প্রবাসী বাঙালি ও উনিশের চেতনা
কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য
সময়ের সরণি ধরে ছুটে যাচ্ছে শতাব্দী-- আর আমিও তাকিয়ে আছি অসহায়-- আমার কোনো দেশ নেই-/উনিশের রক্তরাঙা করিডোর ধরে আমরা হেঁটে চলেছি--আমরা মানে উত্তর পূর্ব ভারতের বাংলা ভাষাভাষী প্রবাসী-রা-- আমি আজ ৩৪ বছর ধরে প্রবাসী জীবন যাপন করছি রাষ্ট্রীয় রাজধানী দিল্লি নগরীতে। যমুনার উপর দিয়ে বয়ে গেল কতো জল, কতো ঢেউ--লালকেল্লার পাথর, খিলান ধরে রাখলো কতো ইতিহাসের ইতিকথা--কতো পতাকা উত্তোলন এর মনোরম ছবি। আমি কিন্তু আমার প্রবাসী জীবন ধারাকে এখনো দেখি উনিশের আয়নায়। উনিশ পরবর্তী বরাক উপত্যকায় আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। বর্ণমালা-র 'অ' অক্ষরটি হয়তো আমার লেখাই হতো না--যদি ১৩৬৮ বাংলার ৫ ই জৈষ্ঠ-/১৯৬১ সালের ১৯ শে মে তারিখের সেই ১১ জন শহীদ বর্ণমালার অধিকার অর্জনের জন্য সত্যাগ্ৰহ করতে গিয়ে শহীদের মৃত্যু বরণ না করতেন। আমি প্রবাসী বাঙালি--যখন শিলচর এর কুম্ভীরগ্ৰাম বিমান বন্দরে পৃথিবীর মাটি চুম্বন করে দেখতে পাই--শিলচর বিমান বন্দর-- লেখা অক্ষরগুলো ঝকঝক করছে আমি ফিরে যাই ঊনিশ-এর চেতনায়--ঊনিশের আন্দোলন এর উথাল পাতাল ঢেউ আমার চোখে জল এনে দেয় আজও। আমার ছোট্ট দেড়বছরের মেয়ে ওর প্রথম শিলচর সফরে আমার চোখে জল দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- চোখে জল কেন মা? আস্তে আস্তে ওকে ঊনিশের কাহিনী বলেছি- দিল্লির কনভেন্টে পড়া বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখিয়েছি-- রবীন্দ্রনাথ পড়তে শিখিয়েছি বাংলায়- আর এভাবেই সেই মেয়েটির বোধমালায়, চেতনার অস্তিত্ব এর পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে ঊনিশ এর চেতনা--সুদুর আমেরিকার টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েও সে ২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক উৎসবে ১৯ শে মের রক্তঝরা কাহিনী বিভিন্ন দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেছে।
আজ প্রবাসী বাঙালি হিসেবে আমি এবং আমার মতো অনেকেই সমগ্ৰ আসাম প্রদেশের বাংলাভাষী মানুষের সাথে ঘটে চলা এন আর সি এবং ডিটেনশন ক্যাম্প জনিত ঘটনাবলীর জন্য চিন্তিত, ক্ষুব্ধ ! এতো বছর কেটে গেল ঊনিশের রক্তক্ষরণের জন্য স্বাধীন দেশের কোনো জনপ্রতিনিধি জনতার আদালতে দাঁড়িয়ে, শহীদবেদীর সামনে দাঁড়িয়ে একবারও নতজানু হলেন না--ক্ষমা করো--বললেন না, বললেন না মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ প্রতিটি ভারতবাসীর জন্মগত অধিকার। আমরা সেই সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে পারিনা--ভারতের প্রতিটি ভাষা আমার ভাষা। আমি সব ভাষায় কথা বলতে চাই। কিন্তু আমি আমার মাতৃভাষার অধিকার চাই।
তাই প্রবাসী বাঙালি হয়ে আমি পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই থাকিনা কেন, ঊনিশ আমার নাড়ির টান ঊনিশ আমার চেতনায় ফুটে থাকা টকটকে লাল ইতিহাস-অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যত !
লেখক পরিচয়ঃ লেখকের বড় হয়ে ওঠা অসমের বরাক উপত্যকায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে দিল্লি প্রবাসী।
কোন মন্তব্য নেই