Header Ads

বঙ্গ বিজেপিতে মতানৈক্য

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 
 
একুশের আগে মুকুলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মারাত্মক বুমোরাং হতে পরে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের রূপরেখা তৈরি করতে দিল্লিতে ছ-দিনের বৈঠক বসেছে বিজেপি। বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্তরের সেই বৈঠক ছেড়ে মুকুল রায়ের কলকাতা ফেরা নিয়ে জলঘোলা হয়েছে। অভিযোগ তীব্র মতানৈক্যের জেরেই মুকুল বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এবার তা নিয়ে মুখ খুলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। 
 
দিলীপ ঘোষ বলেন, যাঁরা কেন্দ্রীয় নেতা তাঁদের আলাদা করে নির্দেশ পাঠানো হয়। আমাকেও আসতে বলা হয়েছিল। কোন কোন জেলা আসবে তাও বলা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই সমস্ত আয়োজন করেছে। সিডিউলড নিয়ে সবাই সবকিছু জানে। আমার জানার কিছু নেই আর বলারও কিছু নেই। আমাকে আসতে বলা হয়েছিল, আমি দিল্লিতে বডি ফেলে দিয়েছি।
তাঁর কলকাতায় ফেরা নিয়ে শুক্রবার কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে মুকুল রায় বলেন, পাঁচ-ছ'দিন ধরে বৈঠক হবে আমি জানতাম না। কলকাতায় আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তাই ফিরতে হয়েছে। আমার রেটিনায় সমস্যা রয়েছে, একটা ইঞ্জেকশন নিতে হবে। সেই ডেট ঠিক করা ছিল আগে থেকেই। তাই আমাকে ফিরতে হল। এর মধ্যে কোনও জল্পনার অবকাশ নেই।
মুকুল রায় আরও বলেন, আর ন-মাস পরে নির্বাচন। তাই এর বাইরে কিছু ভাবার কোনও অবকাশ নেই। দল যে দায়িত্ব দেবে তা পালন করব। আমার বিশ্বাস এবার বাংলায় ক্ষমতা দখল করবে বিজেপি। এখন সেই কাজকে সাফল্যে রূপ দিতে হবে। বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে সেই কাজে ঝাঁপাবে।
২০২১-এর রূপরেখা তৈরি করতে বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বকে দিল্লিতে তলব করেছিলেন অমিত শাহ। বুধবার থেকে বৈঠক শুরু হয়েছিল। মুকুল রায় দিল্লি পৌঁছে গিয়েছিলেন একদিন আগেই। দিলীপ ঘোষ, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়রা গিয়েছিলেন বুধবার। কিন্তু মুকুল রায় বুধবার কৈলাস বিজয়বর্গীয়র বাড়িতে বৈঠকের পরই দিল্লি ছাড়ার তোড়জোড় শুরু করেন। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে যোগ দেননি মুকুল। এখন মুকুলের কলকাতায় ফেরা নিয়েও দুই নেতার কথায় ফারাক রয়েছে।
এদিকে কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বলেন, মুকুল রায় শীঘ্রই ‘সুখবর’ পাবেন! বিজেপিতে ১৮ মাসে বছর হয়,
বিজেপিতে প্রায় তিন বছর হতে চলল মুকুল রায়ের এখনও একটা পদ মেলেনি। এতদিনে তিনি শুধু কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। তাঁর কর্মভূমি যখন বাংলা, সেখানে তিনি দিলীপ ঘোষের অধীন। সেটাই মুকুল রায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর গুরুত্ব বাড়ানো হোক এমন আর্জি তিনি প্রকারান্তের বহুবার জানিয়েছেন। কিন্তু আজও সেই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি।
মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ার পর বহুবার তাঁকে মন্ত্রী করা নিয়ে কিংবা কেন্দ্রীয় কোনও পদ দেওয়া নিয়ে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু শেষমে কিছুই জোটেনি। সম্প্রতি তাঁকে রাজ্যসভার সংসদ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পদে আনা হবে বলে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তাও ভেস্তে গিয়েছে। এই অবস্থায় মোদী-শাহ ঘনিষ্ঠ এক সংসদ জানিয়েছেন মুকুল রায়কে নিয়ে ভাবছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
তাঁর কথায়, বিজেপিতে ১৮ মাসে বছর হয়। তাই মুকুল রায়ের পদ ঝুলে রয়েছে। তবে ২০২১-এর আগে বিজেপিতে তাঁর গুরুত্ব বাড়ানো হবে। মুকুল রায় খানিকটা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। তাই এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তবে মুকুল রায়কে যে বিজেপিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, তা নয়। মুকুল রায়কে নিয়ে খুব তাড়াতাড়িই সুখবর চলে আসবে, তিনি তা হলফ করে বলতে পারেন।
এদিকে মুকুল রায় বিগত কয়েকমাস ধরে নিস্ক্রিয় হয়ে আছেন রাজ্য রাজনীতিতে। তাঁর আক্রমণে আগের ঝাঁঝ দেখা যাচ্ছে না তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিজেপির কর্মসূচিতেও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। অমিত শাহের ভার্চুয়াল সমাবেশ ছাড়া নিয়মিত যে বৈঠক গুলি হচ্ছে একটিতেও তিনি সক্রিয় হননি। এই অবস্থায় দিল্লির বৈঠক ত্যাগ করে মুকুলের কলকাতায় ফিরে আসা নিয়ে এখন জোর জল্পনা চলছে।
মুকুলের এহেন পদক্ষেপে বঙ্গ বিজেপিতে ২০২১ নির্বাচনের আগে ফাটল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কেননা মুকুল রায় ও দিলীপ ঘোষ পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন। মুকুল রায় বলছেন তিনি জানতেন না চার-পাঁচদিন ধরে বৈঠক চলবে। দিলীপ ঘোষ প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রত্যেকেই জানেন এই বৈঠকের নির্ঘণ্ট। মুকুলদা জানবেন না, তা হতে পারে না।
ফলস্বরূপ মুকুল রায় কলকাতায় ফিরে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা অনেকের মতেই যুক্তিসঙ্গত নয়। বিতর্ক এড়াতেই তিনি ওইসব যুক্তি খাড়া করছেন বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশের অভিমত। না হলে মুকুল রায়ের মতো রাজনীতি অন্তপ্রাণ নেতা একুশের নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আগে শুধু চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য ফিরে আসবেন একদিন পরেই, তা মানা যায় না।
মুকুল রায় যে ব্যাখ্যাই দিন দিলীপের জবাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দিলীপ তো স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, অন্য কারও ব্যাপারে আমার পক্ষে বলা ঠিক হবে না। তবে আমাকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানিয়েছে চার-পাঁচ দিনের জন্য চলে আসুন, আমি সঙ্গে সঙ্গে বডি ফেলে দিয়েছি দিল্লিতে। যদিও তিনি মুকুল রায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা মানতে নারাজ
মুকুল রায় ঘনিষ্ঠ মহলে অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। দিল্লির শীর্ষ নেতাদের কাছে বিষয়টি জানানো সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আসলে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে তাঁর কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। রাজ্যে যাঁদের সঙ্গে বিজেপির লড়াই, সেই দলে তিনি সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ছিলেন। সেখানে স্বাধীনতা ছিল তাঁর। বিজেপিতে সেটাই বিরল।
এই অবস্থায় বিজেপি চাইছে মুকুল রায়ের গুরুত্ব বাড়াতে। কিন্তু সেখানেও অযথা বিলম্ব বাংলায় বিজেপিতে ফাটল তৈরি করেছে। আগে যেমন দুটো গোষ্ঠীর মধ্যে ভেদাভেদ ছিল। এখনও তেমনই রয়ে গিয়েছে। আগে ছিল দিলীপ গোষ্ঠী বনাম রাহুল গোষ্ঠী। এখন সেখানে রাহুল গোষ্ঠীর জায়গায় এসেছে মুকুল গোষ্ঠী। অর্থাৎ দিলীপ বনাম মুকুলের দ্বন্দ্বেই বিজেপিতে আড়াআড়ি ফাটল তৈরি হতে চলেছে ২০২১-এর আগে। তা মেটাতে বিজেপি তৎপর হবে শীঘ্রই।
অন্যদিকে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গেছে--দিলীপ একুশের ‘মুখ’ হলে মুকুল রায়ের অনুগামীরা কি সক্রিয় হবেন বিজেপিতে! এই প্রশ্নে বাড়ছে জল্পনা।
মুকুল রায়ের সঙ্গে বিজেপির দূরত্ব এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মুকুল রায়ের যুক্তি আর ধোপে টিকছে না বিজেপিতে। ২০২১-এ তাই মুকুল রায়কে সাইডলাইনে রেখে দিলীপ ঘোষের উপরই পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার কথা নিয়ে আলোচনা চলছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, মুকুল রায় সরে গেলে তাঁর অনুগামীরা বিজেপিতে কী করবেন।
মুকুল অনুগামীদের সঙ্গে দিলীপের সখ্যতা কতটা হয় তার উপর কিন্তু নির্ভর করবে অনেক কিছুই। মুকুল রায়ের কোনও পদ না মিললেও মুকুল অনুগামীরা প্রায় প্রত্যেকেই বিজেপিতে পদ পেয়েছেন। সব্যসাচী থেকে শুরু করে অর্জুন সিং, সৌমিত্র খান থেকে শুরু করে ভারতী ঘোষ--তাঁরা কী করবেন মুকুল রায় সাইডলাইন হলে!
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, মুকুলের অনুগামীদের নিয়েও বিজেপি ভেবেছে। মুকুলকে পদ না দিয়ে মুকুলের অনুগামীদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মুকুল রায় সাইডলাইন হলে তাঁর অনুগামীরা দু-বার ভাববেন দলে তাঁদের গুরুত্ব নিয়ে। কেননা বিজেপিতে গুরুত্ব হারালে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
আবার উল্টোও হতে পারে। মুকুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরা যদি দলে গাছাড়া মনোভাব দেন, ২০২১-এর আগে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন, তবে তা বিজেপির পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে না। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন তাঁদের কাছে একটা সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা তাঁরা হারাতে চাইবে না।
এমতাবস্থায় মুকুল অনুগামীদের নিয়ে পথ চলতে হবে দিলীপ ঘোষকে। সেখানে পদে পদে ঠক্কর খেতে হতে পারে। আবার তার উপর মুকুল সাইডলাইন হলে তৃণমূল ভেঙে অন্য নেতারা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে দু-বার ভাববে। তারও একটা বড় প্রভাব পড়বে বিজেপির উপর। তখন দিলীপ ঘোষের উপর চাপ পড়ে যাবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ।
মুকুলকে সাইডলাইন করে দেওয়ার রাজনীতি বিজেপির সংকট বাড়াবে বলেই অনুমান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। বিজেপি যদি মনে করে থাকে মুকুল রায়কে দিয়ে তৃণমূলকে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি কাজ দিলীপ ঘোষ এবং অন্যন্যরা করে দিতে পারবেন। তবে সেটা আদৌ সুখকর হবে না বিজেপির কাছে। মুকুলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মারাত্মক বুমোরাং হতে পরে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.