চীন এত অসহিষ্ণু আচরণ করছে নিজেদের দিক থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যেই !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
আমি যখন এই প্রতিবেদন শুরু করছি তখনও পর্যন্ত প্ররোচনামূলক চীনা হামলায় ভারতের ২০ জন হতাহত হয়েছেন এবং ভারতের পাল্টা জবাবে চীনের ৪৩ জন হতাহত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ মনে করতে হচ্ছে ১৯৬৭’র শেষ ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষে ভারতের ৮০ এবং চীনের ৪০০ জন হতাহত হয়েছিল। সংঘর্ষটা শেষপর্যন্ত প্রকৃত যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় নি। ১৯৬২ সালের ভারতবর্ষকে চীন কেন হেনস্থা করতে পেরেছিল তার ঐতিহাসিক কারণ অনেকেই জানেন--সেটা অন্য প্রসঙ্গ এবং হয়তো একদিন সে ইতিহাস নিয়েও একটু নাড়াচাড়া করতে হবে।
যাইহোক, মূল বিষয়ে ঢোকার আগে আমি খুব স্পষ্ট করেই একটা কথা এখানে জানিয়ে রাখতে চাই। আজ যদি ৫৬ ইঞ্চির মোদী’র বদলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন মহম্মদ সেলিম, রাহুল গান্ধী, অভিষেক ব্যানার্জ্জী, চিদাম্বরম, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী কিংবা তেজস্বীপ্রসাদও তাহলেও আমি ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ বিদেশমন্ত্রক তথা গোটা দেশের সরকারের বিরুদ্ধে বা চীনাদের পক্ষে একটা অক্ষরও উচ্চারণ করতাম না। যে সব বিরোধী নেতাদের নাম উল্লেখ করলাম তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মেধা সম্পর্কে আমার খুব স্পষ্ট ধারণা রয়েছে--তবুও চীনের প্রতি গভীর প্রেম হৃদয়ে লালন করে ভারত সরকারকে অত্যন্ত নিম্নস্তরের, প্রায় ইতরতার সীমায় পৌঁছে গিয়ে নিরন্তর খোঁচা মারার কথা ভাবতে পারতাম না--কাউকে খোঁচা মারতে দেখলে তাকে চীনের চটিচাটা এজন্ট হিসেবেই চিহ্নিত করতাম।
তাই খুব বিনম্রতার সঙ্গেই আমি তাদের অনুরোধ করবো যারা চীনপ্রেমে টালমাটাল হয়ে দেশের সরকার বা সেনাবাহিনীকে নিয়ে নির্লজ্জ রঙতামাশা করবেন তেমন কেউ যদি আমার বন্ধু তালিকায় থাকেন তাহলে বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাঁরা আমাকে ত্যাগ করুন। আমার দেশের জননির্বাচিত সরকার এবং দেশের সেনাবাহিনী যাদের নিম্নমেধার স্থূল ফাজলামির বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে তাদের সঙ্গে আমার কোনোরকম সম্পর্ক বজায় রাখতে গেলে যে ধরণের সমঝোতার প্রয়োজন আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়।
যাইহোক, এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। চীন হাজার চেষ্টা করেও করোনা ভাইরাসকে ল্যাবে মিউটেশন করে নিজেদের বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ’র জন্য ব্যবহারের যে সুযোগ নিয়েছে তা আড়াল করতে পারে নি। হুবাউ প্রদেশর উহান শহরকে জনশূন্য করার পরিকল্পনা তাদের আকস্মিক ছিল না। হুবাউ প্রদেশকে এবং ছোটখাট দু-চারটি জনপদকে বাদ দিয়ে চীন গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বিশেষ টিকা প্রদানের কর্মসূচী পালন করে বলে খবর ছড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। সেটা করোনার অ্যান্টি-ডোজ ছিল বলেই অনেকের ধারণা। তাই হুবাউ সহ ছোটখাট কিছু জনপদ ছাড়া করোনা প্রকোপ ছড়ায় নি চীনে। তাদের আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা সরকারিভাবে চীন যা প্রকাশ করেছে তা বিশ্বের বহু দেশই বিশ্বাস করে নি। কারণ, প্রায় দেড় কোটি মোবাইল গ্রাহকের কোনো পাত্তা এখনও পাওয়া যায় নি। এতে চীনকে বিশেষ উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় নি। চীন চেয়েছিল বিশ্বের সমস্ত চীনা মলগুলির মাধ্যমে এবং সাইলেন্ট ক্যারিয়ারের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে টেস্ট কিট্ পিপিই মাস্ক গ্লাভস্ ইত্যাদির বিরাট মার্টেটিং করে নেবে। তারপর বছরখানেক আমেরিকা ও তার মিত্রগোষ্ঠীর দেশগুলোকে ভালোভাবে রগড়ে নেওয়ার পর ভ্যাকসিনের ব্যবসাতেও সকলকে টেক্কা দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য মানচিত্রে শীর্ষস্থানে উঠে আসবে। প্রাথমিক পর্যায়ে চীনের এই চাল কেউই ধরতে পারে নি। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে অসংখ্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর একই সঙ্গে চীন ও তাদের তাঁবেদারে পরিণত ‘হু’র কাছেও পাওয়া যাচ্ছিল না তখন যা ছিল সন্দেহের তাই হয়ে উঠলো সত্যের। ফলে আমেরিকা তো বটেই--বৃটেন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশগুলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ভাবিত হতে থাকল। কেউ কেউ ঘোষণাই করে দিল চীনের বদলে ভারতে ব্যবসা গুটিয়ে আনাটাই নিরাপদ হবে। চীন যা ভেবেছিল তা না হওয়ার কারণে রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়ে এবং সেই হতাশা থেকেই তাদের মনে জন্ম নেয় তীব্র অসহিষ্ণুতা। নানান কারণে তাদের এই অসহিষ্ণুতা ভারতের বিরুদ্ধেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠলো। তারও অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে তাদের এই অসহিষ্ণুতার ছবিটা এখন একটু বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
যাইহোক, মূল বিষয়ে ঢোকার আগে আমি খুব স্পষ্ট করেই একটা কথা এখানে জানিয়ে রাখতে চাই। আজ যদি ৫৬ ইঞ্চির মোদী’র বদলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন মহম্মদ সেলিম, রাহুল গান্ধী, অভিষেক ব্যানার্জ্জী, চিদাম্বরম, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী কিংবা তেজস্বীপ্রসাদও তাহলেও আমি ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ বিদেশমন্ত্রক তথা গোটা দেশের সরকারের বিরুদ্ধে বা চীনাদের পক্ষে একটা অক্ষরও উচ্চারণ করতাম না। যে সব বিরোধী নেতাদের নাম উল্লেখ করলাম তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মেধা সম্পর্কে আমার খুব স্পষ্ট ধারণা রয়েছে--তবুও চীনের প্রতি গভীর প্রেম হৃদয়ে লালন করে ভারত সরকারকে অত্যন্ত নিম্নস্তরের, প্রায় ইতরতার সীমায় পৌঁছে গিয়ে নিরন্তর খোঁচা মারার কথা ভাবতে পারতাম না--কাউকে খোঁচা মারতে দেখলে তাকে চীনের চটিচাটা এজন্ট হিসেবেই চিহ্নিত করতাম।
তাই খুব বিনম্রতার সঙ্গেই আমি তাদের অনুরোধ করবো যারা চীনপ্রেমে টালমাটাল হয়ে দেশের সরকার বা সেনাবাহিনীকে নিয়ে নির্লজ্জ রঙতামাশা করবেন তেমন কেউ যদি আমার বন্ধু তালিকায় থাকেন তাহলে বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাঁরা আমাকে ত্যাগ করুন। আমার দেশের জননির্বাচিত সরকার এবং দেশের সেনাবাহিনী যাদের নিম্নমেধার স্থূল ফাজলামির বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে তাদের সঙ্গে আমার কোনোরকম সম্পর্ক বজায় রাখতে গেলে যে ধরণের সমঝোতার প্রয়োজন আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়।
যাইহোক, এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। চীন হাজার চেষ্টা করেও করোনা ভাইরাসকে ল্যাবে মিউটেশন করে নিজেদের বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ’র জন্য ব্যবহারের যে সুযোগ নিয়েছে তা আড়াল করতে পারে নি। হুবাউ প্রদেশর উহান শহরকে জনশূন্য করার পরিকল্পনা তাদের আকস্মিক ছিল না। হুবাউ প্রদেশকে এবং ছোটখাট দু-চারটি জনপদকে বাদ দিয়ে চীন গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বিশেষ টিকা প্রদানের কর্মসূচী পালন করে বলে খবর ছড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। সেটা করোনার অ্যান্টি-ডোজ ছিল বলেই অনেকের ধারণা। তাই হুবাউ সহ ছোটখাট কিছু জনপদ ছাড়া করোনা প্রকোপ ছড়ায় নি চীনে। তাদের আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা সরকারিভাবে চীন যা প্রকাশ করেছে তা বিশ্বের বহু দেশই বিশ্বাস করে নি। কারণ, প্রায় দেড় কোটি মোবাইল গ্রাহকের কোনো পাত্তা এখনও পাওয়া যায় নি। এতে চীনকে বিশেষ উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় নি। চীন চেয়েছিল বিশ্বের সমস্ত চীনা মলগুলির মাধ্যমে এবং সাইলেন্ট ক্যারিয়ারের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে টেস্ট কিট্ পিপিই মাস্ক গ্লাভস্ ইত্যাদির বিরাট মার্টেটিং করে নেবে। তারপর বছরখানেক আমেরিকা ও তার মিত্রগোষ্ঠীর দেশগুলোকে ভালোভাবে রগড়ে নেওয়ার পর ভ্যাকসিনের ব্যবসাতেও সকলকে টেক্কা দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য মানচিত্রে শীর্ষস্থানে উঠে আসবে। প্রাথমিক পর্যায়ে চীনের এই চাল কেউই ধরতে পারে নি। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে অসংখ্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর একই সঙ্গে চীন ও তাদের তাঁবেদারে পরিণত ‘হু’র কাছেও পাওয়া যাচ্ছিল না তখন যা ছিল সন্দেহের তাই হয়ে উঠলো সত্যের। ফলে আমেরিকা তো বটেই--বৃটেন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশগুলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ভাবিত হতে থাকল। কেউ কেউ ঘোষণাই করে দিল চীনের বদলে ভারতে ব্যবসা গুটিয়ে আনাটাই নিরাপদ হবে। চীন যা ভেবেছিল তা না হওয়ার কারণে রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়ে এবং সেই হতাশা থেকেই তাদের মনে জন্ম নেয় তীব্র অসহিষ্ণুতা। নানান কারণে তাদের এই অসহিষ্ণুতা ভারতের বিরুদ্ধেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠলো। তারও অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে তাদের এই অসহিষ্ণুতার ছবিটা এখন একটু বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যখন গত সপ্তাহে চীনা সেনাবাহিনীকে “সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকার’’ পরামর্শ দেন তাকে অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করেছেন সীমান্তে নতুন করে শুরু হওয়া সঙ্কটে ভারতের প্রতি চীনের প্রচ্ছন্ন একটি হুমকি হিসাবে। কারণ চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘দি গ্লোবাল টাইমস্’ গত কয়েকদিনে ভারতকে লক্ষ্য করে একই ধরণের আক্রমণাত্মক লেখালেখি করে চলেছে।
চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কোনো বিষয় নয়, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন হঠাৎ করে এই করোনা ভাইরাস প্যানডেমিকের ভেতর এই প্ররোচনামূলক বিরোধ শুরু হলো কেন?
পশ্চিমা এবং ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক বলছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব-বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরে করে চলেছে, এবং করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সারা বিশ্ব যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বেইজিং এটাকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থের করার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। শুধু সীমান্তে চাপ তৈরি নয়, হংকংয়েও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন।
এসব রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরও সঙ্কটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ-সাহায্য দিয়ে অনেকটা একইভাবে বেইজিং তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকায় গত কয়েকবছর ধরে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো তৈরি করছে তাতে চীন সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, এবং ভারতের এই কর্মকাণ্ড তারা আর মেনে নিতে রাজি নয়।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, চীন ও ভারতের সীমান্ত রেখা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ ঐতিহাসিক, “কিন্তু গত দশ-বারো বছরে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে ভারত যেভাবে ব্যাপক হারে অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে তাতে চীন বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বিগ্ন । ভারতে কট্টর জাতীয়তাবাদী একটি সরকারের ক্ষমতা-গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের গভীর সামরিক এবং রাজনৈতিক নৈকট্যে বেইজিংয়ের উদ্বেগ দিন দিন আরো বাড়ছে।
হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমসে তাঁর এক লেখায় সুইডিশ বিশ্লেষক বার্টিল লিনটার বলছেন, লাদাখে ভারতের সড়ক নির্মাণকে চীন একটি হুমকি হিসাবে দেখতে শুরু করেছে।
তিনি বলছেন, বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাশা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়ক চীন তৈরি করেছে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমনিতেই এই দুটো প্রত্যন্ত প্রদেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই উদ্বেগে। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীন নামে যে এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে সেটিকে ভারত তাদের এলাকা বলে বিবেচনা করে। এলাকাটি ভারতীয় মানচিত্রের অংশ। সুতরাং, মি. লিনটার বলছেন, সেই অঞ্চলের কাছে ভারতের অবকাঠামো নির্মাণের তৎপরতা চীন মেনে নিতে পারছে না।
চীনের গ্লোবাল টাইমসে গত কয়েকদিনে বেশ কিছু সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়তে ভারতের বিরুদ্ধে এমন সব কড়া কড়া ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। ১৯শে মে প্রকাশিত সংখ্যায় তারা লাদাখের গালোয়ান উপত্যকায় ‘অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা’ তৈরির জন্য ভারতকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছে। লেখা হয়েছে, “ভারত যদি উসকানি অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হবে !’’
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের প্রসঙ্গ টানছে গ্লোবাল টাইমস। ২৫মে মে এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে --“যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্কে উত্তেজনা চলছে, তারপরও ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়কার তুলনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের অবস্থান এখন অনেক সুদৃঢ়। চীনের অর্থনীতি এখন ভারতের চেয়ে পাঁচগুণ বড়।’’
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্রে এ ধরণের কথাবার্তাকে অনেক বিশ্লেষক বিরল হুমকি হিসাবে ব্যাখ্যা করছেন। চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের ৩,৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫,০০০ বর্গমাইল এলাকাকে ভারত তাদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে মনে করে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে ভুটানের সীমান্তে দোকলাম নামক একটি এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি নিয়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ৭২দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণ ছাড়াও ভারত চীনের জন্য অন্য মাথাব্যথারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোট বেধে চীনকে কোণঠাসা করার যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে, ভারতকে সেই জোটের অংশ হিসাবে দেখছে চীন।
ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী, যিনি ভারত-চীন বৈরিতা নিয়ে গবেষণা-ধর্মী একটি বই লিখেছেন, তিনি বলেন, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি “অক্ষশক্তি’’ তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে।’’
আমেরিকা মনে করে চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত দশ বছরে তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে।’’
গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন লেখায় এমন কিছু মন্তব্য এবং তুলনা টেনেছে যাতে বোঝা যায় যে ভারতকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী একটি অক্ষের অংশ হিসাবে মনে করছে।
২৫মে মে চীনা একজন বিশ্লেষক লং শিং চুং এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন, “ভারত সরকার যেন তাদের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কামানের গোলা হিসাবে ব্যবহৃত না হতে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার দুই দেশকেই সতর্ক থাকবে হবে, কারণ যে কোনো সুযোগেই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব।’’
১৯৮৮তে চীন এবং ভারতের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া হয় যে তারা সীমান্ত নিয়ে কোনো বিরোধে জড়াবে না, যাতে দুটো দেশই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে পারে। কিন্তু গত ৩২ বছরে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। ১৯৮৮ তে ভারত ও চীনের অর্থনীতি ছিল প্রায় একই মাপের। একই পরিমাণ অর্থ তারা প্রতিরক্ষায় খরচ করতো।
কিন্তু এখন চীনের অর্থনীতি চীনের দাবি মতে ভারতের পাঁচগুণ বড়। প্রতিরক্ষায় ভারতের চেয়ে চারগুণ বেশি খরচ করছে চীন।
“সম্পর্কের হিসাব বদলে গেছে’’--যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা এবং কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’তে লিখেছেন সুমিত ব্যানার্জি । চীন ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী, যদিও চীনের রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি আমদানি করে ভারত। গতবছর বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫,৩০০ কোটি ডলার। ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, বিশাল এই ঘাটতির কারণেই ভারতের মধ্যে এখন চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও আর তেমন আগ্রহ নেই। “বরঞ্চ ভারত এখন খোলাখুলি বলছে, চীন থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এলে ভারত সবরকম সাহায্য দেবে।’’
ড. আলী মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বৃহত্তর কৌশলগত বিরোধ--যেটাকে নতুন এক শীতল যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হচ্ছে--চলছে তার ভেতর ভারত ঢুকে পড়েছে। যেটা, তার মতে,পারমাণবিক অস্ত্রধর দুই প্রতিবেশির মধ্যে সীমান্ত সঙ্কট মোকাবেলার পথকে দিনকে দিন কঠিন এবং বিপদসংকুল করে ফেলছে।
কিন্তু চীন বারে বারেই ১৯৬২ সালের যুদ্ধের কথা শোনায়। কিন্তু ওরা ভুলে যায় যে ওই যুদ্ধের পরে আরো ৫৫ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৯৬৭ সালে নাথুলা পাসে দুই দেশের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতে ভারত কী রকম জবাব দিয়েছিল তা বোধহয় চীন ভুলে গেছে।
তারপরেও ১৯৮৭ সালে সুন্দরম চু এলাকা দিয়ে চীনা সেনারা ভারতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ জেনারেল সুন্দরজী তাদেরকে এমন প্যাঁচে ফেলেছিলেন যে ওদের লুকিয়ে পালাতে হয়েছিল ভারত ছেড়ে।
এছাড়াও চীনের মনে রাখা উচিত যে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামকে 'উচিত শিক্ষা' দিতে গিয়ে ওদের নিজেদেরই কী শিক্ষা হয়েছিল! সে জন্যই আমার মতো অনেকেই মনে করে--ফালতু আর বাচ্চাদের মতো হুমকি যেন চীন না দেয়।
১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়ে সেনা অভিযানের সব নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব (প্রধানমন্ত্রী নেহরু) নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু সেনা জেনারেল নিজের দায়িত্ব পূরণ করতে পারেন নি। এজন্যই চীনের কাছে পর্যুদস্ত হতে হয়েছিল ভারতকে।
’৬২ সালের যুদ্ধ নিয়ে যত বই বেরিয়েছে, সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় সেনাবাহিনী সব দায় দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নেহরু আর তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের ওপরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঠিকমতো যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিতে পারে নি। সেই সময়ে বরফে ঢাকা এলাকায় যুদ্ধ করার মতো পোশাক অথবা অস্ত্র--কিছুই ঠিকমতো ছিল না। তাদের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে টিঁকে থাকার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও ছিল না তখন। আর এসবের মধ্যে নেহরু আর মেনন ভরসা করেছিলেন যে তারা সমস্যাটার রাজনৈতিক সমাধান করে ফেলতে পারবেন। ভেবেছিলেন, জাতিসংঘে ভাষণ শুনিয়ে চীনকে পিছু হঠতে বাধ্য করতে পারবেন তারা ! ফলে সঙ্গত কারণেই তাদের কোনও প্রচেষ্টাই সফল হয় নি।
কিন্তু এখনকার ভারত ও তার সেনাবাহিনী ৬২’র সময়কার নয়। চীনের প্ররোচনার জবাব ভারত কখন কিভাবে দেবে তার জন্যে হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কী পদক্ষেপ নেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক-বিদেশমন্ত্রক এবং সেনাবাহিনীর প্রধানেরা তা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কোনো সুমনের সঙ্গে একঘন্টা মার্কা সাংবাদমাধ্যমে বসে আলোচনা করে নেবেন না--প্রতিরক্ষা ও সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ প্রকাশ্যে আলোচনার বিষয়ও নয়। জলে স্থলে ও আকাশে আজকের ভারতীয় বাহিনীর সঠিক চেহারাটা বিরোধীনেতাদের মতো চীনেরওে সম্যক জানা নেই। শুধু একটা ছোট্ট সংবাদ থেকেই যাদের যা বোঝার তারা তা বুঝে নেবেন। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই চীনের উদ্বেগ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ‘‘ব্রহ্মস্’’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রেখেছেন ! ভারতের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে চীন প্রায় একলা। তাদের হিম্মত-ই হবে না ভারতের বিরুদ্ধে অল-আউট যুদ্ধে নামার। করোনা-অস্বস্তি থেকে বিশ্বের নজর ঘোরাতেই চীন ভারত সীমান্তে তলোয়ার ঘোরাচ্ছে, একই সঙ্গে হংকংয়েও তাদের দমনপীড়নের রাজনীতি বাড়িয়ে চলেছে। যদিও বিশেষ কেনো লাভ চীনের হবে না--কারণ তাদের সামনের পর্দা এখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তথাপি যদি চীন ৬২’র গান গেয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্ররোচনা তৈরি করে তাহলে তাদের কল্পনাতীত অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে--এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কোনো বিষয় নয়, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন হঠাৎ করে এই করোনা ভাইরাস প্যানডেমিকের ভেতর এই প্ররোচনামূলক বিরোধ শুরু হলো কেন?
পশ্চিমা এবং ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক বলছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব-বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরে করে চলেছে, এবং করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সারা বিশ্ব যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বেইজিং এটাকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থের করার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। শুধু সীমান্তে চাপ তৈরি নয়, হংকংয়েও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন।
এসব রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরও সঙ্কটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ-সাহায্য দিয়ে অনেকটা একইভাবে বেইজিং তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকায় গত কয়েকবছর ধরে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো তৈরি করছে তাতে চীন সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, এবং ভারতের এই কর্মকাণ্ড তারা আর মেনে নিতে রাজি নয়।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, চীন ও ভারতের সীমান্ত রেখা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ ঐতিহাসিক, “কিন্তু গত দশ-বারো বছরে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে ভারত যেভাবে ব্যাপক হারে অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে তাতে চীন বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বিগ্ন । ভারতে কট্টর জাতীয়তাবাদী একটি সরকারের ক্ষমতা-গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের গভীর সামরিক এবং রাজনৈতিক নৈকট্যে বেইজিংয়ের উদ্বেগ দিন দিন আরো বাড়ছে।
হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমসে তাঁর এক লেখায় সুইডিশ বিশ্লেষক বার্টিল লিনটার বলছেন, লাদাখে ভারতের সড়ক নির্মাণকে চীন একটি হুমকি হিসাবে দেখতে শুরু করেছে।
তিনি বলছেন, বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাশা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়ক চীন তৈরি করেছে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমনিতেই এই দুটো প্রত্যন্ত প্রদেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের আনুগত্য নিয়ে চীন সবসময়েই উদ্বেগে। উপরন্তু এই মহাসড়কটি আকসাই চীন নামে যে এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে সেটিকে ভারত তাদের এলাকা বলে বিবেচনা করে। এলাকাটি ভারতীয় মানচিত্রের অংশ। সুতরাং, মি. লিনটার বলছেন, সেই অঞ্চলের কাছে ভারতের অবকাঠামো নির্মাণের তৎপরতা চীন মেনে নিতে পারছে না।
চীনের গ্লোবাল টাইমসে গত কয়েকদিনে বেশ কিছু সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়তে ভারতের বিরুদ্ধে এমন সব কড়া কড়া ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। ১৯শে মে প্রকাশিত সংখ্যায় তারা লাদাখের গালোয়ান উপত্যকায় ‘অবৈধ প্রতিরক্ষা স্থাপনা’ তৈরির জন্য ভারতকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছে। লেখা হয়েছে, “ভারত যদি উসকানি অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হবে !’’
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের প্রসঙ্গ টানছে গ্লোবাল টাইমস। ২৫মে মে এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে --“যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্কে উত্তেজনা চলছে, তারপরও ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়কার তুলনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের অবস্থান এখন অনেক সুদৃঢ়। চীনের অর্থনীতি এখন ভারতের চেয়ে পাঁচগুণ বড়।’’
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্রে এ ধরণের কথাবার্তাকে অনেক বিশ্লেষক বিরল হুমকি হিসাবে ব্যাখ্যা করছেন। চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের ৩,৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫,০০০ বর্গমাইল এলাকাকে ভারত তাদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচলকে চীন তাদের এলাকা বলে মনে করে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে ভুটানের সীমান্তে দোকলাম নামক একটি এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি নিয়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ৭২দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণ ছাড়াও ভারত চীনের জন্য অন্য মাথাব্যথারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোট বেধে চীনকে কোণঠাসা করার যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে, ভারতকে সেই জোটের অংশ হিসাবে দেখছে চীন।
ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী, যিনি ভারত-চীন বৈরিতা নিয়ে গবেষণা-ধর্মী একটি বই লিখেছেন, তিনি বলেন, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি “অক্ষশক্তি’’ তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে।’’
আমেরিকা মনে করে চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত দশ বছরে তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে।’’
গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন লেখায় এমন কিছু মন্তব্য এবং তুলনা টেনেছে যাতে বোঝা যায় যে ভারতকে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী একটি অক্ষের অংশ হিসাবে মনে করছে।
২৫মে মে চীনা একজন বিশ্লেষক লং শিং চুং এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন, “ভারত সরকার যেন তাদের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কামানের গোলা হিসাবে ব্যবহৃত না হতে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার দুই দেশকেই সতর্ক থাকবে হবে, কারণ যে কোনো সুযোগেই শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাব।’’
১৯৮৮তে চীন এবং ভারতের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া হয় যে তারা সীমান্ত নিয়ে কোনো বিরোধে জড়াবে না, যাতে দুটো দেশই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে পারে। কিন্তু গত ৩২ বছরে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। ১৯৮৮ তে ভারত ও চীনের অর্থনীতি ছিল প্রায় একই মাপের। একই পরিমাণ অর্থ তারা প্রতিরক্ষায় খরচ করতো।
কিন্তু এখন চীনের অর্থনীতি চীনের দাবি মতে ভারতের পাঁচগুণ বড়। প্রতিরক্ষায় ভারতের চেয়ে চারগুণ বেশি খরচ করছে চীন।
“সম্পর্কের হিসাব বদলে গেছে’’--যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা এবং কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’তে লিখেছেন সুমিত ব্যানার্জি । চীন ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী, যদিও চীনের রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি আমদানি করে ভারত। গতবছর বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫,৩০০ কোটি ডলার। ড. মাহমুদ আলী মনে করেন, বিশাল এই ঘাটতির কারণেই ভারতের মধ্যে এখন চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও আর তেমন আগ্রহ নেই। “বরঞ্চ ভারত এখন খোলাখুলি বলছে, চীন থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এলে ভারত সবরকম সাহায্য দেবে।’’
ড. আলী মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বৃহত্তর কৌশলগত বিরোধ--যেটাকে নতুন এক শীতল যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হচ্ছে--চলছে তার ভেতর ভারত ঢুকে পড়েছে। যেটা, তার মতে,পারমাণবিক অস্ত্রধর দুই প্রতিবেশির মধ্যে সীমান্ত সঙ্কট মোকাবেলার পথকে দিনকে দিন কঠিন এবং বিপদসংকুল করে ফেলছে।
কিন্তু চীন বারে বারেই ১৯৬২ সালের যুদ্ধের কথা শোনায়। কিন্তু ওরা ভুলে যায় যে ওই যুদ্ধের পরে আরো ৫৫ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৯৬৭ সালে নাথুলা পাসে দুই দেশের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতে ভারত কী রকম জবাব দিয়েছিল তা বোধহয় চীন ভুলে গেছে।
তারপরেও ১৯৮৭ সালে সুন্দরম চু এলাকা দিয়ে চীনা সেনারা ভারতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ জেনারেল সুন্দরজী তাদেরকে এমন প্যাঁচে ফেলেছিলেন যে ওদের লুকিয়ে পালাতে হয়েছিল ভারত ছেড়ে।
এছাড়াও চীনের মনে রাখা উচিত যে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামকে 'উচিত শিক্ষা' দিতে গিয়ে ওদের নিজেদেরই কী শিক্ষা হয়েছিল! সে জন্যই আমার মতো অনেকেই মনে করে--ফালতু আর বাচ্চাদের মতো হুমকি যেন চীন না দেয়।
১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়ে সেনা অভিযানের সব নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব (প্রধানমন্ত্রী নেহরু) নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু সেনা জেনারেল নিজের দায়িত্ব পূরণ করতে পারেন নি। এজন্যই চীনের কাছে পর্যুদস্ত হতে হয়েছিল ভারতকে।
’৬২ সালের যুদ্ধ নিয়ে যত বই বেরিয়েছে, সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় সেনাবাহিনী সব দায় দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নেহরু আর তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের ওপরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঠিকমতো যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিতে পারে নি। সেই সময়ে বরফে ঢাকা এলাকায় যুদ্ধ করার মতো পোশাক অথবা অস্ত্র--কিছুই ঠিকমতো ছিল না। তাদের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে টিঁকে থাকার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও ছিল না তখন। আর এসবের মধ্যে নেহরু আর মেনন ভরসা করেছিলেন যে তারা সমস্যাটার রাজনৈতিক সমাধান করে ফেলতে পারবেন। ভেবেছিলেন, জাতিসংঘে ভাষণ শুনিয়ে চীনকে পিছু হঠতে বাধ্য করতে পারবেন তারা ! ফলে সঙ্গত কারণেই তাদের কোনও প্রচেষ্টাই সফল হয় নি।
কিন্তু এখনকার ভারত ও তার সেনাবাহিনী ৬২’র সময়কার নয়। চীনের প্ররোচনার জবাব ভারত কখন কিভাবে দেবে তার জন্যে হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কী পদক্ষেপ নেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক-বিদেশমন্ত্রক এবং সেনাবাহিনীর প্রধানেরা তা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কোনো সুমনের সঙ্গে একঘন্টা মার্কা সাংবাদমাধ্যমে বসে আলোচনা করে নেবেন না--প্রতিরক্ষা ও সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ প্রকাশ্যে আলোচনার বিষয়ও নয়। জলে স্থলে ও আকাশে আজকের ভারতীয় বাহিনীর সঠিক চেহারাটা বিরোধীনেতাদের মতো চীনেরওে সম্যক জানা নেই। শুধু একটা ছোট্ট সংবাদ থেকেই যাদের যা বোঝার তারা তা বুঝে নেবেন। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই চীনের উদ্বেগ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ‘‘ব্রহ্মস্’’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রেখেছেন ! ভারতের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে চীন প্রায় একলা। তাদের হিম্মত-ই হবে না ভারতের বিরুদ্ধে অল-আউট যুদ্ধে নামার। করোনা-অস্বস্তি থেকে বিশ্বের নজর ঘোরাতেই চীন ভারত সীমান্তে তলোয়ার ঘোরাচ্ছে, একই সঙ্গে হংকংয়েও তাদের দমনপীড়নের রাজনীতি বাড়িয়ে চলেছে। যদিও বিশেষ কেনো লাভ চীনের হবে না--কারণ তাদের সামনের পর্দা এখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তথাপি যদি চীন ৬২’র গান গেয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্ররোচনা তৈরি করে তাহলে তাদের কল্পনাতীত অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে--এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
কোন মন্তব্য নেই