Header Ads

প্রসঙ্গ : স্তাবকতা ও বিরোধিতা !!


বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

স্তাবকতা ও বিরোধিতা--চরিত্রগত দিক থেকে এই দুটি শব্দ পরস্পরবিরোধী হলেও এদের মধ্যে যে একটি মাত্র সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় সেটি হল দু-টিই যুক্তিবোধহীনতাকে আশ্রয় করেই দিনে দিনে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। যুক্তিবোধহীন বিরোধিতার মানসিকতা থেকেই কোনো এক পক্ষের নিঃশর্ত ক্রীতদাসত্বের প্রবণতা তৈরি হয় এবং সেটা প্রকট হয়ে ওঠে স্তাবকতার মধ্য দিয়ে। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে--স্তাবকতার উল্টোপিঠ-ই হল বিরোধিতা। নিম্নমেধার স্তাবকতাই হোক বা বিরোধিতা--দিনের শেষে এই স্তাবকতা বা বিরোধিতায় কারুর কোনো লাভ হয় না--ক্ষতি তো একেবারেই হয় না। স্তাবকতার জন্যে বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না--কিন্তু বিরোধিতার জন্যে বেশ কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন হয় বিরেধিতার ময়দানে দাঁড়াতে হলে। নিম্নমেধার স্তাবক বা বিরোধীদের নিয়ে ন্যূনতম বোধবুদ্ধি কাজ করে এমন মানুষের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। কিন্তু উচ্চমেধার স্তাবক এবং বিরোধীরা কিন্তু বেশ কিছু ভাবনা চিন্তার সূত্র তৈরি করে--মানুষ ভাবতে বাধ্য হয়--কোনো একপক্ষের পাশে দাঁড়াবার আগে সূত্র ধরে প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করে। নিম্নমেধার স্তাবকতা বা বিরোধিতা প্রয়োজনীয় শিক্ষদীক্ষা রুচি প্রবৃত্তির অভাবে ব্যক্তিআক্রমণে ও ব্যক্তিচরিত্রহননে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। কোনো দিক থেকে পেরে না উঠে এরা আঞ্চলিকতা সাম্প্রদায়িকতা বর্ণবাদ জাতিবাদের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করে না। কুৎসা এবং অপপ্রচারের সীমা অতিক্রম করে যেতেও এদের কোনোরকম সঙ্কোচ হয় না। অসংখ্য নজির চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে--আমি বিস্তারিত সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। এই ধরণের স্তাবকতা বা বিরোধিতার সংখ্যার নিচে চাপা পড়ে যায় যুক্তিবাদী নিরপেক্ষ কণ্ঠস্বর।
প্রসঙ্গতঃ এখানে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতেই হচ্ছে। একটা সময়ে আমি নিজে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম--কলেজ জীবনে ছাত্রপরিষদও করেছি। জীবনে যেসব রাজনৈতিক রথী-মহারথীদের সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম তাদের তালিকা এখানে দিচ্ছি না। তাঁদের অনেকে বেঁচে নেই--অনেকে বহাল তবিয়তে রাজনীতির ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন। আমি শেষপর্যন্ত সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতে পারি নি। কারণ, আমার মনে হয়েছিল আমাকে কোন রাজনৈতিক দলে থাকতে হলে আমার কলম এবং আমার কণ্ঠ বন্ধক রেখে হাতে জুতো পালিশের কালি আর ব্রাশ তুলে নিতে হবে। জামা-প্যান্টের পকেটে বড় বড় রুমাল আর নানা ধরণের তেলের শিশি রাখতে হবে। আমার পক্ষে সেসব সম্ভব ছিল না। রাজনীতিতে করেকম্মে খাওয়ার বা পদস্থহওয়ার অঢেল সুযোগ নানাভাবে আমার জীবনে এসেছিল--আমি প্রত্যাখ্যান করেছি ভদ্রতার সঙ্গেই--কারণ, সারা জীবন এক নিম্নমেধার মেরুদণ্ডহীন স্তাবক-ভাঁড়ের ভূমিকায় নিজের ব্যক্তিত্ব বোধ আত্মসম্মান এবং তার চেয়েও বড় আমার শিক্ষাদীক্ষা রুচি প্রবৃত্তি জলাঞ্জলি দেবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ হয় নি। স্তাবক-ভাঁড় তখনই হওয়া সম্ভব ছিল যখন ক্ষমতার এঁটোকাঁটা বা উচ্ছিষ্ট ছাড়া আমার চলবে না বলে মনে করতাম--যত কষ্টই হোক না কেন আমার তা ভাবার মতো দুর্ভাগ্য হয় নি। এঁটোকাঁটার সঙ্গে মুরুব্বি বা মাতব্বর হওয়ার সুযোগ সন্ধানও অনেককে স্তাবক বানায়। পদের লোভ ক্ষমতার লোভ বহু শিক্ষিতমুর্খকেও মোটা দাগের কমেডিয়ান বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে রাজনীতি--এটাও কিছু কম দেখলাম না জীবনে ! সুতরাং আমি স্তাবকতার লাইনে নিজেকে দাঁড় করাতে পারি নি--স্তাবক হতে পারলে যুক্তিতর্কবোধহীন বিরোধিতার কায়দাটাও রপ্ত করতে হতো--আমার সে বালাইও নেই। কিন্তু নিম্নমেধার শিক্ষিতমুর্খরা তা বিশ্বাস করবে কেন? তাদের তো প্রমাণ চাই ! সুতরাং প্রমাণ হিসেবে কিছু কথা বলা যেতেই পারে। আমি যখন কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন বামফ্রন্ট (সিপিএম) আমাকে একাধিকবার যমের বাড়ি পাঠাবার চেষ্টা করেছিল। বেঁচে গিয়েছিলাম। প্রস্তাব ছিল অনেক রকমের--কিন্তু উচ্ছিষ্টভোগী স্তাবকতার জীবনের প্রতি প্রবল ঘৃণা থেকেই নত হতে পারি নি। এ ইতিহাস খুব ছোট নয়। আমার কোচবিহারের জীবনের দুচারটে কথা বলা যেতে পারে। আমার মানসাই টাইমস্ সংবাদপত্র নিয়ে আমি বেশি কিছু বলব না--যারা নিয়মিত পড়েছেন তারা জানেন। ঐ পত্রিকায় বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে (যুক্তিহীন নয়) আমি যেভাবে লেখালেখি করেছি তাতে বামমহলে আমি প্রচণ্ড অপছন্দের মানুষ চিহ্নিত হয়েগিয়েছিলাম। তখন তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তরে পার্টি অফিস থেকে তথাকথিত সাংবাদিকদের তালিকা যেত কাদের কাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানানো হবে--কাদের জন্যে গাড়ি ও পানাহারের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি। মাঝে মাঝে আমিও আমন্ত্রণ পেতাম বটে তবে এমন সময়ে যখন আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হতো না। আমার কাগজে বিজ্ঞাপন প্রায় দেওয়াই হতো না--শেষাবধি আমি নিজেই কুৎসিত বৈষম্যের অভিযোগে সরকারি বিজ্ঞাপন বয়কট করেছিলাম। স্তাবকতার ইচ্ছে থাকলে তখন অনায়াসে সিপিএমের দাপুটে নেতা প্রয়াত সুধীর প্রামাণিক এবং মন্ত্রী দীনেশচন্দ্র ডাকুয়ার নেক নজরে থাকতেই পারতাম--একটুও কঠিন ছিল না। যেটার অভাব ছিল সেটা হল নির্লজ্জ দলদাস হওয়ার মানসিকতার অভাব। তখন বামবিরোধীদের অনেকেই আমার নিরপেক্ষতার প্রশংসক ছিলেন। বিখ্যাত দৈনিকগুলিতেও যখন আমার সাহসী কলম একইরকমভাবে সক্রিয় ছিল তখনও আমি বামবিরোধীদের কাছে সৎসাহসী নিরপেক্ষ ছিলাম। তখন যারা দলদাস ছিল নির্লজ্জ স্তাবক ছিল--তারা কিন্তু পালাবদলের পরেও সেই স্তাবকই থেকে গেল--উচ্ছিষ্টভোগী দলদাস থেকে গেল--যারা রঙ মেখে প্রতিদিন নিয়ম করে মমতার আদ্যশ্রাদ্ধ করতো টিভিতে--অক্লেশে অশালীন ভাষা ব্যবহার করতো তারাই আজ মমতার ভাবমূর্তির প্রধান রক্ষক ! এইসব বিষবৃক্ষদের চরিত্র সম্পর্কে মমতা কতটা জানেন আমি জানি না--কিন্তু এরাই যে সবার আগে তাঁর জাহাজ থেকে ঝাঁপ দেবে সে সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি সারদা-নারদা-রোজভ্যালি-নিয়োগপত্র বিক্রী-রেশনের চালচুরি-ত্রাণের ত্রিপল-চাল-টাকা চুরির প্রসঙ্গ বেমালুম ভুলে পিএম কেয়ার-এর বিশাল দুর্নীতি সম্পর্কে চিৎকার করছি না কেন? কিন্ত কে তাদের বোঝাবে  একমুখী চয়েস রাখতে শিখি নি। বাম আমলের একজনমন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ যেমন বলতে পারবেন না আমি আমার বা আমার পরিবারের কারুর জন্যে তাদের সামনে করজোড়ে মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে দাঁড়িয়েছি--ঠিক তেমনই গত ন-বছরেও আমি কোনো তৃণমূল মন্ত্রী- বিধায়ক- সাংসদ- নেতা নেত্রীরত্রীর সামনে আমার নিজের বা আমার পরিবারের কারুর বিন্দুমাত্র প্রয়োজনে করজোড়ে মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে দাঁড়িয়েছি এমনটা তৃণমূলেরও কেউ বলতে পারবেন না। তবে তৃণমূল আমার জন্যে কী বিস্ময়কর কিছু সৌজন্য দেখিয়েছে সে সম্পর্কে সময়মতো বিশদে লিখবো। শুধু তৃণমূল কেন--বেশ কিছু বিজেপি নেতা-কর্মীর সঙ্গেও (সবার নাম বলছি না) আমার পরিচয় থাকলেও একজনেও বলতে পারবেন না আমি তাদের সামনে কখনো দাঁড়িয়েছি! একসময়ে তৃণমূলের চোখে আমার যে নিরপেক্ষতা প্রশংসনীয় ছিল এখন তা খুব সঙ্গত কারণেই নেই। থাকার কথাও নয়--বিশেষ করে নিম্নমেধার স্তাবক মহলে। ২০১১ সালের পর আমি চাইলে ক্ষমতাসীন দলের ক্রীতদাসত্বের শর্তে অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে পারতাম। খুব কঠিন ছিল না আমার পক্ষে। কিন্তু পারি নি। আমার নির্বোধ আদর্শগত কারণেই। তার মানে অবশ্য এই নয় যে তার জন্যে আমার কোনোরকম  দুঃখবোধ আছে। কেউ কেউ আমাকে খুব সঙ্গত কারণেই বিজেপিরদলদাস বা স্তাবক হিসেবে চিহ্নিত করণের মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে--বিনা কারণে যে নয় আমি তা জানি। সময় ঘনিয়ে আসছে--রঙ বদলানোর আগে অনেকেরই আনুগত্যের বেলুন ফুলে ওঠে। আমি আমার জায়গায় যেমন আছি তেমনই থাকবো। কিন্তু নিম্নমেধার নির্লজ্জ প্রকৃত স্তাবকেরা কতদিন দলদাস থাকতে পারে সেটাই এখন দেখার। আমি যেমনভাবে স্তাবক ও বিরোধীদের চিনে এসেছি--তাদের চরিত্র সম্পর্কে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেয়েছি তাতে স্তাবকতা ও বিরোধিতা প্রসঙ্গে একটা পুস্তক লেখাও খুব কঠিন কিছু নয় আমার কাছে। যদিও তা লেখার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার নেই !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.