Header Ads

বিজ্ঞানের রাজনৈতিক পদলেহী ভাঙা ব্যবস্থা উন্মোচন করেছে কভিড-১৯ : হর্টন !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে বিদ্যমান নানা ঘরানার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অন্যতম একটি হলো, মহামারী মোকাবেলায় সরকার ও তার বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং পদক্ষেপ নিয়েছেন সেসবের সমালোচনা করার সময় এখনো হয়নি। যতক্ষণ না সমস্ত ব্যাপারটা বিস্তারিত জানা যাচ্ছে, প্রকৃত তথ্য সামনে উন্মোচিত হচ্ছে এবং সঙ্কট প্রশমিত না হচ্ছে ততক্ষণ অপেক্ষা করাই শ্রেয়। এরপর না হয় সংশ্লিষ্টদের পারফরমেন্স বিশ্লেষণ করতে বসা যাবে।

তবে চিকিৎসা বিষয়ক প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ল্যানসেট’-এর সম্পাদক রিচার্ড হার্টন এমন চিন্তার লোক নন। এই সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান সংশ্লিষ্টরা সরকারের প্রতি যেভাবে একটা নীরব বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার মতো আচরণ করছে তার স্পষ্ট ও চাঁছাছোলা সমালোচনা করে আসছেন হার্টন। সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি ‘সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া’ এবং ‘পরিস্থিতির বিপজ্জনক ভুল মূল্যায়নের’ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তার মতে, এই ভুল পদক্ষেপের কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলেন, যেসব মৃত্যু সতিই এড়ানো সম্ভব ছিল।
‘দ্য কভিড-১৯ : হোয়াটস গন রং অ্যান্ড হাউ টু স্টপ ইট হ্যাপেনিং এগেইন’ নামের ছোট একটি বই লিখেছেন হার্টন। এটাকে মূলত গত কয়েক মাসে ল্যানসেটের লেখা তীব্র সমালোচনামূলক জ্বালাময়ী নিবন্ধগুলোর একটা সংকলন বলা চলে। তিনি করোনাভাইরাস মোকাবেলা কৌশলকে ‘এক প্রজন্মে সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক নীতি কৌশলের ব্যর্থতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ব্রিটেনের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর ইমারজেন্সিসকে (সেইজ) সরকারের জনসংযোগ শাখার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ও কর্মীদের ব্যর্থ করে দেয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। সেই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরুরি সতর্কতা বিবেচনায় না নেয়ার কারণে মেডিক্যাল রয়্যাল কলেজ, দ্য একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস, ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডকে একহাত নিয়েছেন। যুক্তরাজ্য সরকারকেও ধীর, আত্মতৃপ্ত এবং গা-ছাড়া প্রতিক্রিয়ার জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি।
হার্টনের মতে, সবগুলো প্রতিষ্ঠানের এভাবে সাড়া দেওয়ার মানে হলো, সরকারের অপ্রস্তুতি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অপকর্মের সহযোগী ও চাটুকারিতামূলক এক ভাঙা ব্যবস্থাও আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।
হার্টন একজন দুর্দান্ত বিচক্ষণ মানুষ। তিনি সাধারণত পুরো ব্যবস্থাকে আক্রমণ করে এভাবে কথা বলেন না। গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ঋদ্ধ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহজেই রসিকতা করতে পারেন এবং তাকে খুব সহজেই হাসানো যায়।  কিন্তু এই মহামারীকালে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বৈজ্ঞানিক সমাজ যেভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও তোশামোদে ব্যস্ত থেকে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে ল্যানসেটের সম্পাদক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ক্রিস হুইটি, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মরর্তা প্যাট্রিক ভ্যালান্স--এমন কয়েকজনের নাম করে হার্টন বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তারা দুর্দান্ত মানুষ। তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছেন। আমি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করছি না। কিন্তু এই পুরো ব্যবস্থাটি ভয়ঙ্করভাবে ব্যর্থ হয়েছে। 
এমন পরিস্থিতি ও পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণে ল্যানসেটের সম্পাদক হিসেবে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। কারণ জানুয়ারির শেষ দিকে জার্নালে প্রকাশিত পাঁচটি অ্যাকাডেমিক গবেষণাপত্রের সিরিজে নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রে তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। পরীক্ষার গুরুত্ব, জনসমাগম এড়ানো, স্কুল বন্ধের বিষয়টি এবং লকডাউনের গুরুত্ব আলোচিত হয়েছিল। গত তিন মাসে যা ঘটেছে- তার সবই ওই পাঁচটি পেপারে ছিল।
হার্টন এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, ব্রিটেন সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারা কেন চীনের সঙ্গে পরামর্শ করেননি। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জগতটা কিন্তু খুব ছোট। চীন সরকারের প্রতিক্রিয়া সমন্বয় করার জন্য প্রত্যেকেই দায়ী ব্যক্তিদের চেনেন। লোকগুলো আক্ষরিক অর্থে একটি ই-মেইল পাঠাতে পারতো বা ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে পারতো যে আপনার গবেষণাটি ল্যানসেটে পড়েছি, পরিস্থিতি কি এতটাই খারাপ? উহানে কী চলছে? তারা যদি এটা করতো তাহলে জানতে পারতো, বাস্তব পরিস্থিতি গবেষণাপত্রে বর্ণনার চেয়েও সঙ্গীন।’
অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে আদৌ চীনের সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নন হার্টন। তিনি বলেন, যদি তারা যোগাযোগ করেও থাকে, তবে তাদের প্রতিক্রিয়াটি এতটাই অল্প ছিল, যার কারণে কভিড-১৯ এর মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ দেশের পরেই যুক্তরাজ্য বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে।
বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা দলের বৈঠকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্য সমস্যার সমান্তরালে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ল্যানসেট সম্পাদক বলেন, এটা একটা বিপজ্জনক জায়গা। কারণ স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এখানে উপদেষ্টা দলের সক্ষমতাকে আপস করতে হয়েছে।
হার্টন বিশ্বাস করেন, এই মহামারীটি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ, এটি স্বাস্থ্য সঙ্কটের চেয়েও অনেক বড় ঘটনা। তিনি বলেন, কভিড-১৯ আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। আমাদের দেখতে বাধ্য করেছে যে সত্যই কে দুর্বল, সমাজ নির্মাণে সত্যই কে কাজ করে, বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাড়িতে অলস বসে থাকালেও আক্ষরিক অর্থেই কারা ঝুঁকি সত্ত্বেও নিজের জীবনকে রেললাইনের উপর ছুঁড়ে দিয়েছেন।
হার্টন বলেন, মহামারীর কারণে আমরা নিজের সম্পর্কে এমন কিছু আবিষ্কার করেছি, যা আগে সহজেই আমরা আড়াল করতে সক্ষম হয়েছি, তবে আমরা এখন আর আড়াল করতে পারি না। সুতরাং প্রশ্নটি হলো, আমরা এখন সেই জ্ঞান দিয়ে কী করবো?
যদিও তার কাছে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, কভিড-১৯ আমাদের যে ‘নৈতিক উদ্দীপনা’ দিচ্ছে কোনোভাবেই তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
(দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.