Header Ads

রাজনৈতিক মানবিকতা ও পরিযায়ী প্রেম !!




বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ঃ এই মুহূর্তে দেশে তুমুল আলোচনায় রয়েছে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গটি ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র মোড়কে মুড়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উৎকট আগ্রহটাই ভীষণ দৃষ্টিকটূভাবে চোখে পড়ছে। এক অচেনা অজানা অদৃশ্য ঘাতকের আকস্মিক হানাদারিতে গোটা বিশ্ব প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। দেশে সর্বপ্রথম লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২২ মার্চ থেকে--তিনি এই লকডাউন ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন--এমন খবর আমার কাছে নেই। এর দু’দিন পরেই দেশের প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে ২১ দিনের যে লকডাউন ঘোষণা করলেন তার আগে দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মুখ্যসচিবদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনা করেছিলেন--লকডাউন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের পরামর্শ এবং কি কি সমস্যার মোকাবেলা করতে হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন--দেশের প্রতিটি সংবাদমাধ্যম অন্ততঃ এমনটাই জানিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার হল একটি রাজ্যও তাদের নিজের নিজের রাজ্যের ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের সংখ্যা জানিয়ে তারা যে ঘোরতর বিপদে পড়বে--এই বিষয়টার ওপর প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেন নি ! অথচ রাজ্যগুলির মুখ্যসচিব এবং মুখ্যমন্ত্রীরা ২০১১’র সেন্সাস রিপোর্ট একটু নেড়েচেড়ে দেখলেই পরিযায়ী শ্রমিকদের মোটামুটি একটা সংখ্যা পেয়ে যেতে পারতেন। ২০১১’র পরের দশ বছরে এই সংখ্যার আনুমানিক বৃদ্ধির একটা সংখ্যা তাঁরা পেশ করতে পারতেন। ‘কাগজ দেখাবো না’ আন্দোলনে যদি সেন্সাস ব্যাপারটাই লাটে উঠে যায় তাহলে এই ধরণের আকস্মিক ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে দিশেহারা হতে হবে রাজ্যগুলোকেই।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম লকডাউন ঘোষণার দিনই রাজ্যসরকারগুলিকে বলেছিলেন--ভিন রাজ্য থেকে পেটের দায়ে শ্রমিকের কাজ করতে আসা মানুষ--যারা লকডাউনের ফলে আটকে যাবেন তাদের থাকার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা যেন রাজ্যসরকারগুলো করে। এর জন্যে রাজ্যগুলিকে ১১ হাজার কোটি টাকা (সঙ্গে বিনামূল্যের রেশন) বরাদ্দ করা হয়েছিল বলে সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী সীতারমণ এবং তাঁর দাবিকে কোনো রাজ্যই নস্যাৎ করে নি!


কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, কেরল-উড়িষ্যা’র মতো হাতে গোণা দু’তিনটি রাজ্য ছাড়া আর কোনো রাজ‍্য পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় নি। না, বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশ-গুজরাত-কর্ণাটক সরকারও এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় নি--তাদের থাকার খাওয়ার ব্যবস্থা করে নি। তাদের নিরাপত্তা-খাদ্যসমস্যার প্রশ্নটিকে প্রশাসনিক পীড়নের মাধ্যমে দমিয়ে রাখা হয়েছে। বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ জানাতে রাস্তায় নামছেন--পুলিশের লাঠি খাচ্ছেন--নিজের নিজের রাজ্যসরকারগুলোও এদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকার দরুণ বাধ্য হয়েই দুতিন’শো--এমনকী হাজার মাইলও হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টায় পথে নেমেছেন !

অবিজেপি রাজ্যসরকারগুলোও পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক নৃশংসতায় কিছু কম যায় নি। রাজস্থান-পাঞ্জাব-মহারাষ্ট্র থেকেও হাজারে হাজারে শ্রমিকরা পথে নেমেছেন বাড়ি ফেরার মরিয়া চেষ্টায় ! কিন্তু প্রশ্ন হল--কেন? কেন পরিযায়ী শ্রমিকরা রেললাইনকে রাস্তা মনে করে সেই পথেই হাঁটছেন? রাত্রে বিশ্রামের জন্যে এবরোখেবরো পাথর ও লোহালক্করকে বিছানা মনে করে ঘুমিয়ে পড়ছেন? বিভিন্ন রাজ্যের রাস্তা হাইওয়ে দিয়ে লকডাউনের ন্যূনতম নিয়মকানুন না মেনে মিছিলের মতো হাঁটছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা? একের পর এক দুর্ঘটনায় তাঁদের প্রাণ দিতে হচ্ছে কেন? যেসব রাজ্যে এই চরম বেদনাদায়ক অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটছে সেখানে প্রশাসন পুলিশ জনপ্রতিনিধি তাদের বশংবদ শর্তহীন অনুগামীরা নেই? কারুর চোখে পড়ছে না? রাজ্য প্রশাসনগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে এই পরিযায়ী শ্রমিক মিছিল ও তাদের মর্মান্তিক মৃত্যুমিছিল এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গগণবিদারি অভিযোগ তোলার জন্য? কিন্তু কেন্দ্র তো রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন-মুখ্যমন্ত্রী-মুখ্যসচিবদের দায়িত্বে বা কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাজ্যের মধ্যে যা কিছু করার তা তো রাজ্য প্রশাসনকেই করতে হয় ! পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এবং তাদের নিরাপদে রাখা--এবং সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী তাদের বাড়ি পাঠানো বা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তো রাজ্য সরকারেরই--তারা তো তা করলই না--উল্টে ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র যাত্রাপালা কে কতটা চিত্তাকর্ষক ঢঙে মঞ্চস্থ করতে পারে তারই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল !

আমাদের রাজ্যের মুখ্যসচিব সময় পান নি ২০১১’র সেন্সাস রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকের একটা আনুমানিক সংখ্যা তৈরি করে নিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনা বা আনতে সক্ষম না হলে হাইটেক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার। রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে যে ট্রেন সম্পর্কিত যাচ্ছেতাই রকমের কু-নাট্য দেখতে হল--এক কথায় বলতে গেলে তাকে গ্রাম্যভাষায় বলতে হয়--চূড়ান্ত ধাষ্টামো !

গতকালই রাহুল গান্ধীর ‘পরিযায়ী প্রেম’ সংক্রান্ত একটা ছবি দিয়ে আমি বলেছিলাম এই মুহূর্তে এই ধরণের ভাঁড়ামি ও নৌটঙ্কি তাঁকে মানায় না। এই পোস্টে কারুর সঙ্গে কোনো তুলনা ছিল না। কিন্তু কিছু বিশেষ ওয়াশিং মেশিনে মাথা ধুয়ে যারা নিজেদের মাথাটারই ১২-টা বাজিয়ে ফেলেছেন তাঁরা রে-রে করে উঠলেন--মোদীর কিছু ছবি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন মোদী রাহুলের চেয়েও কতবড় ড্রামাবাজ ! আমি রাহুলের দলিত-ঝুপরিতে গিয়ে একসঙ্গে খাওয়া, মন্দিরে মন্দিরে পট্টবস্ত্র পরিধান করে ‘আমি বিশুদ্ধ হিন্দু’ মার্কা ডায়ালগ ছোঁড়া সহ প্রচুর ছবি দিয়ে বিতর্কে ঢুকতে পারতাম--কিন্তু যারা শুধু বিশেষ বিশেষ ওয়াশিং মেশিনে মাথা ধুয়ে গেল আর কাঁঠালপাতা চিবিয়ে গেল তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে যাওয়াটাকেই আমি পছন্দ করি। দেশের কেউ মনে না করলেও প্রায় মাটিতে মিশে যাওয়া কংগ্রেসের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা (মরে হেজে এখনও যারা শুধু কাগজে-কলমে এবং কণ্ঠস্বরে টিকে আছে) মনে করেন তাঁদের বালগোপাল রাহুলবাবা প্রধানমন্ত্রী হবেন ! যদি তাই হয় তাহলে আমাদের হবু প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের নিয়মকানুন ভেঙে সামাজিক দূরত্বের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের ও যাদের সঙ্গে তাঁকে রাস্তার ধারে বসে খোশ গপ্পো করতে দেখা গেল তাদেরও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে গেলেন কেন? এক ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এই ধরণের চটুল বালখিল্যতা কতটা স্বাভাবিক? ফালতু তর্কে যারা ঝাঁপালেন তারা কিন্তু কেউ এদিকটায় তাকালেন না। শুধু তাই নয়--তারা কেউ প্রশ্ন তুললেন না--কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাব রাজস্থান-মহারাষ্ট্র থেকে হাজারে হাজারে পায়ে হেঁটে--গরু-ছাগলের মতো ট্রাকবন্দি হয়ে গাদাগদি করে রাজ্যের রাস্তা দিয়ে পালাতে চাইছে কেন? তাদের কাছে খাবার জল খাদ্য মাথার ওপর নিদেনপক্ষে পলিথিন শিটও নেই কেন? কি করছেন রাহুল গান্ধী ও তাঁর সোনা-রূপোর চামচ ও পার্ষদরা? কাজের কাজ না করে রাজ্যে রাজ্যে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের ব্যবহার করে কি ভাবে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায় তার নির্লজ্জ নৃশংস অঙ্ক কষে যাচ্ছেন শুধু? এ দেশের এই ‘রাজনৈতিক মানবিকতা’র আমি কঠোর সমালোচনা করবই। ধিক্কার জানাবো বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম, এমন কী হ্যাঁ, তৃণমূলকেও। মেঘনাদের মতো আড়ালে থেকে এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের নিয়ে যেসব রাজনৈতিক লীলাখেলা চলছে তা সঠিক সময়ে ঐসব হতভাগ্য শ্রমিকরাও যেমন বুঝবেন--বিশেষ বিশেষ ওয়াশিং মেশিনে মাথা না ধোওয়া দেশের জনগণও বুঝবেন--তাদের সম্মিলিত ঘেন্না ও থুথু থেকে বাঁচবার মতো পোষাক তারা কেউ খুঁজে পাবে না। আমার বলতে কোনো বাধা নেই--‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের নিয়ে বিজেপিও মারাত্মক রাজনীতি করছে--যদিও এই সমস্যা সমাধানে তাদের রাজ্যগুলিতে অন্ততঃ দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের হাতেই দৃষ্টান্ত গড়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু সুস্থ দৃষ্টান্ত তৈরির মানসিকতা শেষপর্যন্ত পঙ্গু হয়ে যায় ‘রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা’র সামনে--তাদের নতজানু হতেই হয়--এটাই দেশের দুর্ভাগ্য--সুতরাং ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের জীবন ও যন্ত্রণাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক লীলাখেলা তো চলবেই--রাজনীতির উর্দ্ধে ওঠার হিম্মত কে দেখাবে?

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.