Header Ads

প্রসঙ্গ : একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র সরকার গঠনের সম্ভাবনা কতটা !! (২)

 বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে বেশি কথা বলতে হবে মুকুল রায়-কে নিয়েই। কারণ, মুকুল রায় যে তৃণমূলের পতন ও যতটা উত্থান হয়েছে বিজেপি’র তার কত বড় কারণ সেটা না বুঝেছে তৃণমূল (একজন ছাড়া) না বিন্দুমাত্র বুঝেছে বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেসের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ চারটি নির্বাচন (লোকসভা ২০০৯/২০১৪ এবং বিধানসভা ২০১১/২০১৬) দলটিকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে তুলে এনেছিল সেই চারটি নির্বাচনেই বিস্ময়কর সাফল্যের মূল কারিগর ছিলেন মুকুল রায় দলের নির্বাচনী ম্যানেজার হিসেবে।

তাঁর এই বিপুল সাংগঠনিক দক্ষতা ও নির্বাচনীবোধ এবং বিশেষ করে তাঁর সাফল্যের কারণে তাঁর দিনে দিনে গ্রহণযোগ্যতাবৃদ্ধি দলের কোনো কোনো অংশে এতটাই চাপ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে ফেলেছিল যে শেষপর্যন্ত কাউকে কাউকে ভাসিয়ে তোলার প্রয়োজনে মুকুলকে ডুবিয়ে দেওয়ার রাজনীতি করতেই হল। হাস্যকর সব ছেঁদো কারণে এলিতেলিরাও বিশেষ বিশেষ প্ররোচনায় তাঁকে অপমান হেনস্থা কোণঠাসা করে রাখার রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করে নি, মাইনাস মুকুল এই দলটার পরিস্থিতি কী হতে পারে ! বাধ্য হয়ে দল বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়ে মুকুল যেভাবে শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণাকাতর শব্দ শুনেছিলেন তেমনটা কেউ শুনতে পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তবে একজন যে মুকুলহীন তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন সেটা প্রতি মুহূর্তে প্রতিফলিত হয়েছে ২০১৯-এর লোকসভা  নির্বাচনের প্রাক্-মুহূর্তে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অস্থিরতার মধ্যে--ভাষণ-বিবৃতির মধ্যে--নির্বাচনে দলকে জেতানোর পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার প্রচণ্ড অবসাদ ও অসহায় শারীরিক ভাষার মধ্যে। মুকুলের মতো দ্বিতীয় আর একজনও কেউ তাঁর পাশে ছিল না যার ওপর দলের পুরো দায়িত্ব সঁপে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে সর্বভারতীয় রাজনীতিকে নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে আনতে পারেন। তেমন কেউ ছিল না বলেই গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ থেকে একজনকেও সংসদে পাঠানো গেল না--রাজ্যের ১৮-টি তৃণমূল প্রভাবিত আসনও হাতছাড়া হয়ে গেল। এ ধাক্কা তিনি সামলাতে যে পারেন নি তা বোঝা গেল অবিশ্বাস্যভাবে দলকে টেনে তুলতে বিহারী মগজ কিনে আনার মধ্য দিয়ে। তিনি নিজেই নিজের ওপর আর আস্থা রাখতে পারলেন না--এটার যে কী মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া  তৈরি হতে পারে তা যেমন দলের ভেতরেরই বিপজ্জনক রকমের উচ্চাকাঙ্খী কিছু বালক-বালিকা বোঝেনি তেমন করে তিনিও বুঝতে পারেন নি বলেই আমার বিশ্বাস। শেকড় ছেঁড়ার শব্দের যন্ত্রণা নিয়ে যাকে দল ছাড়তে হল তিনি চুপচাপ বসে থাকবেন বলে যারা মনে করেছিলেন এবং ‘ফূঃ’ বলে মুকুল রায়কে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের শিক্ষা এখনও সম্পূর্ণ হয় নি--আরও কিছু শিক্ষা তাঁদের জন্যে আগামীতে অপেক্ষা করছে। বালকোচিত অলীক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বালকোচতি রাজনৈতিক মেধার সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করলে যে সব বিপদ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে এবং যেগুলো সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে এখন ঠিক সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁকে মুকুলের অভাব ভীষণভাবে পীড়িত যে করবেই তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। দলের ভেতরের এই করুণ অবস্থাটা আর কোনো ভাবেই জনগণের  চোখের আড়ালে রাখা যাচ্ছে না এবং সেটা আরও বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন ভাড়া করে আনা মগজ ‘‘পিকে”!
তৃণমূল যা করার তা তো করেইছে--বিজেপি কি করলো মুকুলকে নিয়ে? এটা কিন্তু খুব বড় মাপের মারাত্মক একটা
প্রশ্ন ! তৃণমূলের অপমান হেনস্থা’র উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য কংগ্রেস নয়--মুকুল বেছে নিয়েছিলেন ভবিষ্যতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হিসেবে দ্রুত উঠে আসা বিজেপিকেই। বিজেপি’র বঙ্গ নেতাদের কেউ নন, কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাবশলীদের কেউ কেউ মুকুলকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই মুকুল তাঁর কমবেশি তিন বছরের বিজেপি জীবনে যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন তার চেয়ে ঢের বেশি সাফল্য দিয়েছেন বিজেপিকে, বিশেষ করে এই বাংলায়। তৃণমূলের দুর্গ  তছনছ করে এক-আধটা নয় একেবারে ১৮-টি আসন ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে এখানেও তাঁকে কেন্দ্র করে বঙ্গবিজেপি’র আরএসএস নিয়ন্ত্রিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতারা অসুস্থ রাজনীতিতে নেমে পড়লেন। কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয়’র সঙ্গে মুকুলের বোঝাপড়ার ব্যাপারটায় তাঁরা প্রমাদ গুণতে থাকলেন। কৈলাশকে রাজ্য রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার উদ্দেশ্যেই আর এক আরএসএস প্রবক্তা তথা কেন্দ্রীয় নেতাকে বাংলায় পাঠানো হল এই উদ্দেশ্য নিয়েই যাতে মুকুল বঙ্গ বিজেপি’র শীর্ষে উঠে যেতে না পারেন। বিজেপি’র এই চরম হাস্যকর নির্বুদ্ধিতার মূল্য দিতে হবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনেই। মুকুলকে গুরুত্ব দিলে সম্মান দিলে তিনি কি করতে পারেন তা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বুঝিয়ে দিয়েছেন--যোগ্য মর্যাদা না দিলে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা না দিলে দলের  প্রাপ্তির অঙ্কে কতটা ঘাটতি  তৈরি হতে পারে তাও তিনি বুঝিয়ে দিতে পারেন।
বাংলায় তৃণমূল ছাড়ার পর থেকে প্রায় প্রতি মাসে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হচ্ছে--জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ডেকে পাঠানো হচ্ছে--রাস্তায় বেরুলেই তাঁকে অবরোধের মুখে গালিগালাজের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা এসব দেখেও বুঝতে পারছেন না--মুকুল এখনও তৃণমূলের কাছে কতটা দুশ্চিন্তার কারণ। বুঝতে পারলে তাঁরা মুকুলকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য তাঁকে এমন একটা সর্বভারতীয় পদ (রাজ্যসভার সদস্য/স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) দিতে দেরি করত না যার দৌলতে মুকুল গোটা রাজ্যে চষে বেড়াতে পারতেন। এমন কোনো ক্ষমতা তিনি পেলে তৃণমূল শিবিরে যে ত্রাহি মধুসূদন রব উঠে যেত--এটুকু বুঝে ওঠার ক্ষমতা ধরেন এমন কাউকে বিজেপিতে দেখা গেল না--এমন ভাবনা ভাবলেন না অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীও ! তবু নাকি তাঁরা বাংলাকে পাখির চোখ করে এগোতে চাইছেন পরিবর্তনের পরিবর্তন ঘটাবেন বলে ! আসলে তারা কেউই বাংলার প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কেই প্রয়োজনীয় মাত্রায় ওয়াকিবহাল নন। তাঁরা বিশ্বাসই করতে চান না যে, গোবলয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ রাজ্যে শুধু অচলই নয়--একেবারেই গ্রহণযোগ্যও নয়। বাংলার রাজনীতি তার সংস্কুতিক চেতনাকে মাথায় রেখেই চলবে। এ রাজ্যে মুকুল রায় সব্যসাচী দত্ত অর্জুন সিং খগেন মুর্মু  জন বার্লা সৌমিত্র সাধুখাঁ লকেট চট্টোপাধ্যায় বাবুল সুপ্রিয়, শান্তনু ঠাকুরদের যে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে তা আরএসএসের আশীর্বাদপুষ্ট নেতাদের ক্ষেত্রে হবে না। স্বাধীনতার পর থেকে এই সহজ সত্যটা আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়ে আসছে। জোরদার প্রমাণ পেতে চাইলে অমিত শাহ’রা এইসব নেতাদের দল থেকে বের করে দিয়ে শুধুমাত্র আরএসএস মনোনীত নেতাদের হাতেই ফের বঙ্গ বিজেপিকে ছেড়ে দিয়ে বাংলার মসনদে বসে দেখান--এ রাজ্যেও গো-বলয়ের রাজনীতি ঠিকঠাক ক্লিক করে যেতে পারে ! না, তেমনটা কিছুতেই হবার নয় এ রাজ্যে। বাংলার মসনদে বসতে হলে মুকুলকে যোগ্য সম্মান দিতে হবে। তাঁকে এমন পদ অবিলম্বে দিতে হবে যাতে তিনি গোটা রাজ্যে চরকির মতো ঘুরতে পারেন। তাহলেই কিছু হলেও হতে পারে--না হলে বাংলা জয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে !
আমি জানি, এ পর্যন্ত পড়েই আমাকে অনেকেই মুকুলের এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। করাই স্বাভাবিক। তবে আমি জানি এই মনে করাটাও খুব বেশি হলেও বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। তখন মুখে আঙুল চুষতে চুষতে তাদেরই বলতে হবে--নাঃ ! লোকটা সেদিন তেমন মিথ্যে কিছু বলে নি !!
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.