দেশের লক্ষ লক্ষ পরিয়াযী শ্রমিক বিতাড়িত হয়ে ঘরে ফিরল, লকডাউনের পর শিল্পোন্নত রাজ্য মহারাষ্ট্র, গুজরাট প্রভৃতির কল-কারখানার চাকা ঘুরবে?
অমল গুপ্ত, গুয়াহাটি
দেশের শিল্পোন্নত রাজ্য মহারাষ্ট্র, দেশের বাণিজ্যনগরী দেশকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দেয়। সেই রাজ্যের করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২ হাজারের বেশি মৃত্যু হয়েছে। শিল্পোন্নত এই রাজ্যের প্রধান মানব সম্পদ হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ, বিহারের গরিব শ্রমিক, যাদের মুম্বাই নগরীতে থাকার অধিকার বা আর্থিক সামর্থ নেই। কোটি কোটি টাকার শিল্পপতি,
গ্ল্যামার ঝলমলে বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের পাশে কি করেই বা দিন দরিদ্র পরদেশী শ্রমিকদের জায়গা হবে?
দূরে আবর্জনার স্তুপ, ছেঁড়া কাঁথা,
প্লাস্টিকের, বস্তায়, রং চটা ভাঙা চোরা, আলো বাতাসহীন স্যাঁতস্যাঁতে ছোট ছোট কয়েক লক্ষ ঘর,
টিবি, ক্যান্সার, রক্ত হীনতা,
পুষ্টিহীনতা রোগ নিয়ে মুম্বাইয়ের লজ্জা, মুম্বাইয়ের কলঙ্ক এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি ধারাভি। এই বস্তির সম্পদ অন্য রাজ্যের গরিব পরিযায়ী শ্রমিকদের দেহে বেশি সংক্রমণ হয়েছে। শিল্প সম্পদে বলীয়ান মুম্বাই, মহারাষ্ট্রের শিল্পপতি নিজেদের মুনাফা বাড়াতে কালো টাকা বিদেশের ব্যাংকে লুকিয়ে রাখতে বেশি মনোনিবেশ করেছে। কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে বিলাসী জীবন কাটানো ঠকবাজ শিল্পপতিদের জেল হয় না।
কোটি কোটি টাকা ব্যাংক মুকুব করে দেয় আর ৬০ দিন ধরে চরম দুর্দশাগ্রস্থ পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকার ট্রেন, বাস,
লরির ভাড়া তুলছে। সুপ্রিমকোর্টের রায় দানের পরও রাজ্য সরকারগুলো দায়িত্ব পালন করছে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চরম ব্যর্থতার পরিচয় তুলে ধরেছে। ভারতীয় রেল অসুস্থ,
অথর্ব,
প্রতিবন্ধী,
বয়স্কদের, শিশুদের আস্থার বাহণ ছিল। আজ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে জানিয়ে দিল, বয়স্ক,
শিশু ও অসুস্থদের রেলে সফর না করাই ভালো। রেলের সেবা, খাদ্যের গুণাগুণ নিয়ে যত কম বলা হবে ততই ভাল। এপর্যন্ত ৯ জন রেলে সফরের সময় অভুক্ত থেকে,
তৃষ্ণার্ত থেকে মারা গেছে। দেশের মানবাধিকার কমিশন রেল কর্তৃপক্ষকে শোকজ করেছে। তাতে পরিস্থিতির কি কিছু উন্নতি হবে? মনে হয় না। মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে যখন দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হল মার্চ মাসে,
তখন থেকে অস্থায়ী বা ঠিকাভিত্তিক চাকরি থেকে, ভাড়া ঘর থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ পরিয়াযী শ্রমিক পথে নেমেছে। মৃত্যু মিছিল তো চলছেই। চারদফা লকডাউনের ঘোষণা হবে কাল রবিবার। তারপর ও মৃত্যু মিছিল চলবে। কারণ রেল কর্তৃপক্ষ শ্রমিক স্পেশালগুলোকেই অগ্রাধিকার না দিয়ে ঘুর পথে,
মাঝে মাঝে বসিয়ে রেখে চালাচ্ছে বলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গুরুতর অভিযোগ করেছে। তাই শ্রমিক স্পেশাল বিহারের মজফরপুর রেলওয়ে স্টেশনে হৃদয়বিদারক ঘটনার মত আরও কিছু ঘটনা উপহার দেওয়ার পর হয়তো যাত্রা শেষ হবে। প্ল্যাটফর্মে মাকে জাগানোর চেষ্টা করছে এক শিশু, তার কাপড় ধরে টানছে। একরত্তি শিশুটি জানেনা তার শ্রমিক মা ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা গেছে। শিল্পোন্নত রাজ্য মহারাষ্ট্র, চেন্নাই, গুজরাট সহ বিভিন্ন রাজ্যের
পরদেশী শ্রমিকরা লকডাউনের পর স্থানীয় সরকার থেকে বিন্দুমাত্র সহায়তা না পেয়ে বিনা বেতনে, বিনা পারিশ্রমিকে টাকা-পয়সা ধার দেনা করে যানবাহনের ভাড়া দিয়ে অনেক কষ্টে তাদের ঘরে ফিরেছে।
তারপর কি হবে? মুম্বাই, মহারাষ্ট্রের,
গুজরাট কি করবে?
মুম্বাইয়ের ধারাভি খালি
করে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের গরিব শ্রমিকরা
তো চলে গেছে। কারখানার চাকা
ঘুরবে কি করে? একমাত্র বামপন্থী রাজ্য কেরল ও ওড়িশার শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে ধরে রেখেছে। কেরালার খাবার পছন্দ নয়
হিন্দিভাষী বিহার, উত্তরপ্রদেশের। তাই কেরালের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে শৈলজা জানিয়েছেন সরকার ইডলি, ধোসার বদলে অড়হর, বুটের ডাল, রুটি এবং ছাতুর ব্যবস্থা করেছে যাতে বিহারী
শ্রমিকদের ধরে রাখা যায়। দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা কত?
তা কেন্দ্র সরকার বা রাজ্য সরকারগুলো জানে না। একবার বলা হয়েছে ৫ কোটি, আরেকবার বলা হয়েছে ৮ কোটি। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান
ইকোনমি নামে এক সন্থা জানিয়েছে, গত
এপ্রিল মাসে দেশে ১২ কোটি ২০ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। ৮০ শতাংশ পরিবারের রোজগার কমে
গেছে।
৭০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি পেনশন প্রভৃতি নিয়ে কোন ব্যবস্থাই হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ইন্টার স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ১৯৭৯ সালের এক মান্ধাতা আমলের এক আইন আছে। তা মাত্র কয়েকজন শ্রমিকের জন্য। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কথা নেই। তাই সুবিধা দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না।
প্রশ্ন এই তো কিছুদিন আগে কেন্দ্র শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বৃদ্ধি সহ বেশ কিছু নিয়ম-কানুন করলো তখন কি ৪০ বছর আগের পরিয়াযী শ্রমিকদের আইনটি পরিবর্তনের কথা মনে
পড়লো না? আইনটি থাকা সত্তেও লক্ষ লক্ষ পরিয়াযী
শ্রমিক দেশের কল-কারখানাগুলো থেকে বিতাড়িত হয়ে ঘর
বাড়িতে সর্বশান্ত হয়ে ফিরে এলো। তারা তো কিছু অর্থ পেতো?
কোন মন্তব্য নেই