Header Ads

কুযুক্তির আশ্রয়ে শ্মশান যাত্রার এই আত্মঘাতী আয়োজন কেন বোঝা দুষ্কর হয়ে উঠছে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়


প্রথমেই আমি যে বিশেষ একটি কারণে রীতিমতো বিস্মিত বোধ করছি সেই কারণটা নিয়ে দু-চার কথা না বললে আমার মতো অনেকেরই বিমূঢ় অবস্থাটা ঠিক কাটিয়ে ওঠা যাবে নাসকলেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন রাজ্যের কোনও নির্বাচিত বিরোধী জনপ্রতিনিধিকে রাজ্য সরকারের পুলিশ-প্রশাসন রাস্তায় প্রায় নামতেই দিচ্ছে নামানুষের ধারে কাছে--সে করোনা পীড়িত হোক বা আমফান দুর্গত--যেতে দেওয়া হচ্ছে নাএমপি-বিধায়ক বা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী--কাউকেই রাস্তায় নামতে দেওয়া হচ্ছে না--বিরাট বিরাট পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাঁদের ঘিরে ফেলা হচ্ছে--বাধ্য করা হচ্ছে নিজের নিজের ডেরায় ফিরে যেতেঘর থেকে যাতে এক পা বেরুতে না পারেন তাঁরা তার জন্যে অনেকের হাতেই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ! এতে কিন্তু যারপরনাই রাজনৈতিক লাভ হচ্ছে বিরোধী দল--বিশেষ করে বিজেপিতাঁরা জনসমক্ষে প্রমাণ রাখতে পারছেন যে, তাঁরা দুর্গত মানুষদের ত্রাণ দিতে চাইলেও রাজ্যসরকারের বাধায় তা দিতে পারছেন নাএইসব ক্ষেত্রে ত্রাণবঞ্চিত মানুষ ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে যাচ্ছেপাশাপাশি নির্বাচিত বিজেপি জনপ্রতিনিধিদের মানুষের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে না--করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে তাঁদের সযত্নে বাঁচিয়ে চলেছে রাজ্য প্রশাসনই ! তাঁরা বাড়িতে অত্যন্ত নিরাপদ ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে রাজ্যসরকার তথা ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের গণতন্ত্রবিরোধী আচরণকে অত্যন্ত অমানবিক আচরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারছেনআমরা যারা সাধারণ মানুষ এবং তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের মতো প্রগাঢ় রাজনৈতিক মেধার অধিকারী নই তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না--তৃণমূল সরকার বিজেপি জনপ্রতিনিধিদের ভাবে প্রোটেকশনকেন দিচ্ছেন--আসল রহস্যটা কি? তৃণমূলের মন্ত্রী সপরিবারে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন--বিধায়ক ভেন্টিলেশনে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন, প্রচুর পুলিশ, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন--প্রবল মানসিক শারীরিক চাপে বিপর্যস্ত পুলিশের মধ্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটছে একাধিকবার এবং এইসব পরিস্থিতি যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে--Covid-19-এর Intensity কোথায় গিয়ে পৌঁছিয়েছে ঠিক তখনই প্রথম থেকেই ছেলেখেলার লকডাউনকে নানান কুযুক্তির আশ্রয়ে একেবারে অর্থহীন করে তোলার উদ্দেশ্যটা যেভাবেই হোক মানবিকবলে তুলে ধরার চেষ্টা করা হোক না কেন সেটা আদৌ মানবিক নয়--১০০% রাজনৈতিক
প্রথম ২১ দিনের লকডাউনের সূচনাপর্ব থেকেই দেখা গেছে পথে-ঘাটে হাটে-বাজারে অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া অঢেল ছুটি উপভোগে মত্ত লোকজনের কী বিপুল উন্মাদনা ! বেপরোয়া নাচানাচি দেখে বিশ্বাস করার কোনও উপায় ছিল না করোনা ভাইরাস সম্পর্কে রাজ্যের মানুষকে বিন্দুমাত্র সচেতন করতে পেরেছে রাজ্য সরকারগাদা গাদা গালভরা কমিটি--কমিটির গ্লোবালাইজেশন--বড় বড় বিশেষজ্ঞদের বড় বড় মাথা--দৃপ্ত ভাষণ--কথায় কথায়--নো প্রবলেম, ভয় পাবেন না আপনারা, সব ঠিক আছে--ম্যায় হুঁ না ! এইভাবে বিধিভাঙ্গার বিধি নিয়মে যখন লকডাউন প্রহসনে পরিণত হয়ে গেছে--তখন প্রশাসনের অন্দরে ভয়ভীতিও যে উধাও হয়ে যাবে সেটা বোঝাতেই রাজনৈতিক মানবিকতাপ্রদর্শনের জোয়ার উঠে গেলখুলে দেওয়া হল বাঙালির হাঁ-মুখে রসগোল্লা ঠুসে দেওয়ার জন্যে মিষ্টির দোকান, মন্দির-মসজিদ বন্ধ থাকলেও পুষ্পবিলাসী বাঙালির মনোবেদনা ঘোচাতে তড়িঘড়ি খুলে দেওয়া হল পুষ্পবাজার ! এরই পাশাপাশি চলতে থাকলো করোনা আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা নিয়ে আশ্চর্য্য ইন্দ্রজালের খেলা-লীলা ! রাজ্যের মানুষ ভাবলো রাজ্যে পা রাখতে দৈত্য দানো এমন কী ভগবানকেও যখন দশবার ভাবতে হয় তখন করোনার হিম্মত হবে কেন রাজ্যে দাপট দেখানোর ! একের পর এক পিলে চমকানো সিদ্ধান্ত ফুলঝুরির মতো প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়তে লাগল টিভিতে সংবাদপত্রে--সব ক্যামেরার ফোকাসের গতিমুখ একমুখী হয়ে গেল স্বাভাবিক কারণেই আনাচে কানাচে প্রশ্ন উঠে গেল--পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা সমাধানের জন্যে নিযুক্ত নোডাল অফিসার এতদিন কি করছিলেন? ঝাড়খণ্ডের মতো একটা ছোট্ট রাজ্য সহ উড়িষ্যা-কেরল-কর্ণাটক-বিহার-উত্তরপ্রদেশ সহ প্রায় সব রাজ্যই যখন তাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিচ্ছে--ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করছে তখন রাজ্যের নোডাল অফিসার কি করছিলেন? যে সব রাজ্য থেকে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার কথা তারা কিভাবে ফিরবেন--ফেরার ট্রেনে তারা খাবার পাবেন কিনা--ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আইসোলেট করে গোষ্ঠী সংক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে কিভাবে রক্ষা করা যাবে তার পরিকল্পনা তৈরি করে পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন--এমন তথ্য প্রমাণ কিন্তু নেইএঁরা কি ভেবেছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা অনন্তকাল চরম দুর্দশার মধ্যে ভিনরাজ্যে পড়ে থাকবেন--করোনা আক্রান্ত হয়ে (বিশেষ করে হটস্পট রাজ্যগুলোতে) বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাবেন--নাকি ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টায় পথেঘাটে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাবেন? এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজের নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের মতো আর একটি রাজ্যও দায়িত্ব এড়ানোর মরিয়া চেষ্টায় অদ্ভূত ধরণের অভিযোগ তুলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নিএই বিষয়ে রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতা ঢেকে রাখার মতো কোনো বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য যুক্তি নেইসবটাই মানুষ জেনে গেছে যে সব সূত্র থেকে যা জানার নিয়ে আমি আগেও বলেছি--এখন আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না আমরা কেউ জানি না--আমরা কে কোথায় থাকব--সামনে শুধুই অন্ধকার--আলোর ছিটেফোঁটাও নেইএইরকম একটা মুহূর্তে আমরা আশা করেছিলাম রাজ্য সরকার সঙ্কীর্ণ রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে একটু হলেও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেবেদিলেন না--তাই ভীষণভাবে হতাশ হতে হল বৈকি ! পরিযায়ী শ্রমিকরা গাদাগাদি করে (ভিডিও অবশ্য ততটা বলছে না) এতদূর পথ জার্নি করে আসছে দেখে মুখ্যমন্ত্রীর মনে হঠাৎ এই যুক্তি তৈরি হয়ে গেল--তাহলে মন্দির-মসজিদ-চার্চ-গুরুদ্বার বন্ধ থাকবে কেন? অতএব খুলে দেওয়া হোক! জুট মিল চা বাগান খুলে দেওয়া হোক--সরকারি-বেসরকারি অফিসও খুলে দেওয়া হোকবাসে যতগুলো সীট থাকবে ততজন যাত্রী উঠতে পারবেন--ডিসট্যান্স মানার জন্যে মাঝে এক ইঞ্চি ফাঁক না থকলেও চলবে ! দোকান-বাজার-হাট-চায়ের দোকান-চপের দোকান-সেলুন-পার্লার সব খোলা থাকবে জুন থেকে ফের যদি লকডাউন ঘোষিত হয়--তবুও? গোটা রাজ্যে হু-হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা--কিছুতেই চেপে রাখা যাচ্ছে না--পরিযায়ী শ্রমিকরাও সংক্রমণ নিয়ে আসছেন ব্যাপক হারেচেইন সিস্টেমে তা কী ভাবে কতটা ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং তার ভয়াবহতা কতদূর হতে পারে সেটা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভাবতে গিয়ে শিউড়ে উঠছেনট্রেস-টেস্ট এবং আইসোলেশন প্রক্রিয়াতেই যখন সরকারের সর্বশক্তি নিয়োগের কথা তখনই করোনাকে কোলবালিশ করে শুয়ে থাকার পরামর্শ আসছে শীর্ষ মহল থেকে ! কিন্তু সেই কোলবালিশই যখন ঘরে ঘরে কান্নার রোল তুলবে তখন রাশি রাশি অভিসম্পাত ছাড়া সেইসব ঘরের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-বৃদ্ধ মা-বাবাদের পক্ষ থেকে আর কিছু ছুটে আসবে নাফলাফল কি দাঁড়াবে সেটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়সুতরাং পরিস্থতি কী হতে চলেছে তা নিয়ে একটুও অস্পষ্টতা নেই
ঠিকই--লকডাউন দীর্ঘকাল চলতে পারে নাকিন্তু করোনার এই ভয়ঙ্কর উর্দ্ধমুখী প্রবণতা ঠেকাতে আরও কিছুদিনের জন্যে হলেও কঠোর লকডাউনের প্রয়োজনের কথা ভাবাটা জরুরি ছিলরাজনৈতিক মানবিকতা প্রচারবাজির চেয়ে মানুষের জীবনের দাম অনেক বেশি--এটা যখন হাড়ে হাড়ে টের পেতে হবে তখন আর কিছুই করার থাকবে না--অনেক অনেক দেরি হয়ে যাবে !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.