‘পরিযায়ী’ শব্দার্থ বিভ্রান্তি এবং প্ররোচনামূলক শ্রমিক দরদ !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
ধরা যাক এই করোনা-আমফান-পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যার আবহ মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেরেক ও’ব্রায়ান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মানস ভুঁইঞ্যা এবং অর্থমন্ত্রী মহুয়া মৈত্র। তাহলেও উল্লেখিত বিষয়ে আমি এখন যা লিখতে যাচ্ছি হুবহু তাই লিখতাম। অবশ্য এটাও হতে পারতো--এঁরা এইসব পদে থাকাকালীন গোটা বিশ্বে করোনার তীব্র প্রকোপ থাকলেও ভারতে করোনা ঢুকতো না--আমফান অনেকটা পূর্বদিক ঘেঁষে বাংলাদেশকে ধাক্কা দিয়ে মায়ানমারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেত এবং করোনা ভারতে না ঢুকলে ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের দুর্দশা দেখে বিচলিত হওয়ার ‘সুযোগ’-ই পেতাম না ! যাইহোক, প্রথমেই ‘পরিযায়ী’ শব্দার্থ বিভ্রান্তি নিয়ে দু’চার কথা বলতেই হচ্ছে। আমি ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি--কেউ কেউ ‘পরিযায়ী’ শব্দটিকে ‘অবমাননাকর’ ‘কলঙ্কজনক’ ‘হেয়ব্যঞ্জক’ একটি অপশব্দ বলে চিহ্নিত করছেন ! কিন্তু কিসের ভিত্তিতে কোন্ আভিধানিক ব্যাখ্যা অবলম্বনে তাঁরা পরিযায়ী শব্দটির অর্থ নির্ণয় করছেন তা কিন্তু বলছেন না। বলা সম্ভবও নয়--কারণ এই শব্দটি বাংলায় বহুল প্রচলিত ছিল না--খুব প্রাচীন শব্দও নয়--একটি ইংরেজি শব্দের (Migratory)
আধুনিক বাংলা রূপান্তর এই ‘পরিযায়ী’ শব্দটি। রাজশেখর বসুর বিখ্যাত বাংলা অভিধান ‘চলন্তিকা’ কিংবা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর মধ্যেও এই শব্দটি নেই। সাহেবরা Migratory
বলতে তাদের বুঝিয়েছেন যারা ঘন ঘন স্থান বদল করে থাকেন--স্থায়ীভাবে কোথাও বসবাস করেন না (সুতরাং প্রবাসী নন)। ঘন ঘন স্থান বদলের পিছনে যে উদ্দেশ্যটা কাজ করে সেটা হল খাদ্যান্বেষণ বা অর্থোপার্জন। যাদের শ্রমের কোনো স্থায়ীত্ব থাকে না--যারা দালালদের আড়কাঠিতে নিজেদের পা গলিয়ে দিয়ে অস্থায়ী শ্রমিকের কাজে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে বিভিন্ন রাজ্যে যাতায়াত করেন--আমাদের দেশে তাদের ‘মাইগ্রেটরি’ বা ‘পরিযায়ী’ শ্রমিক বলে। এর মধ্যে অবমাননাকর যে বৃত্তটি তৈরি হয় তার কারিগর কিন্তু শ্রমিকরা নন--তারা যে রাজ্যের বাসিন্দা সেই রাজ্যসরকারই। ‘প্রবাসী’ শব্দটি যদি অবমাননাকর না হয় ‘অভিবাসী’ শব্দটি যদি অপমানজনক না হয় তাহলে কোন্ আভিধানিক ব্যাখ্যায় ‘পরিযায়ী’ শব্দটি অবমাননাকর হচ্ছে সেটা বিদগ্ধ জনেরা আশা করি বোঝানোর দায়িত্ব নেবেন। ‘পরিযায়ী’ পাখিদের সঙ্গে এদেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের খুব মিল লক্ষ্য করা যায়। দেশ থেকে দেশান্তরে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায় খাদ্যের সন্ধানে। উদ্দেশ্য মিটে যাওয়ার পর তারা আবার নিজের নিজের কোটরে ফিরে যায়। এরা মুক্ত বিহঙ্গ--এদের পরিযায়ী জীবনবৃত্তের মধ্যে কোনো আইন-কানুন বৈধ-অবৈধতার আঁকিবুকি নেই। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনবৃত্তের মধ্যে এ সবই আছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্ম দেয় রাজ্যসরকারগুলোই। নিজের নিজের রাজ্যে বেকারত্বের কর্মহীনতার যন্ত্রণার সঙ্গে যখন কিছুতেই মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না তখন ভিনরাজ্যে কাজের হাতছানিতে আকৃষ্ট হতেই হয়। ছোট ছোট নির্মাণ সংস্থা, ছোট ছোট হোটেল রেঁস্তোরা, সোনা-রূপোর কারখানা ছাড়াও ক্ষেত-খামারেও চুক্তির ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পেলেই যারা ছুটে যায় তাদের ‘মাইগ্রেটরি লেবার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিগত সেন্সাসেও এ রাজ্যের ‘মাইগ্রেটরি লেবার’-এর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের রাজ্যসরকারের গোচরে তা ছিল না। ছিল না,
কারণ এইসব চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্যে কোনো রাজ্যেরই কোনোরকম দায়বদ্ধতা ছিল না। প্রতি বছরে এই মাইগ্রেটরি লেবার--অর্থাৎ পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে তারও কোনো রেকর্ড রাজ্যসরকারের খাতায় নেই। কোনো রাজ্যেই এই সব চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কোনো সুস্পষ্ট ছবি রাজ্য মহাফেজ খানায় জমা পড়ে না। প্রকৃত ছবিটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো আকস্মিকভাবেই চোখের সামনে উঠে এল করোনার কৃপায় ! পরিযায়ী শ্রমিকের সৃষ্টিকর্তারাই তাই রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়লেন--আঙুল তুললেন কেন্দ্রের দিকে। রাজ্যগুলো থেকে যে প্রতি বছর লাখে লাখে কর্মহীন শ্রমিকরা অন্য রাজ্যে ছুটে যাচ্ছেন রোজগারের আশায় সে সম্পর্কে কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু কেন্দ্রকে তারা পাঠান না। পাঠালে নিজেদের উচ্চমার্গীয় ‘ইগো’
আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোন্ রাজ্যে কতজন শ্রমিক যাচ্ছে বা আসছে তার সঠিক সংখ্যা রাজ্যের হাতেই নেই--কেন্দ্রকে তারা কি দেবে?
এইসব শ্রমিকদের জন্যে সরকারি শ্রমআইনের নজর নেই--শ্রমিক স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বেতন-মজুরি সুরক্ষারও কোনো দায়দায়িত্ব সরকারগুলো পালন করে নি। ফলে সঙ্কটকালের দুঃসময়ে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়তে হয়েছে এইসব পরিযায়ী শ্রমিকদেরই। বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে--এখন যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকতেন ডেরেক ও’ব্রায়ান তাহলে তিনি কি করতেন? গোটা পৃথিবী যখন এক অপরিচিত ভয়ঙ্কর শত্রুকে ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণা করে চলেছে তখন তিনি আরও দু’সপ্তাহ সময় নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন? কিন্তু কিসের ভিত্তিতে কোন্ অঙ্ক সামনে রেখে তিনি তা করতেন? কোন্ রাজ্যে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন সে খবর যখন রাজ্যগুলিই রাখে না--এ সংক্রান্ত স্পষ্ট কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান যখন রাজ্যগুলোই কখনো পাঠায় নি তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেইসব তথ্যাদি সংগ্রহের আনুষ্ঠানিক দীর্ঘসূত্রীতার পথ পরিক্রমার পর লকডাউন ঘোষণা করতেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ মানস ভূঁইঞ্যা কি সেই দীর্ঘসূত্রীতার সরকারি আনুষ্ঠানিকতার সময়ে চোখ বুঁজে বসে থাকতেন? অর্থমন্ত্রী মহুয়া মৈত্র প্রকৃত পরিস্থিতি সম্যক না বুঝেই ভারতের লক্ষ লক্ষ ক্লাব সংগঠনগুলিকে হাজার হাজার কোটি অনুদান দিয়ে মাঠে নামাতেন? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের হাতে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তুলে দিতেন? কেন দিতেন-কি করেই বা দিতেন তা ভেবে দেখার জন্যে একটু হোমওয়ার্কেরও প্রয়োজন মনে করতেন না?
আমার বিশ্বাস--তিনি সরকারের কি করা উচিত না উচিত সে সম্পর্কে যেসব দিশা দেখিয়ে থাকেন সেই পথই তিনি অনুসরণ করতেন--সীতারমণ যা করেছেন তিনি তা করতেন না। সীতারমণ রাজ্যগুলির হাতে ১১ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা যাতে রাজ্যসরকারগুলো করে তার নির্দেশ সহ। রাজ্যসরকারগুলো তা করে নি--কেন্দ্রের কি উচিত ছিল না গোটা দেশে জাপানের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশবাসীর স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার দায়িত্বটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া? যদি কেন্দ্র তা করতো তাহলে রাজ্যসরকারগুলো তা মেনে নিত?
দেশের ফেডারেলস্ট্রাকচার স্বৈরাচারী কেন্দ্র ধ্বংস করছে বলে বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলো হৈ-হৈ করে রাস্তায় নেমে পড়তো না?
পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থার দায়িত্ব পুরোপুরি রাজ্য প্রশাসনের--তাদের নিরাপত্তা তাদের নিরাপদে নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে আনা বা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও রাজ্য প্রশাসনের--সেখানে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। একটা রাজ্য ইচ্ছে করলে ২৪ ঘন্টার নোটিশে সবকিছু চালু করতেও পারে আবার বন্ধও করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রসরকার তা পারে না। কয়েক ঘন্টার নোটিশে আন্তর্জাতিক পরিবহণ--অন্তর্দেশীয় পরিবহণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবু করোনা’র ভয়াবহতার সামনে দাঁড়িয়ে লকডাউনকে কার্য্যকরী করার লক্ষ্যে দেশের পরিবহণ ব্যবস্থাকে স্তব্ধ করতে হয়েছে। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যে কেন্দ্রের নির্দেশমতো যে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল রাজ্যগুলো তা করে নি--দু’চারটে রাজ্য ছাড়া। ফলে চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায় রাজ্যগুলোরই সৃষ্টি বিপুল পরিমাণের পরিযায়ী শ্রমিকরা। বিশ্বইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে এই পরিযায়ী শ্রমিক ইতিবৃত্ত ! পরিযায়ী শ্রমিকদের আনা নেওয়ার জন্যে রেলমন্ত্রক ১ মে থেকে রাজ্যের দাবির ভিত্তিতে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে সিংহভাগ রাজ্য দ্রুত পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে দিল। ছোট্ট রাজ্য ঝাড়খণ্ডও কুড়ি-বাইশটি ট্রেনের ব্যবস্থা করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিয়ে এল। আমাদের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত নোডাল অফিসার মাত্র দুটি ট্রেনের সাহায্যে আজমেঢ়-হায়দ্রাবাদ থেকে ‘‘বিশেষ দুধেল তীর্থযাত্রী’’দের ফিরিয়ে এনেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন ! ১ মে থেকে দেশে--বিশেষ করে মহারাষ্ট্র-গুজরাট-রাজস্থান-তামিলনাড়ু-কর্ণাটক-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড় ইত্যাদি রাজ্যে হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছিল করোনা সংক্রমণ। হটস্পট হয়ে যাচ্ছিল বেশ কিছু রাজ্য--আমাদের পরিযায়ী শ্রমিকরা চরম দুর্দশার মধ্যে আতঙ্কের মধ্যে ছটফট করছিলেন তখনও। শেষপর্যন্ত কেন্দ্র ও হটস্পট রাজ্যগুলো বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে ঝাঁকে ঝাঁকে শ্রমিকদের এ রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া শুরু করে দিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই অসংখ্য করোনা আক্রান্ত শ্রমিক রাজ্যের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লেন--তারপর তারা কিভাবে কোথায় থাকছেন--গোষ্ঠী সংক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে কি কি ব্যবস্থা হয়েছে বা হচ্ছে তা প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যে চুড়ান্ত অব্যবস্থার ছবিটা প্রকট হচ্ছে তার জন্যে একমাত্র কেন্দ্র দায়ী--এই হাস্যকর মোটা দাগের নাটকীয় সংলাপ মানুষ গিলছে না। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে--তা খোলা চোখেই মানুষ দেখতে পাচ্ছে। ঠিক এই কথাগুলোই আমি লিখতাম যদি আজ মমতা দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতেন ডেরেক ও’ব্রায়ান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকতেন মানস ভুঁইঞ্যা এবং অর্থমন্ত্রী থাকতেন মহুয়া মৈত্র ! কানাগলিতে নিজেদের রাস্তা হারিয়ে ফেলা সীতারাম-সেলিম-সুজন-রাহুল-চিদাম্বরমদের কথাবার্তা নিয়ে বেশি অক্ষর ব্যয় করার কোনো মানে হয় না। কারণ,
স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশকে তাদের ‘‘পারফরমেন্স’’ মানুষ দেখেছে। ক্ষমতার বাইরে থেকে বড় বড় লেকচার দেওয়া এদেশে খুবই সহজ কাজ--এর জন্যে কোনো বোধবুদ্ধিবিবেচনামানবিকতা’র প্রয়োজন হয় না। নিজেদেরই তৈরি চোরাবালির গর্ত থেকেে উঠে আসার জন্যে তারা করতে বা বলতে পারেন না--এমন কিছুই নেই। সুতরাং এইসব কোমরভাঙ্গা জন প্রত্যাখ্যাত নেতা-নেত্রীদের বুকনিতে কান তারাই দেবে যাদের কাছে দেশ বা দেশের মানুষ নয়--স্বার্থান্ধ সঙ্কীর্ণ রাজনীতিটাই বড় !
কোন মন্তব্য নেই