Header Ads

ক্ৰমশ জটিল হচ্ছে অসমের বন্যা পরিস্থিতি, বন্যায় মৃত ২০

 রিংকি মজুমদার, ২৯ জুনঃ 
অতিমারি করোনা, বন্যা, বাঘজানে তেলকূপের আগুন বেশ কয়েকটি প্ৰাকৃতিক দুৰ্যোগের সঙ্গে একসঙ্গে লড়াই করছে অসমবাসী। এরইমধ্যে রাজ্যে বন্যায় প্ৰাণ গেছে ২০ জনের। রাজ্যের হৃদয় স্বরূপ ব্ৰহ্মপুত্ৰের জলস্তর বেশ কয়েকটি জেলায় বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্ৰবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে উজান ও নিম্ন অসমের ৩০টিরও বেশি জেলা। বন্যায় চরম দুৰ্ভোগ পোহাচ্ছে ধেমাজি, লখিমপুর, গোলাঘাট, বিশ্বনাথ.  ওদালগুড়ি, দরং, নলবাড়ি, কোকরাঝাড়, বরপেটা, বঙাইগাঁও, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কামরূপ জেলার লোকজন। ৯.৫ লক্ষ মানুষ বন্যার কবলে। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ১৪৪টি আশ্ৰয় শিবির খুলে দেওয়া হয়েছে। ২৮ হাজারেরও বেশি বন্যা দুৰ্গতদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে জাতীয় অভয়ারণ্য কাজিরঙার ৫০ শতাংশই জলের নিচে। গণ্ডার, হাতি থেকে শুরু করে হরিণ, বাঘ, বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি বন্যার জলে ভাসছে। বন্যার জেরে পশুগুলো জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে জাতীয় সড়কে উঠে আসছে। ফলে গত কয়েকদিনে যানবাহনে চাপা পড়ে বেশ কয়েকটি পশুর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে পবিতরায় বন্যায় একটি গণ্ডারের মৃত্যু হয়েছে। ব্ৰহ্মপুত্ৰের জলস্তর বাড়ায় পবিতরার ৯০ শতাংশই বৰ্তমানে জলের নিচে। পাগলাডুবা, নলতলী, হাঁ‌হচরা, কুক্কারি, ধলী, বকুলজান সমেত বেশ কয়েকটি বন শিবির জলে ডুবেছে। বন্যার ভয়াবহতার কারণে অভয়ারণ্যের নলতলি বনশিবির অন্যত্ৰ স্থানান্তর করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্ৰ মন্ত্ৰী অমিত শাহ রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি জানতে মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সনোয়াল এবং স্বাস্থ্যমন্ত্ৰী হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মার সঙ্গে কথা বলেছেন।    
 ছবি, সৌঃ ইন্টারনেট

এদিকে অতিবৃষ্টিতে ব্ৰহ্মপুত্ৰের জলস্তর বৃদ্ধি হওয়ায় ক্ৰমশ জটিল হচ্ছে অসমের গোলাঘাট জেলার বোকাখাত মহকুমার বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার জলে ৩২ টি গ্ৰামের ২৮০ হেক্টর কৃষিজমি প্লাবিত। প্ৰাপ্ত তথ্যসূত্ৰের খবর বোকাখাতের কাজিরঙা মৌজার ১১ টি গ্ৰাম, বোকাখাত মৌজার ৯ টি গ্ৰাম, মহুরা মৌজার ১১ টি গ্ৰাম বৰ্তমানে বন্যার জলে প্লাবিত। চাষের জমিগুলিতে বন্যার জল ঢুকে প্ৰচুর শাকসব্জি পঁচে গিয়ে নষ্ট হয়েছে। আধা পাকা বড়ো, শালি ধান, আখ, পাটের চাষ হয়েছিল জলে সেগুলিও নষ্ট হয়েছে। এবারের বন্যায় মহকুমাটির ৭৫০০ জন লোক ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়েছে। সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি গৃহপালিত পশুর ক্ষতি হয়েছে। বন্যা দুৰ্গতদের মধ্যে প্ৰশাসনের তরফ থেকে চাল, ডাল, নুন, সৰ্ষের তেল প্ৰয়োজনীয় খাদ্য সামগ্ৰী বিতরণ করা হলেও এখনও পৰ্যন্ত আশ্ৰয় শিবির তৈরি করে দেওয়া হয়নি। গত চারদিন ধরে যোগনিয়াআটির বাঁধের ওপর বন্যা দুৰ্গত বেশ কয়েকটি পরিবারের লোকজন খোলা আকাশের নিচে চরম দুৰ্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কোনও ধরনের সরকারি ত্ৰাণ এখনও অবধি সেখানে গিয়ে পৌঁছয়নি বলে জানা গেছে। মহকুমাটির বিভিন্ন জায়গায় কালভাৰ্ট, অস্থায়ী সেঁতু বন্যার জলে ভেসে গেছে বলে খবর মিলেছে।

চলতি বছরের দ্বিতীয় বৰ্ষায় উজান অসমের ধেমাজি এবং কামপুর অঞ্চল যথেষ্ট ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়েছে। জেলার ২১৫ টি গ্ৰামে ৯০ হাজারেরও বেশি লোক বন্যার কবলে পড়েছেন। বিজয়পুর এলাকায় বন্যায় মৃত্যু হয়েছে ১২ বছরের এক কিশোরীর। বন্যার পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার নিরাপদ জায়গায় আশ্ৰয় নিতে পরিবারের সঙ্গে নৌকা করে যাওয়ার সময় নৌকা থেকে হঠাৎই পড়ে যায় রশ্মি দেউরি নামের ওই কিশোরী। তারপর চারদিন পর কিশোরীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়।

 জিয়াঢল নদীর বাড়তি জলে ধেমাজির বহু গ্ৰাম জলে ডুবেছে। সিয়াংয়ের জলে ধেমাজি জেলার মহকুমা জোনাইয়ের দক্ষিণ অংশ যথেষ্ট ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়েছে। এরই মধ্যে রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্ৰী কেশব মহন্ত, বিরোধী দলপতি দেবব্ৰত শইকিয়া, ধেমাজি জেলার স্থানীয় বিধায়ক রনজ পেগু, জোনাইয়ের বিধায়ক ভূবন পেগু বন্যাদুৰ্গত অঞ্চলে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন। এদিকে কামপুরেও অতিবৃষ্টি এবং কাৰ্বি লাংপি জলবিদ্যুৎ প্ৰকল্পের ৭ টি গেটের জল ছেড়ে দেওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে বরপানী নদী । বন্যার জলে ডুবেছে বেশ কয়েকটি রাজস্ব গ্ৰাম। মাসখানেক আগেও নদীর জলস্তর বেড়ে বাঁধ ভেঙে বন্যার জল হু হু করে ঢুকে পড়ে কামপুর রাজস্ব চক্ৰের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলে লংজাপ, জুড়িপার, মাধবপাড়া, কচুয়া সমেত বেশ কয়েকটি গ্ৰাম জলে ডুবে যায়।

এদিকে বন্যায় কপিলি নদীও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। কপিলির ওপর বাঁধ সময়মতো সংস্কার করা হয়নি। ফলে নদীর বৰ্ধিত জল ভাঙা বাঁধের ওপর দিয়ে বন্যার জল ঢুকে পড়েছে। পরিণতিতে বকুলগুড়ি, নালাপাড়, পটিয়াপাম সমেত বিভিন্ন অঞ্চল জলে ডুবে যায়। কামপুর–যমুনামুখ সংযোগী পথের ওপরেও বন্যার জল ঢুকে পড়েছে। ভাঙা বাঁধগুলি সংস্কার না করার ফলে বিভিন্ন কৃষিজমি প্লাবিত হয়েছে। নতুন নতুন অঞ্চল জলে ডুবেছে। অঞ্চলের কৃষকদের চাষ করে দু পয়সা রোজগারের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এখনও পৰ্যন্ত বন্যা দুৰ্গতদের জন্য সরকারের কোনও প্ৰতিনিধি কোনও ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।  


লাগাতার বৃষ্টিতে অসমে ব্ৰহ্মপুত্ৰের জলস্তর বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্ৰবাহিত হচ্ছে। বন্যার জলে দক্ষিণ শালমারা জেলার বিস্তৃত অঞ্চল যথেষ্ট ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়েছে। নদের জলস্তর ৪৩ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে মানকাচার জেলার ২ শতাধিক গ্ৰাম জলে প্লাবিত হয়েছে। বন্যার জলে নষ্ট হয়েছে বিস্তর কৃষিজমি, পাট, জলে পঁচে নষ্ট হয়েছে শাকসব্জি। বন্যায় সব কিছু হারিয়ে চরম দুৰ্ভোগের মধ্যে দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ। বন্যা দুৰ্গতদের গরু ছাগল গৃহপালিত পশুর সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে একসঙ্গ দিন রাত কাটাতে হচ্ছে। প্ৰশাসনের তরফ থেকে এখনও পৰ্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে এলাকার কিছু কিছু লোক যে যার নিজের সাধ্যমতো ছোট নৌকা, ভুটভুটিতে করে প্ৰয়োজনীয় যৎ সামান্য জিনিষ পত্ৰ নিয়ে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে আশ্ৰয় নিচ্ছে। 

নিরন্তর বৃষ্টি, মহাবাহু নদের বাড়তি জলে দক্ষিণ শালমারা মানকাচর জেলার বিশেষ করে মালির আলগা, পাটাকাটা, হাজিরহাট, মলাখোয়া, সুখচর, বরের আলগা, গোটাবাড়ি, খোপাতিয়া সমেত বিভিন্ন গ্ৰাম জলে থৈ থৈ। 

এদিকে ধুবড়ি জেলার অধীনে দক্ষিণ শালমারা কেন্দ্ৰের ফকিরগঞ্জ, চালাকুরা, বিরসিং, আইরকাটা, জামাদারহাট, জরুয়া-বন্দিহানা অঞ্চলের শতাধিক গ্ৰাম ব্ৰহ্মপুত্ৰের বাড়তি জলে প্লাবিত। এলাকার প্ৰায় দুই লক্ষাধিক লোক বন্যায় ক্ষতিগ্ৰস্থ হয়েছে। গৃহপালিত পশুগুলিকে পৰ্যন্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিতে পারছে না। বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে বহু কষ্টে দুৰ্ভোগের মধ্যে দিন রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। একাংশ লোক পাৰ্শ্ববৰ্তী রাজ্য মেঘালয়ের দিকে রওনা হয়েছে, আবার একাংশ লোক জাতীয় সড়ক কিংবা বাঁধের ওপরে গিয়ে আশ্ৰয় নিয়েছে। 

এদিকে মানকাচরের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও বন্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া থাকা সীমান্তের রাস্তায় বেশ কয়েকটি জায়গায় বন্যার জল ঢুকে গেছে। ফলে ওই জায়গা গুলো দিয়ে বাংলাদেশের দিক থেকে ব্ৰহ্মপুত্ৰের বৰ্ধিত জল হু হু করে ঢুকতে শুরু করেছে। মানকাচর এলাকার আন্তৰ্জাতিক সীমান্তের বেশির ভাগ পোস্টই জলের নিচে ডুবে গেছে। ফলে অঞ্চলে তীব্ৰ আতঙ্কের পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

 এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারত-বাংলাদেশের অসমের আলগা অঞ্চলে বন্যায় নষ্ট হওয়া সীমান্ত পথ এবং কাঁটাতারের বেড়া সংস্কারের কাজ এখনও অবধি শেষ হয়নি। তার মধ্যেই এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কে দিন রাত কাটাচ্ছেন এলাকার লোকজন। কিছুদিন আগে জেলা প্ৰশাসনের তৎপরতায় সিপিডব্লিউয়ের তত্ত্বাবধানে ফুটো বন্ধ করা হলেও যে হারে জল বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যে কোনও মুহূৰ্তে কাঁটাতারের বেড়া ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.