Header Ads

ডাঃ দেবী শেঠি’র পরামর্শ ও বাংলার ভবিষ্যৎ !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধায় 
 
কম করেও আগামী এক বছর করোনা সংস্পর্শ বাঁচিয়ে কি ভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব তাই নিয়ে ২২-টি পরামর্শ দিয়েছেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ দেবী শেঠি। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বঙ্গবাসী এটি পড়েছেন এবং ‘লাইক’ করেছেন--শেয়ারও করেছেন অনেকেই। এ থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক থেকে কি করলে নিজেদের রক্ষা করা যায় তা নিয়ে মানুষ ভীষণভাবে চিন্তিত। এই পরিস্থিতিতে যদি সম্ভব হতো তাহলে মানুষ করোনা আক্রান্ত এই পৃথিবী থেকে লাফিয়ে অন্য কোনো নতুন পৃথিবীতে চলে যেতে এক সেকেণ্ডও সময় নিত না ! কারণ, পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ ছবিটা এখন কিছুটা হলেও স্পষ্ট হচ্ছে--কিন্তু অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে সিংভাগটাই। কারণটা খুবই স্পষ্ট--ন’কোটি বঙ্গবাসীর মধ্যে টেস্ট-এর সংখ্যা এতটাই নগণ্য এবং উপেক্ষণীয় যে তা থেকে স্পষ্ট কোনো ছবি আাঁকা প্রায় কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। 
 
এ রাজ্যের প্রবল শক্তিময়ী মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত সঠিক সময়ে লকডাউন ঘোষণা করেছেন--কিন্তু লকডাউন মানার জন্যে যা অত্যন্ত জরুরি ছিল তিনি একেবারেই সে পথে হঁটেন নি--না হাঁটার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘মমতাময়ী মানবিকতা’! তিনি ১৪৪ ধারা জারি করেন নি--অচেতন হতজ্ঞান নির্বোধ মানুষকে ঘরবন্দি রাখার জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণের ছাড়পত্র দেওয়ার বদলে তিনি প্রকাশ্যে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করতে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন--‘কড়াকড়ি কিন্তু বাড়াবাড়ি নয়’! পুলিশের মধ্যে এই বাণী এক মারাত্মক দ্বিধাগ্রস্ততা তৈরি করলো। শুধু তাই নয়--পুলিশকে দু’চারজন বে-আক্কেলে লোকজনকে কান ধরে ওঠবোস করাতে দেখে এবং পেছনে দু’চার ঘা লাঠি ব্যবহার করতে দেখে তিনি রেগে আগুন হয়ে গিয়ে দু’চারজন পুলিশকে ‘ক্লোজ’ করে দিলেন ! কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকজন তাঁর এই ‘মমতাময়ী মানবিকতা’র বহিঃপ্রকাশ দেখে দলে দলে ভিড় বাড়িয়ে গেল দোকানে বাজারে ফুলহাটে পানবিড়ির দোকানে মিষ্টির দোকানে মদের দোকানে ! গোল্লায় চলে গেল লকডাউনের নিয়ম-কানুন।
মুখ্যমন্ত্রী শুধু গাদা গাদা বঙ্গ কমিটি-ই তৈরি করলেন না--নামিদামী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নক্ষত্রখচিত ‘গ্লোবাল কমিটি’ও তৈরি করে ফেললেন--যার কোনো কার্য্যকারিতা বঙ্গবাসীর চক্ষু-কর্ণ আকৃষ্ট করতেই পারল না ! বিশিষ্ট চিকিৎসক-গবেষক-স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়েও বেশ কিছু কমিটি তৈরি হল--যার মধ্যে বহুবিতর্কিত ‘ডেথ-অডিট কমিটি’ও ছিল। প্রথম প্রথম এইসব বিশিষ্ট-অতিবিশিষ্ট চিকিৎসক-গবেষকদের কয়েকদিন নবান্নের দরবার আলোকিত করে মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের সঙ্গে বসে বসে দারুণ দারুণ সব আশাব্যঞ্জক ভাষণ রাখতেও দেখা গেল। যাদের মধ্যে অতিবিশিষ্ট ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী সহ সরকার-মুখার্জ্জী-ব্যানার্জ্জী প্রমুখ চিকিৎসক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের এখন আর নবান্নের ধারেকাছে দেখা যাচ্ছে না। কারণ, তাদের এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’
অবস্থা ! প্রতিমুহূর্তে স্বাস্থ্য অজ্ঞানী রাজনৈতিক অনুশাসনে থেকে পিলে চমকানো নির্দেশ পালনের আক্ষমতার দরুণ তাঁরা আত্মগোপনে বাধ্য হযেছেন। তাঁদের নিজস্বতা বা জরুরি পথনির্দেশ ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’কে অনুসরণে অক্ষম হয়ে পড়ছিল দ্রুত--ফলে লুকিয়ে পড়া ছাড়া তাঁদের আর কিছু করার ছিল না। তবু দু’একজন বিবেকের তাড়নায় বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে লকডাউন নিয়ে ছেলেখেলার বিরুদ্ধে--প্রচুর পরিমাণে টেস্ট না করানোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিতে দেখা গেছে।
রাজনৈতিক অজ্ঞানী স্বাস্থ্যবিশারদদের চাহিদা ও নির্দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে দু’জন চিকিৎসক দেহ রেখেছেন--প্রচুর চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী-পুলিশকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এ পরিস্থিতি কোথায় কতদূরে গিয়ে থামবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশিষ্ট-অতিবিশিষ্ট চিকিৎসক-স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ-গবেষকরা এখনও কো-মর্বিডিটি’র ৭২-সংখ্যার রহস্যভেদ করে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। এটা তো তাঁদের সকলেরই জানা ছিল--নানা জটিল রোগে অসুস্থরা দ্রুত করোনা আক্রান্ত হবেন--হলে তাদের সিংহভাগই মারা যাবেন--হয়েছেও তো তাই--তবু তাদের করোনা আক্রান্তে মৃত--এই কথাটা বলা যাচ্ছে না কেন কেউ জানে না ! এই সত্য মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর লজ্জার জায়গাটা কোথায় তাও কেউ খুঁজে পাচ্ছে না ! এই ৭২ জনের সামাজিক সদ্গতি কি হবে তা সম্ভবত একমাত্র ঈশ্বরই জানেন--কোনো অতি বিশিষ্ট চিকিৎসকও জানেন না !
অন্যান্য রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি--কারণ, সেইসব রাজ্যে জনসংখ্যার বিচারে অনেক কম হলেও যত পরীক্ষা হয়েছে তার ফলাফল সামনে এসেছে। এসেছে বলেই সেখানে মৃত্যুর হার আক্রান্তের সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অনেক-অনেক বেশি ! ‘ডেথ-অডিট কমিটি’ও এই হার কমাতে পারে নি। কি করে পারবে? এখানে আক্রান্তের সংখ্যা নির্ণয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রচণ্ড অনীহা এবং ব্যর্থতাই মৃত্যু হারের বিচারে পশ্চিমবঙ্গকে এক নম্বরে রেখেছে ! অন্যান্য রাজ্যেরও টেস্ট কিট--পিপিই ইত্যাদির সমস্যা কিছু কম ছিল না, তবু বিস্ময়কর ভাবে কেরল উড়িষ্যার মতো কিছু রাজ্য তো মানুষকে আতঙ্ক থেকে অনেকটাই দূরে রাখতে পেরেছে। ঐসব রাজ্যে রাজনৈতিক ভাষণবাজির তুলনায় নিঃশব্দে কাজ হয়েছে অনেক বেশি। ফলাফল একেবারে সামনে। পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা করোনার বিরুদ্ধে একমুখী হওয়ার বদলে হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণতঃই কেন্দ্র তথা বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস বিরোধী ! রাজনৈতিক নটসূর্যরা নিয়ম করে সাংবাদিক বৈঠকে বসে রীতিমতো নাটকীয় ভঙ্গিতে রাজনৈতিক লীলাখেলা খেলে চলেছেন। ফলে পরিস্থিতি ক্রমশঃই বিগড়ে চলেছে ! লকডাউন ভাঙ্গার প্রবণতা যেসব অঞ্চলে খুব বেশি দেখা গেছে সেই সব অঞ্চলের কথা যদি কেউ উচ্চারণ করেছে তাকে বলা হয়েছে--সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করা যাবে না। কেন্দ্রীয় কমিটিও সেইসব অঞ্চলের দিকে তর্জনী তুলেছে--তাদেরও একই কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আক্রান্তের তথ্য এখন আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক-অনেক কম পরীক্ষা হলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না--রাজ্যের পরিস্থিতি কতটা স্বর্গীয় !
এতদিন যারা ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বাজারে হাটে দোকানে নেচে বেড়িয়েছে--প্রতিনিয়ত প্রমাণ করেছে বাঙালী শুধু আত্মঘাতী জাত-ই নয়--হা-ঘরে জাতও--তাদের মধ্যেই কত হাজার সাইলেন্ট ক্যারিয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে তা আর বোঝা যাবে না। ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় বাস-অটো-টোটো চালু হয়ে গেছে--গুলতানি শুরু হয়ে গেছে চা-পানবিড়ি’র দোকানেও। রেলও চলবে ১২ তারিখ থেকে। র‌্যাপিড টেস্টও আর হবে না। সুতরাং যে সব সাইলেন্ট ক্যারিয়ার (উপসর্গহীন) নিজেদের ইমিউনিটির জোরে অসুস্থ হবে না--শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে নেবে তারা করোনা ভাইরাস নিঃশব্দে চেইন সিস্টেমে ছড়িয়ে যেতে থাকবে। আক্রান্ত হবেন সেইসব অসুস্থ নানা রোগে রোগাক্রান্ত লোকজন যারা করোনা স্পর্শে দ্রুত মারা যাবেন প্রায় বিনা চিকিৎসায়। অপরীক্ষিত এইসব করোনা আক্রান্তরা ডাক্তারের কাছে যাবেন চিকিৎসার আশায়--ডাক্তারবাবুরা কি করবেন না করবেন তা বলা প্রায় অসম্ভব। তবে যারা জলে ডুবে বা আগুনে পুড়ে মারা যাবে তাদের ‘কজ অফ ডেথ’ কলামে চিকিৎসকদের লিখতে হবে--রুগী সাঁতার না জানার কারণে বা জলে ঝাঁপ দিতে না জানার কারণেই মারা গেছে ! হাজারে হাজারে মুত্যুর ‘কজ অফ ডেথ’ এই ভাবেই লিখিত থাকবে !
এ প্রসঙ্গে আর পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে ঢুকছি না। ব্যাপারটা এখন সকলের কাছেই খুবই স্পষ্ট হয়ে গেছে। রাজনৈতিক রঙিন মোড়কে আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। যাইহোক, তাহলে মোদ্দা কথাটা হল এই যে--বঙ্গবাসী ডাঃ দেবী শেঠি’র পরামর্শকে জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে চাইছেন--কতটা মানতে পারবেন সেটা পরের কথা--তবে এটা খুবই স্পষ্ট যে এ ছাড়া মানুষের আর বাঁচার উপায় নেই !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.