের পর জুনে বেইজিং পুনরায় চালু হওয়ার অল্প সময়েই পুনরায় সংক্রমণ শুরু হয়। নতুন কেসগুলোর সিকোয়েন্সিং বলছে, এই ভাইরাসগুলো ইউরোপের রোগীদের মাঝে পাওয়া ভাইরাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে এগুলো মূল প্রাদুর্ভাব থেকে দীর্ঘায়িত নয়। যা চীনা সরকারকে সাহায্য করেছে শহরজুড়ে সবাইকে কোয়ারেন্টিন না করে সীমিত পর্যায়ে লকডাউন আরোপ করতে এবং ফুড মার্কেটের নির্দিষ্ট ব্লকের অ্যাপার্টমেন্টের লোকদের টেস্ট করাতে।
এছাড়া অন্যান্য কম সুস্পষ্ট উপায় আছে যেমন সার্স-কোভ-২-এর জেনেটিক বিশ্লেষণ, যা সাহায্য করে লকডাউন থেকে বের হওয়া মানুষের সংক্রমণ বৃদ্ধি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে। ইতালিয়ান বিজ্ঞানীরা উত্তরের শহরগুলোর জলের বর্জ্যের নমুনা পরীক্ষা করেছেন, যেখানে মহামারী শুরু হয় এবং সেখানে তারা সার্স-কোভ-২ প্রথম শনাক্ত হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পান। কাবারা ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পারাইক কেনি বসন্তে নিজের শহর লা ক্রোসেতে একই কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর জুনের মাঝামাঝিতে যখন লা ক্রোসে শহরের বার খুলে দেয়ার কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, তখন কেনি সংক্রমিত মানুষের ভাইরাল জিনোমের সঙ্গে জল বর্জ্যের নমুনা মিলিয়ে দেখেন। সেগুলোর মাঝে জেনেটিক মিল ছিল। মূলত সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার আগেই সার্স-কোভ-২-এর একই স্ট্রেইন কমিউনিটিতে অবস্থান করছিল।
একশ বছর আগেও একটি সংক্রামক রোগ (স্প্যানিশ ফ্লু) বিশ্বব্যাপী মানুষকে লুকোতে বাধ্য করেছিল যেমনটা এবার কভিড-১৯ করেছে। বর্তমানে এ ভাইরাসকে রুখতে যেসব প্রাথমিক উপায় অবলম্বন করা হয়েছে সেগুলোও একশ বছর পুরনো। কোয়ারেন্টিন, হাইজিন ও সামাজিক দূরত্বের বিধিগুলো তখনো দেখা গিয়েছিল। আমরা হয়তো কখনো নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না কোথা থেকে সার্স-কোভ-২ এসেছে এবং এটিকে বিশ্ব ট্র্যাজেডিতে পরিণত হওয়া থেকে আটকাতেও আমরা স্পষ্টভাবে দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু বিজ্ঞানের অনন্যসাধারণ অগ্রগতি আমাদের লড়াইয়ের জন্য নতুন সরঞ্জাম দিয়েছে, যেমন জেনেটিক সিকোয়েন্সিং। এর মাধ্যমে ভাইরাসকে আরো ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে, যা কেউ এক-দুই দশক আগে কল্পনাও করতে পারেনি। এটি এরই মধ্যে আমাদের সূত্র প্রদান করেছে কীভাবে সার্স-কোভ-২-এর মতো উদীয়মান ভাইরাস কাজ করে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
হচ্ছে কীভাবে কার্যকর ওষুধ ও ভ্যাকসিন দিয়ে একে প্রতিরোধ করা যায়।
এই জ্ঞান লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত বিজ্ঞান রাজনীতির ওপর নেতৃত্ব দেয়। সুযোগ ও গতিতে এই মহামারী যতটা নজিরবিহীন বলে মনে হচ্ছে, ততটা হওয়া উচিত হয়নি। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা মানবতার জন্য আসন্ন জুনোটিক ভাইরাসের হুমকি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে আসছিলেন। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী হোলমাস বলেন, মানুষ বারবার নজিরবিহীন শব্দটি ব্যবহার করছে। আমি বলতে চাই, বায়োলজিক্যালি এ ভাইরাস সম্পর্কে নজিরবিহীন বলে কিছু নেই। এটা সেভাবেই আচরণ করছে যেভাবে শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসগুলো আচরণ করছে। ঠিক এভাবেই ভাইরাস কাজ করে থাকে, সব সময় করেছে এবং এভাবেই করবে। যত দ্রুত আমরা এটা মেনে নেব, তত দ্রুত আমরা প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার জ্ঞানের আলোকে কাজ করতে পারব।
(টাইম ম্যাগাজিন)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.