Header Ads

এ বছরের সুপার ফ্লপ পালা গান--‘ওরে বন্ধু ফিরে আয়’!!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

অনেকেরই বিশ্বাস এই নতুন পালাগানের রচয়িতার নাম প্রশান্ত কিশোর। আমার ধারণা সম্পূর্ণ অন্যরকম। কারণ, আমি প্রশান্ত কিশোর এবং তার কর্পোরেট ভোটকৌশলের স্টাইল প্রথম থেকেই পর্যবেক্ষণ করে আসছি। এর আগে প্রশান্ত কিশোর ‘মোদীকে বলো’ ‘রাহুলকে বলো’ ‘মুলায়মকে বলো’ ‘নীতিশকে বলো’ (নীতিশের সঙ্গে রাবড়িমাখা সম্পর্ক থাকাকালীন সময়েও) কিংবা ‘মোদী ভারতের গর্ব’ ‘রাহুল ভারতের গর্ব’ ‘নীতিশ বিহারের গর্ব’ ‘মুলায়ম উত্তরপ্রদেশের গর্ব’--এ ধরণের  কোনো শব্দবন্ধের জন্ম দিতে পারেন নি--কারণ এ ধরণের শব্দবন্ধ তাঁর কর্পোরেট মস্তিষ্ক প্রসূত হওয়া সম্ভব ছিল না। এ ধরণের শব্দবন্ধ পালাগান লেখায় সিদ্ধহস্তরাই তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের যৌক্তিকতা একটু অনুসন্ধান করলে সকলেই খুঁজে পাবেন--খুব কঠিন কিছু নয়।

‘জলযোগে যোগাযোগ’ এবং ‘পুরনো বন্ধু ফিরে আয়’--এই দুই চমকপ্রদ শব্ধবন্ধও তাঁর নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত নয় বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই দুই শব্দবন্ধের মধ্যে হিন্দি (বিহারী) সাহিত্যের বিন্দুমাত্র সুগন্ধ নেই--এমন কী বিজেপি’র ‘চায়ে পে চর্চা’র সঙ্গে ‘জলযোগে যোগাযোগ’-এরও তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, চর্চা ও যোগাযোগ এক বস্তু নয়। আমার কাছে রাজ্যের বিভিন্ন শহর-গ্রামের যেসব খবরাখবর এসেছে এবং আসছে তা থেকে আমার কাছে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, অনেকেরই বিশ্বাস মতো তৃণমূল কংগ্রেস এখন প্রশান্ত কিশোরের নিয়ন্ত্রণে চলছে--এটা ঠিক নয়, বরং প্রশান্ত কিশোরের মাথার ওপর একজন সুপার বস আছেন এবং তাঁরই নিয়ন্ত্রণে প্রশান্ত কিশোর ঘুঁটি সাজাচ্ছেন বলেই আমার বিশ্বাস প্রাপ্ত নানান খবর থেকেই দৃঢ় হচ্ছে এবং এই সুপার বসের বৃত্তের মধ্যে ঈর্ষণীয় ক্রাউডপুলার যুব আইকন শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারাও নেই ! সত্যিটা সামনে আসবে পুর ও বিধানসভা প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর।
‘বস’-এর পরামর্শ মোতাবেক তৃণমূলস্তরে পিকে’র প্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করছেন বা জিজ্ঞাসাবাদ বা আলাপ-আলোচনা করছেন যাদের নামের তালিকা তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ‘পুরনো বন্ধু ফিরে আয়’ নামক পালাগান যাদের নিয়ে মঞ্চস্থ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে প্রকৃত পুরনো বন্ধুদের সিংহভাগেরই কোনো হদিশ নেই ! অথচ পালাগানে দর্শকদের সংখ্যাও খুব কম হচ্ছে না। পরস্পরের মধ্যে চুলোচুলি এবং বিড়ম্বিত বিধায়ক নেতাদের সচিত্র বিবরণ সংবাদমাধ্যমে বেরিয়ে আসছে।
‘পুরনো বন্ধু ফিরে আয়’ এই পালাগানে নব্য-অতিনব্য-তৎকাল-প্যারাসুট তৃণমূলীরা আন্তরিক উৎসাহ উদ্দীপনায় ফেটে পড়বে এবং তাদের দেখে যারা বাধ্য হয়ে চূড়ান্ত হতাশা ও বিরক্তিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তারা দলে দলে দু’হাত তুলে নাচতে নাচতে দলীয় রঙীন মাফলার গলায় জড়িয়ে সম্মানিত বোধ করতে ছুটে আসবে? এই নতুন পালাগানের ‘‘সাফল্য’’ যে কি বলছে তা সকলেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
প্রশান্ত কিশোর জানেন প্রচুর পুরনো কর্মী বসে গেছেন বা বীতশ্রদ্ধ হয়ে অন্য দলে চলে গেছেন। এ কথা তো দলের শীর্ষনেতৃত্ব অনেক আগে থেকেই জানেন এবং মাঝেমাঝেই ‘পুরনো কর্মীবন্ধুদের ফিরিয়ে নিতে হবে ও একসঙ্গে দলের কাজ করতে হবে’ এমন নির্দেশ প্রায় প্রতিটি সভা সমিতিতে দিয়ে থাকেন--কিন্তু ক’জন সেই নির্দেশ পালন করেছে? এখন প্রশান্ত কিশোর বললেই সবাই হৈ-হৈ রবে ছুটে আসবে--এই বিশ্বাসের পেছনে অন্ধ আবেগ থাকতে পারে কিন্তু তার মধ্যে বিন্দুমাত্র যুক্তি থাকতে পারে না এবং তা যে নেই তা প্রমাণিত হচ্ছে।
বাংলায় গ্রামীণ ছড়া আছে--‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।’ তৃণমূলেও যখন নব্য-অতিনব্য-তৎকাল-প্যারাসুটরা ছিল না তখন যারা নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার চরম ঝুঁকি নিয়ে তৃণমূলের জন্ম মুহূর্ত থেকে তৃণমূলের পতাকা হাতে নিয়ে দলটাকে এই জায়গায় তুলে এনেছে তাদের ক’জনের নামধাম পিকে’র ‘‘অরাজনৈতিক’’ প্রতিনিধিরা সংগ্রহ করতে পেরেছেন? শিল্প-সাহিত্য-সংস্কুতি-সংবাদ মাধ্যমের ক’জনের তালিকা পিকে তৈরি করতে পেরেছেন যারা এঁটো-কাঁটার প্রত্যাশা না রেখে মারাত্মক বঞ্চনা উপেক্ষা অস্বীকৃতি অসম্মান তুচ্ছ করে তৃণমূলের পাশে থেকে দলটার বিশ্বাসযোগ্য একটা সাংস্কৃতিক ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল? পিকে এমন কতজনের তালিকা এইসব ক্ষেত্রের লোকজনের তৈরি করতে পেরেছেন যারা তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সম্মান-স্বীকৃতি’র বদলে অবিশ্বাস্য উপেক্ষা অপমান অবহেলার অমার্জনীয় উন্মত্ততার কারণে চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৃণমূলের পাশ থেকে সরে গেছেন? ক্ষমতা-উচ্ছিষ্ট-পুরস্কার-পদের লোভে রাতারাতি রাজনৈতিক মতাদর্শগত ও নীতিগত অবস্থান থেকে সরে এসে যারা  তৃণমূলে ছড়ি ঘোরাচ্ছে তাদের নিয়ে পিকে কি ভাবছে বা আদৌ কিছু ভাবার নির্দেশ সুপার বস-এর কাছ থেকে এসেছে কিনা সেটা কি কিছু জানা যাচ্ছে?
যাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে যারা ‘‘নেতা’’ হল--তোলাবাজি সিণ্ডিকেটবাজি প্রমোটারবাজি চাঁদাবাজির পাশাপাশি সরকারি উন্নয়নের সিংহভাগ লুটেপুটে খাওয়ার জগতে হু-হু করে ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ পেল তারা এই ‘পুরনো বন্ধু ফিরে আয়’ পালাগানে উৎসাহিত হবে? পাগল ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে এইসব নৌটঙ্কিবাজিতে? সামনে পুর ও বিধানসভা ভোট--পিকে রচিত ও সুপার বস পরিচালিত ‘আয় বন্ধু বুকে আয়’ মার্কা নৌটঙ্কি দেখে ক্রীতদাসত্বে অভ্যস্ত অন্ধ স্তাবককূল ছাড়া আর কেউ অনুপ্রাণিত হবে বলে আমার মনে হয় না। বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের সাংগঠনিক প্রতিটি ক্ষেত্রে বেশ কিছু শিক্ষিত লোক ছিল যাদের কূটবুদ্ধিও ছিল বেশ চমকপ্রদ ও মসৃণ--গোদা ব্যাপার-স্যাপার খুব কম ছিল, তাই নয় নয় করেও তারা সাড়ে তিনদশক রাজত্ব করে যেতে পেরেছে। কিন্তু তৃণমূল দু’দশক যেতে না যেতেই তাদের পারফরমেন্সের নমুনা জনগণকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কারা এই মারাত্মকরকমের ‘পুওর’ পারফরমেন্সের কারিগর দল তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারণ, কখন কে কিভাবে কার পর্দা ফাঁসিয়ে দেবে সে সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তাই নেই! বামফ্রন্ট তথা সিপিএম বুঝতে চায় নি--লোকজনকে কিছুদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায়, চিরদিনের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায় না--তাই তাদের এমন পতন হল যে উঠে দাঁড়ানোর জন্যে আগামী সাড়ে তিন দশক সময়ও বড্ড কম মনে হচ্ছে। তৃণমূলের আত্মবিশ্বাসেও সেই একই ‘জনগণকে চিরকালের বোকা’ ভাবার প্রবণতাটা দু’দশক যেতে না যেতেই বিচ্ছিরিরকমের প্রকট হয়ে উঠেছে। এখন দেখার--সুপার বস নিয়ন্ত্রিত পিকে তাদেরও পতন ঠেকাতে পারে কিনা !!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.