শুভ দোলপূর্ণিমা ও দোল উৎসব !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
রাধা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে দোল খেলছেন কৃষ্ণ অন্য নাম দোল, দোলপূর্ণিমা, বসন্তোৎসব, হোলি পালনকারী ভারতীয় (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন) নেপালি (প্রধানত হিন্দু এবং
বহুসংখ্যক বৌদ্ধ) এবং বাংলাদেশ (প্রধানত হিন্দু এবং বহুসংখ্যক বৌদ্ধ)
দোলযাত্রা একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। বহির্বঙ্গে পালিত হোলি উৎসবটির সঙ্গে
দোলযাত্রা উৎসবটি সম্পর্কযুক্ত। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন
মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
বৈষ্ণব বিশ্বাস
অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির
বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সহিত রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই
ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও
কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তন সহকারে
শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন।
দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই
পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত
করা হয়।
দোল উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই
নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মেতে
ওঠেন। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। দোলের আগের দিন খড়, কাঠ,
বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এই
বহ্ন্যুৎসব হোলিকা দহন বা মেড়াপোড়া নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি
বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়।
দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত
পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলি মূলতঃ দুই প্রকার--প্রথমটি দোলযাত্রার
পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং
দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগখেলা কেন্দ্রিক কাহিনী।
ভাগবত
পুরাণ এর সপ্তম অধ্যায় অনুসারে, অসুর রাজা হিরণ্যকশিপুর অমর হতে চান।
এজন্য ব্রহ্মার কাছ থেকে অমরত্বের বরপ্রাপ্তির জন্য তিনি কঠোর তপস্যায়
বসেন। কিন্তু দেবতারা খুব কমই অমরত্ব দান করেন। অথচ হিরণ্যকশিপু এমন বর চান
যা থেকে মনে হয় যে পরোক্ষভাবে তিনি অমরত্ব লাভ করার বর চাইছেন। যদিও তিনি
যে বর লাভ করেন তা তাকে পাঁচটি বিশেষ ক্ষমতা দান করে। এগুলো হচ্ছে, তাকে
মানুষও হত্যা করতে পারবে না, কোন প্রাণীও হত্যা করতে পারবে না; তাকে ঘরেও
হত্যা করা যাবে না, আবার বাইরেও হত্যা করা যাবে না; তাকে দিনেও হত্যা করা
যাবে না আবার রাতেও হত্যা করা যাবে না; তাকে অস্ত্রের (যা ছুড়ে মারা হয়)
দ্বারাও হত্যা করা যাবে না আবার সস্ত্রের (যা হাতে থাকে) আঘাতেও হত্যা করা
যাবে না; তাকে স্থল, জল বা বায়ু কোথাও হত্যা করা যাবে না। এই বর লাভ করে
হিরণ্যকশিপু অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে ওঠেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কেবল তাকেই
দেবতা হিসেবে পূজা করা হবে। কেউ তার আদেশ পালন না করলে তিনি তাকে শাস্তি
দেবেন বা হত্যা করবেন। তার পুত্র প্রহ্লাদ তার সাথে সম্মত হন নি। তিনি
বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, তার পিতাকে দেবতা হিসেবে পূজা করতে তাই তিনি অস্বীকার
করেন। প্রহ্লাদ বিষ্ণুকেই পুজো করতে থাকেন।
এতে হিরণ্যকশিপু খুব
ক্রুদ্ধ হন এবং প্রহ্লাদকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে একবার
হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছে সাহায্য চান। হোলিকার একটি বিশেষ পোশাক
ছিল যা তাকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করত। হিরণ্যকশিপুকে তিনি তার
কোলে বসতে বলেন, আর হিরণ্যকশিপু তার কোলে বসলে তিনি প্রহ্লাদের উপর আগুন
জ্বালিয়ে দেন। এতে প্রহ্লাদ আগুনে পুড়ে মারা যাবে কিন্তু হোলিকার কাছে
থাকা বিশেষ বস্ত্রের জন্য তার নিজের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু সেই আগুন
জ্বলতেই হোলিকার শরীর থেকে সেই বস্ত্র খুলে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীরকে আবৃত
করে। এতে হোলিকা আগুনে পুড়ে মারা যায়, আর প্রহ্লাদ মৃত্যুর হাত থেকে
বেঁচে যান।
বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার (অর্ধমানব-অর্ধসিংহ) রূপে গোধূলি লগ্নে
(দিন ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে) আবির্ভূত হন, হিরণ্যকশিপুকে ঘরের চৌকাঠে (না
বাইরে না ঘরে) নিয়ে যান, তাকে নিজের কোলে (না বায়ুতে, না স্থলে) স্থাপন
করেন, ও এরপর হিরণ্যকশিপুর নাড়িভুড়ি বের করে ও তার থাবা দিয়ে (না অস্ত্র
না শস্ত্র) তাকে হত্যা করেন। ফলে হিরণ্যকশিপুর প্রাপ্ত বর তাকে বাঁচাতে
পারে নি। প্রহ্লাদ ও মানব জাতি বাধ্যবাধকতা ও ভয় থেকে মুক্তি পায়।
নৃসিংহের দ্বারা হিরণ্যকশিপু বধ-এর এই কাহিনী অশুভ’র ওপর শুভ’র জয়কে
নির্দেশ করে। হোলিকা দহন বা নেড়াপোড়া উৎসব এই ঘটনাটিকেই নির্দেশ করে।
হোলিকার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনিই দোলের আগের দিনে অনুষ্ঠিত হোলিকাদহন
বা চাঁচর উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুনমাহাত্ম্য
গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে।
ভারতের ব্রজ
অঞ্চলে, যেখানে কৃষ্ণ ছোট থেকে বড় হন, সেখানে রাধা ও কৃষ্ণের মধুর প্রেমের
স্মৃতি হিসেবে দিনটি রঙ-পঞ্চমী হিসেবে উদযাপিত হয়। বসন্তে উৎসবটি হয়,
এবং প্রেমের উৎসব হিসেবে দিনটি পালিত হয়।এছাড়া দিনটিতে কৃষ্ণকে স্মরণ
করার জন্য আরেকটি পুরাণও রয়েছে। হোলিকে ফাগ্বাহ-ও বলা হয়, এবং এক্ষেত্রে
হোলিকাকে বলা হয় পুতানা। কৃষ্ণের মামা এবং রাজা কংস তার শিশু ভাগ্নে
কৃষ্ণকে নিজের জীবনের জন্য সংকট বলে মনে করেন। কংস রাক্ষসী পুতানাকে, নারীর
বেশে কৃষ্ণকে হত্যা করতে পাঠান, সেখানে পুতানা রাক্ষসী কৃষ্ণকে স্তন্যদান
করাতে গিয়ে বিষ প্রয়োগ করে কৃষ্ণকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু শিশু
কৃষ্ণ কেবল পুতনার বিষাক্ত দুধই পান করেনি, সেইসাথে পুতানার রক্তও পান
করেন। এরফলে পুতনা একজন রাক্ষসীতে পরিণত হয়। এরপর পুতানা পালিয়ে যায় ও
আগুনে জ্বলে ওঠে, এবং কৃষ্ণের গায়ের রঙ ঘন নীল হয়ে যায়।
ফাগ্বাহ
উদযাপনের আগের রাতে পুতনার দহনও উদযাপিত হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণ
যৌবনে হতাশ হয়ে ভাবেন, উজ্জ্বল বর্ণের রাধা ও অন্যান্য গোপিরা তার শ্যাম
বর্ণের কারণে পছন্দ করবে কিনা। এতে কৃষ্ণের মা কৃষ্ণের হতাশায় ক্লান্ত
হয়ে তাকে বলেন, রাধার কাছে গিয়ে সে রাধার মুখমণ্ডলকে যেকোন রঙ দিয়ে
রাঙ্গিয়ে দিতে পারে। কৃষ্ণ তাই করেন, এবং এরপর রাধা ও কৃষ্ণ পরস্পরের
সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত হয়ে যান। রাধা ও কৃষ্ণের এই রঙ নিয়ে খেলাই হোলি
বা দোলযাত্রা হিসেবে পালিত হয়। ভারতের বাইরে, হোলি (ফাগ্বাহ)’র
কিংবদন্তীটি কিছু ক্যারিবীয় এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভারতীয় বংশদ্ভূত
সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেখা যায়, যেমন গায়ানা এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এটি
দেখা যায়। মরিশাসেও এই দিনটি সাড়ম্বরে পালন করা হয়।
বৈষ্ণবধর্ম
ছাড়া শৈবধর্ম ও শাক্তধর্মেও হোলি উৎসবের তাৎপর্য রয়েছে। হোলি নিয়ে
আরেকটি গল্প আছে যা ভালোবাসার জন্য আগুনে পুড়ে আত্মত্যাগ এর সাথে
সম্পর্কিত। এই গল্পটি শিব ও কামদেবের। শিবের সাথে পার্বতীর বিয়ে হওয়ার আগে,
পার্বতী শিবকে যোগ ও ধ্যান থেকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনবার জন্য বসন্ত
পঞ্চমীর দিনে প্রেমের দেবতা কামদেবের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কামদেব
(প্রেমের দেবতা) এবং তার স্ত্রী রতি (প্রেমের দেবী) পার্বতীকে সাহায্য করার
চেষ্টা করেছিলেন যাতে পার্বতী শিবকে তার স্বামী হিসেবে পেতে সক্ষম হন। শিব
যোগাসনে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কামদেব ও রতি শিবের ধ্যান ভঙ্গ করে
পার্বতীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করানোর জন্য তার দিকে তীর ছোঁড়েন। কিন্তু
ধ্যানে এই বিঘ্ন ঘটাবার কারণে শিব তার তৃতীয় চক্ষু খোলেন এবং সেই চক্ষুর
তেজদীপ্ত চাহনিতে কামদেব দগ্ধ হয়ে ছাইয়ে পরিণত হন। এই ঘটনায় কামদেবের
স্ত্রী রতি ভেঙে পড়েন। তাদের তীর কাজ করেনি, বরং শিবকে বিদ্ধ করার আগেই
এগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে শিব ও পার্বতীর বিবাহ হয়। এই বিবাহের
সময় রতি শিবের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে কামদেবকে তার কাছে ফিরিয়ে দেয়া
হয়। শিব সম্মত হন, এবং কামদেবকে সত্যিকারের আবেগ এর একটি অবাস্তব সত্তা
হিসেবে তাকে ফিরিয়ে দেন। প্রেমের দেবতার এই ফিরে আসা বসন্ত পঞ্চমী উৎসবের
চল্লিশ দিন পর হোলি হিসেবে পালিত হয়। এই কামদেবের কিংবদন্তি ও হোলি উৎসবে
এর তাৎপর্যের বিভিন্ন প্রকরণ আছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে এই কিংবদন্তির
বিভিন্ন রূপ দেখা যায়।
ঐতিহ্যগতভাবে এই উৎসবটিকে অ-হিন্দুদের মধ্যে, যেমন জৈন এবং নেপালের নেওয়ার বৌদ্ধদের মধ্যেও দেখা যায়।
শিখরা একে ঐতিহ্যগত উৎসব হিসেবে পালন করেছে, অন্ততঃ উনিশ শতক জুড়ে। শিখ
ধর্মের ঐতিহাসিক ধর্মে এই উৎসবকে হোলা বলা হয়। শিখদের শেষ মানবগুরু গুরু
গোবিন্দ সিংহ হোলিকে পরিবর্তন করে তিন দিনের হোলা মহল্লা উৎসবে পরিণত
করেছিলেন, যেখানে হোলি উৎসব বর্ধিত হয়ে এতে মার্শাল আর্টও অন্তর্ভূক্ত
হয়। আনন্দপুর সাহিব-এর উৎসবের পর হোলি উৎসবের এই বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। এই
আনন্দপুর সাহিবে শিখ সৈন্যরা একটি নকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ, ঘোড়দৌড়,
শরীরচর্চা, তীর চালানো ও সামরিক-চর্চা করে।
মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সময়
শিখ সাম্রাজ্যে হোলি খেলা হয় এবং সেই উৎসবের সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তানের
উত্তর অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ট্রিবিউন ইন্ডিয়া’র একটি প্রতিবেদন অনুসারে,
শিখ দরবারের একটি নথি বলছে, ১৮৩৭ সালে লাহোরে রঞ্জিত সিংহ ও তার
কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ৩০০ মাউন্ড-এর রঙ ব্যবহার করেছিলেন। রঞ্জিত সিংহ
বিলাবল বাগানে অন্যদের সাথে হোলি উৎসব উদযাপন করেছিলেন, যেখানে বিভিন্ন
সজ্জিত তাবু খাটানো হয়। ১৮৩৭ সালে স্যার হেনরি ফেন, যিনি তৎকালীন ব্রিটিশ
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন, তিনি রঞ্জিত সিংহের আয়োজিত হোলি উৎসবে
যোগদান করেছিলেন। রঞ্জিত সিংহের উদ্যোগে লাহোর দুর্গে একটি দেয়াল চিত্র
তৈরি করা হয়, যেখানে কৃষ্ণকে গোপীদের সাথে হোলি খেলতে দেখা যায়। রঞ্জিত
সিংহের মৃত্যুর পর, তার শিখ পুত্রেরা এবং অন্যেরা রঙ দিয়ে আরম্বরপূর্ণভাবে
হোলি উৎসব চালিয়ে যান এবং এই উৎসবগুলোতে ব্রিটিশ কর্মকর্তাগণও যোগদান
করতেন।
কোন মন্তব্য নেই