Header Ads

ভ্যাকসিন নিয়ে লড়াই আসন্ন গোটা বিশ্ব জুড়ে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবী। এরই মধ্যে প্রথম ঝড়ের পর দ্বিতীয় ঝড়ের আশঙ্কায় এখন সবাই ভীত। ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম ঝড়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঝড় আরো বেশি ভয়ংকর হবে। এ অবস্থায় মুক্তির একমাত্র উপায় হতে পারে ভ্যাকসিন আবিষ্কার। যা কিনা লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে।

এখন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে অনেকগুলো কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। কিউরভ্যাক বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের একজন ফ্লোরিয়ান ভন ডার মোলবে বলেন, আমরা আমাদের সম্পদের বড় একটি অংশ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য ব্যয় করছি। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের কাছ থেকে তাকে শুনতে হচ্ছে ভ্যাকসিন কবে তৈরি হবে, কারা তৈরি করবে এমন প্রশ্নও।
জার্মান সরকার আশা করছে তারাই ভ্যাকসিন আবিষ্কার করবে এবং তা দিয়ে গোটা পৃথিবীকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এরই মধ্যে তারা এই লক্ষ্যে কিউরভ্যাকে ৩০০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে। যেখানে কোম্পানির ২৩ শতাংশ শেয়ার থাকবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। সরকার বলছে, তারা চাইছে কোম্পানিকে বিদেশ যাওয়া থেকে আটকাতে।
জার্মান সরকার চাইছে কিউরভ্যাক জার্মানিতেই থাকুক, কারণ ভাইরাসের অবস্থান দেশটিতে এখনো উদ্বেগজনক। হয়তো সংক্রমণের সংখ্যা এখন কমছে, কিন্তু চীনে নতুন করে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সবাইকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। লকডাউন শিথিল করার পর জার্মানিতেও নতুন করে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন একমাত্র ভ্যাকসিনই পারে পার্থক্য তৈরি করতে।
কিউরভ্যাকের প্রডাকশন ম্যানেজার মোলবে জানান, দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা তাকে ফোনে ব্যয় করতে হয় তদারকি কর্তৃপক্ষ ও সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে দরকষাকষির জন্য। ক্লায়েন্টরাই আবার তার একমাত্র সমস্যা নয়। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মতো কিউরভ্যাককেও এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করার হুমকিতে পড়তে হচ্ছে। এর মাঝে যে মিনি শিশিগুলোতে ভ্যাকসিন রাখা হয় বিশ্বজুড়ে চাহিদার কারণে তার সংকটও দেখা দিয়েছে। বিশেষত এর সাপ্লাইয়ার বেশ সীমিত হওয়ার কারণে। তবে এটাই একমাত্র সংকট নয়। হাইপোডারমিক সুচেরও বেশ স্বল্পতা রয়েছে।
মূলত ভ্যাকসিনের আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে ভ্যাকসিনকে বিস্তৃতভাবে উপলব্ধ করানোর একটা উপায়। এর সঙ্গে উৎপাদন, বিপণন ও পরিমাণের বিষয়ও জড়িত আছে। যা খুবই জটিল বিষয় কিন্তু এগুলো সব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
যখন কভিড-১৯ ভাইরাসের এক বা একাধিক ভ্যাকসিন অনুমোদন পাবে, তখন বিশ্বব্যাপী এর ৬ বিলিয়ন ডোজের প্রয়োজন হবে। আবার ইমিউনিটি বুস্ট করার জন্য দ্বিগুণেরও বেশি প্রয়োজন হতে পারে।
অবশ্য এটা ভেবে হতাশ হওয়ার দরকার নেই যে দ্রুত এ চাহিদা অর্জন সম্ভব হবে না। হয়তো এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিতরণ সম্ভব।
তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর পরবর্তী কাজগুলোও বেশ চ্যালেঞ্জিং। কে আগে পাবে? সিদ্ধান্ত কে নেবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আবার জীবন-মৃত্যুর বিষয় জড়িত। এর সঙ্গে অবশ্য রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতির বিষয়টিও সমানভাবে সম্পর্কিত।
এখানে আমেরিকান বায়োটেক পথিকৃৎ মডার্নার রহস্যজনক উত্থানের ঘটনা দিয়ে সমস্যাটি যথাযথভাবে বোঝা যাবে। প্রায় ১০ বছরের মধ্যে কোম্পানিটি নতুন কোনো ভ্যাকসিন উৎপাদন করেনি। কিন্তু এখন স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির মূল্য ২৩ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি কোম্পানিটি যখন ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রাথমিক সফলতার কথা জানায়, তখন তাদের শেয়ারদরও বাড়তে শুরু করে। এটি বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিরও নির্ধারক হয়ে উঠছে।
সবার আগে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মাল্টিবিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়ে দৌড়ে নেমেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুজনই ভালোভাবে জানেন যে যারাই আগে ভ্যাকসিন তৈরি করে এ সংকট থেকে বের হওয়ার পথ বের করতে পারবে, তারাই আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে সামনে আসবে। এটা মূলত দুই পরাশক্তির জন্য প্রযুক্তিগত সম্মানের ব্যাপারও বটে। রাজনৈতিক চাপ তৈরির ক্ষেত্রেও এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। যেমন তেলের রাজনীতি। এই ভ্যাকসিন দিয়েই মূলত নতুন ও পুরনো জোটগুলোর মাঝে ভাঙাগড়া চলবে।
ট্রাম্পও ভালোভাবে জানেন ভ্যাকসিন যুদ্ধের জন্য তাদের শক্তিশালী ব্যাটালিয়ন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সেরা সব ল্যাবরেটরি ও শক্তিশালী ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিগুলো আছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে করোনাভাইরাসকে হারানোর কাজ যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে করতে পারবে না। এজন্য তাদের চীনকে প্রয়োজন হবে। কারণ ফার্মা যতই বড় হোক না কেন, উৎপাদনের জন্য যে কাঁচামাল প্রয়োজন তার প্রধান প্রস্তুতকারক চীন ও ভারত। গত দশকে সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল তারাই উৎপাদন করেছে।
করোনাভাইরাসের এই সংকট এখন চীনকে সুযোগ করে দিয়েছে বায়োটেক সেক্টরে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়ার। চীনে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নেই যারা উদ্ভাবনী শক্তির কারণে বিশ্বময় পরিচিত। তবে সার্স-কোভ-২ হয়তো সেটা বদলে দিতে পারে।
ভ্যাকসিনের ঘাটতির কারণে এর বিপণনের স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যে সংকট আসন্ন সে সম্পর্কে কোনো রাজনীতিবিদ, কোনো সমাজ, কোন রাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রস্তুত নয়।
তবে এটা ধরে নেয়া নিরাপদ যে এক্ষেত্রে শক্তিশালী, ধনী ও স্বার্থপররা আধিপত্য বজায় রাখবে। যদি না যারা সফলতার সঙ্গে জড়িত তারা নিয়ম ঠিক করে যে কারা, কখন এবং কেন ভ্যাকসিন উপলব্ধ হবে। সাড়ে পাঁচ মাস আগেও কেউ এ ভাইরাস সম্পর্কে কিছু জানত না। কিন্তু ১২টির বেশি দেশের হাজারো গবেষক ১৩০টির বেশি ভ্যাকসিন নিয়ে এখন কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় অনেকে মানুষের শরীরে ট্রায়ালও শুরু করেছে। এর আগে বিজ্ঞানী ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিসহ অন্যরা এত দ্রুত এত সফলতা অর্জন করেনি। যদিও এটা এখনো অনিশ্চিত যে কখন ও কীভাবে ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে এবং এই প্রকল্পগুলো আদৌ সফল হবে কিনা। তাছাড়া এই ভ্যাকসিন কতদিনের জন্য ইমিউনিটি দেবে তাও অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে ঘাটতির ঝুঁকিও বাড়বে। যা কিনা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে আরো বাড়িয়ে দেবে।
এছাড়া করোনাভাইরাস যখন আঘাত হেনেছিল তখনো সবাই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভুলে স্বার্থপরতা দেখিয়েছিল। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ার পরও সেটা আরেকবার সামনে আসবে। তবে এবার তা নিয়ন্ত্রণ করবে সম্ভাব্য তিনটি শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কারা জিতবে এবং সর্বসাধারণের জন্য তা কতটা উপলব্ধ হবে, সেটাই দেখার অপেক্ষা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.