Header Ads

বহুস্বরের কথাকার দেবেশ রায় !!

 বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
এই ফেসবুকেই তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। একটু ব্যতিক্রমী দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে দেখা ও তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা খুব সহজ নয়। প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় তা আমার সঙ্গে ছিল না। আমার স্ত্রী ওঁর প্রত্যক্ষ ছাত্রী ছিলেন জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে পড়ার সময়। ঐ একই সময় বিস্মৃত কবি অমিতাভ দাশগুপ্তও ঐ কলেজেরই অধ্যাপক ছিলেন। গানবাজনার সূত্রে ওঁর স্ত্রী কাকলি রায়ের সঙ্গেও আমার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। ফলে ওঁদের সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছিলাম।

আমার সঙ্গে দু’একবার সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা হয়েছিল দু’একটা অনুষ্ঠানের ফাঁকফোকরে। মনে আছে বাংলা আকাদেমির এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দু’চার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল তৎকালীন আকাদেমির সচিব উৎপলের (ঝা) ঘরে। যতটুকু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল তাতে তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তাঁর লেখালেখির সঙ্গে ছাত্রজীবনেই--পরিচয়, নতুন সাহিত্য, উত্তরসুরী সহ আরও কিছু বামমতাদর্শী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার সঙ্গে হয়ে গিয়েছিল। শস্তা চটকদার  লেখা তাঁর কলমে আসতো না।
‘তিস্তাপারের বিত্তান্ত’ যখন মানসভুমিতে ছায়া ফেলেনি তখন তিনি লিখেছিলেন ‘‘মৃত জংশন ও বিপজ্জনক ঘাট’’ নামে প্রন্তিক জনজীবন নিয়ে অসাধরণ একটি  বড় গল্প (নতুন সাহিত্য, ১৩-বর্ষ, কার্তিক-পৌষ, ১৩৬৯)--যার পটভূমি ছিল বার্ণেশ ঘাট থেকে মালবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত প্রান্তিক অঞ্চল--পরবর্তীতে আমার মনে হয়েছিল তিস্তা ও তিস্তাসংলগ্ন জনপদ নিয়ে মহাকাব্যের মতো একটি  উপন্যাস লিখতে পারেন !  কতজন এই বড় গল্পটির খবর রাখেন বা পড়েছেন আমি জানি না--আমি পড়েছিলাম এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম--বুঝতে দেরি হয় নি এক অসম্ভব শক্তিশালী কলম হাতে বাংলাসাহিত্যে পা রেখেছেন দেবেশ রায়। খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই প্রত্যাশা দারুণভাবে পূরণ করার ক্ষেত্রে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিল ‘প্রতিক্ষণ’--যার শুরু থেকে দীর্ঘ বেশ কয়ে বছরের মূল্যবান সংখ্যাগুলো এখনও আমার সংগ্রহে রয়েছে। সামাজিক-রাজনৈতিক এবং বাঙালি ও বাংলার সংস্কৃতি-কৃষ্টি নিয়ে তাঁর অনুভব উপলব্ধি বিশদে প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকাটিতে। সরকারি পদ ও খেতাবের পেছনে তাঁকে কখনো ছুটতে দেখিনি--তাই জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব পর্যন্ত নেতাদের ব্যক্তিগত সমীহ ও শ্রদ্ধার জায়গায় ছিলেন বরাবর। পালাবদলের পালাতেও তাঁকে মোসাহেবের বৃত্তে দেখা যায় নি--দেখা গেলে খুবই খারাপ লাগতো আমার। এমন এক সাহিত্য ব্যক্তিত্বের শূন্যতা খুব সহজে মেটার নয়।
‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’, ‘মানুষ খুন করে কেন’-র মতো উপন্যাসের জনক কিংবদন্তী দেবেশ রায়কেও  চলে যেতে হল শেষপর্যন্ত। বুধবার (১৩ মে) তাঁকে তেঘরিয়া অঞ্চলের ঊমা নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় চিকিৎসকরা তাঁকে ভেন্টিলেশনে নেন। তারপর রাত ১০টা ৫০ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর।
দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন এই সুসাহিত্যিক। ভার্টিগোজনিত সমস্যার কারণে শারীরিক ভারসাম্যের অভাবেও ভুগছিলেন তিনি। বুধবার ডিহাইড্রেশানজনিত সমস্যা নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। দেবেশ রায়ের পুত্র সস্ত্রীক আমেদাবাদের বাসিন্দা। মৃত্যু সংবাদ পেলেও লকডাউন জনিত কারণে দ্রুত কলকাতায় পৌঁছতে পারছেন না।
বাংলা সাহিত্যের এই প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে উত্তরবঙ্গে। সেই সূত্রেই লিখেছিলেন তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো--মানুষ খুন করে কেন (১৯৭৬), মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), লগন গান্ধার (১৯৯৫) ইত্যাদি।
বাংলাসাহিত্যের প্রকৃত ছকভাঙা ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় থেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতির সূত্রেই চষে ফেলেছেন তামাম উত্তরবঙ্গ। শিখেছিলেন রাজবংশী ভাষাও। কলকাতা শহরেও চুটিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করতেন, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল শ্রমিকসমাজের সঙ্গে। ‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’, ‘দুপুর’, ‘পা’, ‘কলকাতা ও গোপাল’, ‘পশ্চাৎভূমি’, ‘ইচ্ছামতী’, ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’, ও ‘উদ্বাস্তু’— এই আটটি গল্প নিয়ে দেবেশ রায়ের প্রথম গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৭৯ সাল থেকে দেবেশ রায় এক দশক ‘পরিচয়’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যযাতি’। তাঁর রাজনৈতিক বীক্ষার ছাপই পড়ে সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’তে। উত্তরবঙ্গের
জন-জীবনের বহমানতা ধরা আছে এই উপন্যাসে। তিনি বাস্তববাদী উপন্যাসের প্রচলিত ছক থেকে সরে গিয়ে বহুস্বরকে নিয়ে আসেন। ১৯৯০ সালে এই উপন্যাসের জন্যেই দেবেশ রায় সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার পান।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.