" বাঙ্গালী বলে একটা জাতি ছিল এই পৃথিবীতে "
বিশ্বরূপ সেনগুপ্ত,
"আমরা বাঙ্গালী" "আমরা বাঙ্গালী " শ্লোগানটা ছোট বেলা থেকেই শুনে শুনে অভ্যস্ত। জানিনা কতদিন আর শুনতে বা বলতে পারবো,
কারণ,
সোশাল মিডিয়ায় এমন হাস্যকর ভাবে বাঙ্গালী জাতি কে বিশ্বের আঙিনায় প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে যে,
নিজেকে বাঙ্গালী বলতে,
বাঙ্গালী লজ্জাবোধ করছে,
বলতে দ্বিধা নেই যে এর জন্য কিন্তু বাঙ্গালীই দায়ী। আমি ছোটবেলা থেকেই বাঙ্গলার বাইরে থাকি কিন্তু বাঙ্গালীয়ানা টা একটুও ছাড়েনি, তাই বলে অযথা আমি বাঙ্গালী- আমি বাঙ্গালী বলে বুক বাজাবো সেই অভ্যাস টা আমার নেই। এমনিতেই বাঙ্গালী জাতির বেশি কথা বলার বদনাম আছে।
বাঙ্গালী জ্ঞান দিতে ভালোবাসে, নিতে নয়। বাঙ্গালী চুলচেরা বিশ্লষণ করতে ভালোবাসে, বাঙ্গালী তথ্য সহকারে তর্ক করতে ভালোবাসে,
প্রতিবাদ করতে ভালোবাসে,
সংস্কৃতি নিয়ে সরব হতে ভালোবাসে,
মার্জিত পরিধান পরতে ভালোবাসে,
বাঙ্গালী পরোপকার করতে ভালোবাসে,
বাঙ্গালী খুবই সহানুভূতিশীল। এই সব কথা গুলো ছোটবেলা থেকেই শুনতে অভ্যস্ত,
বাঙ্গলার বাইরে থেকেই দেখেছি বাঙ্গালীদের ঠাট্ বাঙ্গালীদের দম্ভ বাঙ্গালীদের কৃতিত্ব সেই জন্যই তো নিজেকে একজন বাঙ্গালী বলে গর্ববোধ করে এসেছি। বাঙ্গলায় প্রায়ই যাওয়া হয়,
আমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে যাঁরা প্রায় সকলেই জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই চাকরি সূত্রে বাঙ্গলার বাইরে কাটিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছেন অবসর জীবনটা কাটাতে, তাই আমিও ভাবতে শুরু করেছি আমার অবসরপ্রাপ্ত জীবন টা আপাদমস্তক বাঙ্গালী হয়ে মাতৃভূমিতে গিয়ে কাটাবো।
ছোটবেলায় যখন বাঙ্গলায় যেতাম,
ওখানে গিয়ে সকলকে বাঙ্গলা বলতে শুনতাম,
রিক্সাবালা,
দোকানদার,
আশেপাশের মানুষগুলোকে,
তখন এত আনন্দ লাগত,
মনে হত সবাই যেন আত্মীয়। ছোটবেলায় যখন ট্রেনে করে যেতাম, ট্রেন বাঙ্গলাতে ঢুকলেই বাঙ্গালী চা ওয়ালা, ঝালমুড়ি বালা প্লাটফর্মে দাঁড়ানো লোকজন সবাই বাঙ্গলায় কথা বলছে শুনে এত আনন্দ হত, সেই অনুভূতির কথা লিখে বোঝাতে পারব না। এতটাই বলতে পারি ট্রেন বাঙ্গলায় ঢুকলেই আমি আর ঘুমোতে পারতাম না, এর জন্য মায়ের কাছে অনেক বার বকুনিও খেতে হয়েছে কিন্তু কোনোদিন আমার ভেতরের অনুভূতি বলে উঠতে পারিনি ।
এখনও বাঙ্গলায় যায় প্রায়ই যাওয়া হয় কিন্তু সেই অনুভূতি টা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে ।
এখন বাঙ্গালীদের মধ্যে দেখি বাঙ্গলা বলার প্রবণতা কমে গেছে,
কথার মাঝে মাঝে হিন্দী ও ইংরেজি কথা ঢুকিয়ে নিজেকে আধুনিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা,
এখন বাঙ্গালী চুলচেরা বিশ্লেষণ করেনা চুলোচুলি করতে ভালোবাসে, তর্ক করে কিন্তু তথ্য সহকারে না, প্রতিবাদের নামে হুজুগে মেতে ওঠে, আভিজাত্য সংস্কৃতি প্রায় নাই বললেই চলে, যেটুকু আছে সেটা আঁতলেমিপুষ্ট। এতদিন বাঙ্গালী যে পোষাক দেখে নাক সিঁটকাতো এখন সেটাই প্রিয়, ভোজনরসিক বাঙ্গালীর ভোজন তালিকাতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে, বাঙ্গালী পরোপকার ছেড়ে কাঠি করাতে হাত পাকিয়েছে, বাঙ্গালী এখনও শ্রেষ্ঠ হতে চায় কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে নয় অন্যকে খাটো করে বদনাম করে, বাঙ্গালী এখন সহানুভূতিশীলতা হারিয়েছে মজা দেখতে ভালোবাসে।
এখনকার প্রজন্ম জানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
ক্ষুদিরাম বসু,
ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়,
বিদ্যাসাগর এঁনারা সবাই বাঙ্গালী,
ব্যাস এইটুকুই এঁনারা কি জন্য বিখ্যাত হয়েছেন নব্বই শতাংশ বাচ্চারা জানেনা কারন তাঁদের বিষয়ে চর্চা করে বাচ্চাদের উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা শেষ হয়ে গেছে ।এখন এই সব গুণীজন দের জন্মদিন পালন হয় হিন্দী সিনেমার গান বাজিয়ে বর্তমান রাজনীতিবিদদের বড় ছবির পায়ের কাছে একটা ছোট্ট ছবি রেখে দিয়ে,
যেমন বড় বড় ঠাকুরের পায়ের কাছে ঘট রাখা থাকে। ব্যাঙ্গ করলেই সন্ত্রাসবাদী তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে । বাঙ্গলার মিডিয়া গুলো ও শাসক দলের শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওড়ে যাচ্ছে অন্যথায় থানায় বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা। আর শাসক দলকে একটু তৈলমর্দন করে যদি একটা সরকারী পদ জুটিয়ে নেওয়া যায় মন্দ কি।
বাঙ্গালী চিরকাল পরনিন্দা পরচর্চা করতে ভালোবাসে,
বাঙ্গালীর দিন দিন জেলাস ভাবনা টা বেড়েই চলেছে,
যদি কোনো বাঙ্গালী নিজের প্রচেষ্টায় কোনো কৃতিত্ব অর্জন করে তাহলে সবাই উঠে পড়ে লাগবে তার কৃতিত্ব কে খাটো করে দেখানোর জন্য।গোপাল ভাঁড়ের একটা গল্প মনে পড়ে গেল, একবার এক গরিব লোক কিছু অর্থের বিনিময়ে শর্ত লাগিয়ে কনকনে শীতে পুকুরের জলে বুক অবধি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে সারারাত কাটানোর পর সকালে, সবাই তাকে জিজ্ঞেস করল এই কঠিনতর কাজ কি করে সম্ভব করলে তোমার ঠান্ডা লাগল না?
তখন সেই গরিব লোকটি পরিস্কার মনে জানিয়ে দিলো যে,
সে জলের তাপমাত্রায় ধ্যান দেয়নি তার ধ্যান ছিল দুর থেকে আসা লম্ফের আলোতে,
যেটা জলে পরে নড়াচড়া করছিল তাতে। ব্যাস,
সবাই বলতে আরম্ভ ঐ লম্ফর আলো পরে নিশ্চয় জল গরম হয়ে উঠেছিল তাই সে জলে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে।
আজকাল বাঙ্গলার বাঙ্গালীরা বাঙ্গালীর কৃতিত্বে হাততালি দিতে ভুলে গেছেন তাই আজ জাতীয় স্তরে বাঙ্গালীর কৃতিত্ব নগণ্য থেকে নগণ্যতর হয়ে উঠেছে। আজকাল বাঙ্গালীরা হাততালি দেয় চিৎকার করতে করতে হাততালি দেয় কিন্তু বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে। তাই আজকাল বাঙ্গলার বাইরে এবং ভেতরে বাঙ্গালী দের নিয়ে বিদ্রুপ করা হয় ব্যাঙ্গ করা হয় আর বাঙ্গালীদেরকে চুপ করে মুচকি হেসে সব শয্য করতে হয়,
কারণ এর মূলেও তো আমরা বাঙ্গালী।
বাঙ্গালী কি আবার পারবে জাতীয় স্তরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কৃতিত্ব অর্জন করতে, নিজেদের মধ্যে রেষারেষি ছেড়ে একতা ফিরিয়ে আনতে, পারবে কি বাঙ্গলার কূপমন্ডুক না হয়ে থেকে বিশ্বের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে, বাঙ্গালী কি পারবে অতীতের বীরপুরুষদের জয়গাথাকে বয়ে নিয়ে যেতে?
জানিনা, এর উত্তর আমার কাছে নেই, কিন্তু এটা জানি, যদি না পারে তাহলে খুব বেশীদিন নেই এটা শুনতে যে, " বাঙ্গালী বলে একটা জাতি ছিল এই পৃথিবীতে "।।
অসাধারন।অপূর্ব।
উত্তরমুছুন