Header Ads

করোনা-ই কেড়ে নিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। যার ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুক্রবার (১৫ মে) সরকারি ব্যবস্থাপনায় তার দাফন সম্পন্ন হবে।
আজ বৃহস্পতিবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন তার ছেলে আনন্দ জামান। তিনি বলেন, আব্বার করোনাভাইরাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার দাফন সম্পন্ন করা হবে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করা হবে না।

বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার উন্মেষের দলিল রচিত হয়েছিল ১৫ বছরের যে কিশোরের হাত ধরে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জাতির এগিয়ে চলার পরতে পরতে ছাপ রাখার পর চূড়ান্ত বিকাশের দলিলও লিপিবদ্ধ হয়েছে তার হাতের ছোঁয়ায়।
অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে বাঙালিকে ঋদ্ধ করে যাওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পথ চলা শেষ হল নজিরবিহীন এক সংকটের কালে। কোভিড-১৯ নামের এক রোগের প্রকোপে যখন ধুঁকছে জাতি, সেই সময় চিরবিদায় নিলেন বরেণ্য এই লেখক-অধ্যাপক। আর মৃত্যুর পর নমুনা পরীক্ষায় তারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে !
বাংলার অধ্যাপকের পরিচয় ছাপিয়ে সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সংকটকালে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের জন্য অনন্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অনেকের চোখে তিনি ছিলেন ‘জাতির বিবেক’।
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনিসুজ্জামানের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা সংস্করণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার আনিসুজ্জামান ছিলেন ১৯৯১ সালে গঠিত গণআদালতে অভিযোগকারীদের একজন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক ছাড়াও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিপুল কাজ করে যাওয়া এই অধ্যাপককে পদ্মভূষণ পদক দিয়ে সম্মান জানিয়েছে ভারত
সরকারও !
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। শৈশবেই সাহিত্য-ভাবনামুখর এক পরিবেশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বেড়ে ওঠেন। তার বাবা ডা. এ টি এম মোয়াজ্জম ও মা সৈয়দা খাতুন। পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে আনিসুজ্জামান ছিলেন তিন বোনের ছোট। বাবা ছিলেন পেশায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এবং মা গৃহিণী। বাবা চিকিৎসক ও মা গৃহিণী হলেও দুজনেরই ছিল লেখালেখির অভ্যাস। তাঁর পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শৈশব এবং শিক্ষাজীবনের প্রথম ভাগ কাটে কলকাতায়। কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর দেশভাগের সময় বাংলাদেশের খুলনা জেলায় চলে আসে তার পুরো পরিবার।
খুলনা জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পরবর্তী সময়ে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন আনিসুজ্জামান। জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন তিনি, দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান ছিল তার।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা এবং মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ দেখা যায় ছোটবেলাতেই। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন উত্তাল পূর্ব বাংলা, সেই সময় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন আনিসুজ্জামান।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঠিক করা হয়, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য, সচেতন করার জন্য একটা পুস্তিকা প্রকাশিত হবে। প্রথমে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিপ্লবী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার ওপর। কিন্তু তিনি সময়ের অভাবে লিখতে পারেননি। তখন তা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় কিশোর আনিসুজ্জামানকে। ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ শিরোনামে সেই পুস্তিকা লিখেছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর এটাই ছিল প্রথম পুস্তিকা।
১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধচারণ করে যে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ততোদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির প্রথম গবেষণা বৃত্তি পেয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শূন্যতায় বাংলা একাডেমির বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
১৯৫৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন।
এর মাঝে ১৯৬৫ সালে ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল' বিষয়ে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৭ সালে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার। এর প্রতিবাদে বিবৃতিতে বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে তিনিও পুরোপুরি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সেখানে তিনি প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন আনিসুজ্জামান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনিসুজ্জামানের ডাক পড়ে দেশের সংবিধান তৈরির কাজে। সংবিধানের ইংরেজি খসড়া তৈরি হয় কামাল হোসেনের নেতৃত্বে, বাংলায় অনুবাদ করেন আনিসুজ্জামান। এই বিষয়ের স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন, “একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগল দেহে মনে, এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান রচনার কাজে হাত দিয়েছি।”
আনিসুজ্জামান ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের মতো শিক্ষকতার পর ২০০৩ সালে অবসর নেন। ২০০৫ সালে আবার সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে দুই বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন তিনি।
এছাড়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। সর্বশেষ তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.